মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইতিহাস

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ১০: ১৫, ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসন আমলের পূর্বে ভারতবর্ষ প্রায় সাড়ে পাঁচশ' বছর মুসলিম শাসনামলে ছিল। এ সময় ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন শিল্পশৈলীসহ মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন শত শত মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তেমনি পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণশৈলী, কারুকার্য ও নান্দনিকতায় মসজিদটি অনন্য। মসজিদটির তিন দিকে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ। মসজিদের পিছনের দিকে রয়েছে সবুজের সমারোহ বৃক্ষারাজি দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদে ওজুখানার ব্যবস্থাটিও চমৎকার।

মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর: তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড.ওসমান গনি ও অন্যান্য প্রফেসরের উপস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মসজিদটির ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসের এক শুক্রবার উদ্বোধনের পর মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি মসজিদের মধ্যে এটি সেন্ট্রাল। ৫ বিঘা জমির ওপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত।

মসজিদে দু'টি মিনার, ভিতরে রয়েছে গোলাকার বেশ কিছু পিলার, কারুকার্য খজিত দরজা-জানালা, ঝাড়বাতি নয়টি, আলমারি ২টি। আলমারিতে রয়েছে কোরআন-হাদিসের প্রায় দু'শ অমুল্য বই। মসজিদের ভিতরে ২৩ লাইন (কাতার)এ নামাজে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন মুসুল্লী দাঁড়াতে পারেন। এছাড়া মসজিদের বারান্দার অংশে রয়েছে আরো ১০টি কাতার। সেখানেও প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন দাঁড়াতে পারে। প্রতি শুক্রবার মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার মুসলিস্নর সমাগম হয়।

আমল ও শিক্ষাদান: মুয়াজ্জিন মাওলানা মোঃ শাহ আলম জানিয়েছেন, সপ্তাহে ছয়দিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বাচ্চাদের ফ্রি কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। শুক্রবার বাদ আছর তাবলীগ জামায়াতের বয়ান(গাস্ত) হয়। এছাড়া তাবলীগ জামায়াতের শিক্ষক-ছাত্রদের সমন্বয়ে রবিবার বাদআছর থেকে মাগরিব এই মসজিদে পর্যালোচনা মুলক আলোচনা হয়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজার: "মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই"-বিদ্রহী কবি আশা করেছিলেন-তাঁর কবরের পাশ দিয়ে নামাজী ভাইয়েরা যাবেন, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি তিনি কবরে শুয়ে শুনতে পাবেন।তাতেই তাঁর কবর আজাব থেকে রেহাই পাবেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথাগুলো যেন আল্লাহ কবুল করেছেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়েছে। মসজিদের পাশে আরো কবর দেয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড.ওসমান গনি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, চারুকলার শিক্ষক কামরুল হাসানসহ স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের। যার কারণে গোটা দেশের মানুষ এই মসজিদটি সম্পর্কে ভিন্ন রকম আকর্ষণ অনুভব করে থাকে।

বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন ড.শমসের আলী, ড.আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ আহমদ খান, ডএবিএম হাবিবুর রহমান চৌধুরী, ড.শহীদ উদ্দিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। দিন দিন মুসলিস্নদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শুক্রবার ও ঈদে মুসলিস্নদের সমাগম বেশি ঘটে। ফলে রাস্তায় নামাজ পড়তে হয়। কার পার্কিং-এর জায়গা নেই। মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করা খুবই জরুরি।

আমি কথা বলি-মসজিদের সদস্য সচিব ও খতিব হাফেজ মাওলানা খলিলুর রহমান সাহেবের সাথে। তিনি বলেন-"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি ১৯৭৭ সাল থেকে এ মসজিদের খতিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার সৌভাগ্য যে,আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব হতে পেরেছি। এ মসজিদের মুসুল্লিরা অনেক উচ্চ শিক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী আমার মসজিদের মুসুল্লী।

ইমাম হাফেজ মাওলানা নাজির মাহমুদ বলেন-"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এ মসজিদের ইমাম হতে পেরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্র ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত কৌতুহলী মুসলমানগণ এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মসজিদের খাদেম আব্দুল মালেক, শফিউল্লাহ শিকদার ও মোঃ তারা মিয়া দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের খাদেমের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে অসম্পূর্ণ আলাদা। এটা আমাদের চেতনার প্রতীক।এ মসজিদের সাথে এ দেশের অনেক ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ মসজিদ '৬৯'র গণঅভু্যত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তিত্ব ড.মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদটি এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী, শহীদ মিনার, শিশু পার্ক ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারসহ নানান স্থাপত্য রয়েছে যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আমাদের লক্ষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদটিকে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় একটি মসজিদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে বিভিন্ন দেশের কৌতুহলী মানুষ মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন। আমরা ছয় তলাবিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ জন্য আমরা মসজিদের নান্দনিক ডিজাইন আহবান করছি। বিভিন্ন ডিজাইনার ডিজাইন করছে। ডিজাইন বাছাই সম্পন্ন হলে সরকার ও বিদেশীদের কাছে মসজিদ নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করা হবে। ইতিমধ্যে এ মসজিদটি নির্মাণের ব্যাপারে সৌদি ও ইরান সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বর্তমান কমিটি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী: মসজিদ পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নিবেদিতপ্রাণ কমিটি। কমিটির সদস্যরা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ও জ্ঞানী-গুণী। সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড.মিজানুর রহমান, সদস্য সচিব- মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা খলিলুর রহমান, সদস্য- চীফ ইঞ্জিনিয়ার আমির হোসেন, ডঃইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া, পরিচালক,হিসাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য যে সংগ্রাম সূচিত হয় তার সাথে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সুগভীর সম্পর্ক। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

প্রকৃত পক্ষে ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের রয়েছে অনন্য সাধারণ অবদান। যা জাতি চিরদিন গর্বভরে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের অন্যান্য আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের পরিপূরক। কারণ ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগ থেকেই ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় তা পরিপূর্ণরূপ লাভ করে ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র একমাস আগে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ বলেন,

“ভারতে যেমন হিন্দী রাষ্ট্র ভাষা হতে চলেছে
পাকিস্তানে তেমনি রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হওয়া উচিত।”

এ কথার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসাবেই বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাস পরে করাচীতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ খবর ঢাকায় পৌঁছালে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আর এটিই ছিল রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে প্রথম সভা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল হক ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ২ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন’। এ পরিষদ ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘটের সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেক ছাত্র আহত হন এবং অনেকে গ্রেফতার হন। 

প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।’ এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ধর্মঘট পালন করে। এ দিন ‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করতেই হবে’ এ দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গণপরিষদের সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় ‘যতদিন বাংলা ভাষা পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন থেকে বিরত থাকবে না।’ এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও মিছিলের কর্মসূচী ঘোষণা করে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের ডাক দেয়ায় সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। 

কিন্তু ২১শে ফেব্রয়ারি সকাল থেকেই ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগের অধীনে) ছাত্র জমায়েতে উপস্থিত হয়। এ ছাত্র জমায়েতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানে পরিকল্পনা করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের দশজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ জন করে ছাত্ররা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে ২/৩টি দল এগিয়ে গেলে তাদের উপর পুলিশ হামলা চালায়। ফলে কৌশল পরিবর্তন করে শুধু ছাত্রীদের মিছিলে পাঠান হয়। এ মিছিলেও পুলিশ হামলা করে এবং অনেককে গ্রেফতার করে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এরপর পুলিশ কোন প্রকার হুঁশিয়ারি না করে মিছিলে গুলি চালায়। এ গুলিতে শহীদ হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত। অন্য এক সূত্রে জানা যায় এদিন ৮ জন ছাত্র নিহত হন এবং আহত হন ২০০ জন। এ ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। এত আন্দোলন সংগ্রাম আর রক্তঝরার পর কোন উপায় না পেয়ে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে প্রতি বছর পালন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। সময়ের আবর্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে পালন করছে সারা বিশ্ব। যার গৌরব শুধুই আমাদের।

তথ্য সূত্রঃ- 
১) বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-রঙ্গলাল সেন। 
২) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-এম,এ বার্ণিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইতিহাস


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইতিহাস

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ১০: ১৫, ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসন আমলের পূর্বে ভারতবর্ষ প্রায় সাড়ে পাঁচশ' বছর মুসলিম শাসনামলে ছিল। এ সময় ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন শিল্পশৈলীসহ মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন শত শত মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তেমনি পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণশৈলী, কারুকার্য ও নান্দনিকতায় মসজিদটি অনন্য। মসজিদটির তিন দিকে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ। মসজিদের পিছনের দিকে রয়েছে সবুজের সমারোহ বৃক্ষারাজি দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদে ওজুখানার ব্যবস্থাটিও চমৎকার।

মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর: তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড.ওসমান গনি ও অন্যান্য প্রফেসরের উপস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মসজিদটির ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসের এক শুক্রবার উদ্বোধনের পর মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি মসজিদের মধ্যে এটি সেন্ট্রাল। ৫ বিঘা জমির ওপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত।

মসজিদে দু'টি মিনার, ভিতরে রয়েছে গোলাকার বেশ কিছু পিলার, কারুকার্য খজিত দরজা-জানালা, ঝাড়বাতি নয়টি, আলমারি ২টি। আলমারিতে রয়েছে কোরআন-হাদিসের প্রায় দু'শ অমুল্য বই। মসজিদের ভিতরে ২৩ লাইন (কাতার)এ নামাজে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন মুসুল্লী দাঁড়াতে পারেন। এছাড়া মসজিদের বারান্দার অংশে রয়েছে আরো ১০টি কাতার। সেখানেও প্রতি কাতারে ৭৫-৮০ জন দাঁড়াতে পারে। প্রতি শুক্রবার মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার মুসলিস্নর সমাগম হয়। 

আমল ও শিক্ষাদান: মুয়াজ্জিন মাওলানা মোঃ শাহ আলম জানিয়েছেন, সপ্তাহে ছয়দিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বাচ্চাদের ফ্রি কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। শুক্রবার বাদ আছর তাবলীগ জামায়াতের বয়ান(গাস্ত) হয়। এছাড়া তাবলীগ জামায়াতের শিক্ষক-ছাত্রদের সমন্বয়ে রবিবার বাদআছর থেকে মাগরিব এই মসজিদে পর্যালোচনা মুলক আলোচনা হয়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজার: "মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই"-বিদ্রহী কবি আশা করেছিলেন-তাঁর কবরের পাশ দিয়ে নামাজী ভাইয়েরা যাবেন, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি তিনি কবরে শুয়ে শুনতে পাবেন।তাতেই তাঁর কবর আজাব থেকে রেহাই পাবেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথাগুলো যেন আল্লাহ কবুল করেছেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়েছে। মসজিদের পাশে আরো কবর দেয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড.ওসমান গনি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, চারুকলার শিক্ষক কামরুল হাসানসহ স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের। যার কারণে গোটা দেশের মানুষ এই মসজিদটি সম্পর্কে ভিন্ন রকম আকর্ষণ অনুভব করে থাকে।

বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন ড.শমসের আলী, ড.আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ আহমদ খান, ডএবিএম হাবিবুর রহমান চৌধুরী, ড.শহীদ উদ্দিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। দিন দিন মুসলিস্নদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শুক্রবার ও ঈদে মুসলিস্নদের সমাগম বেশি ঘটে। ফলে রাস্তায় নামাজ পড়তে হয়। কার পার্কিং-এর জায়গা নেই। মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করা খুবই জরুরি। 

আমি কথা বলি-মসজিদের সদস্য সচিব ও খতিব হাফেজ মাওলানা খলিলুর রহমান সাহেবের সাথে। তিনি বলেন-"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি ১৯৭৭ সাল থেকে এ মসজিদের খতিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার সৌভাগ্য যে,আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব হতে পেরেছি। এ মসজিদের মুসুল্লিরা অনেক উচ্চ শিক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী আমার মসজিদের মুসুল্লী।

ইমাম হাফেজ মাওলানা নাজির মাহমুদ বলেন-"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এ মসজিদের ইমাম হতে পেরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্র ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত কৌতুহলী মুসলমানগণ এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মসজিদের খাদেম আব্দুল মালেক, শফিউল্লাহ শিকদার ও মোঃ তারা মিয়া দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের খাদেমের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে অসম্পূর্ণ আলাদা। এটা আমাদের চেতনার প্রতীক।এ মসজিদের সাথে এ দেশের অনেক ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ মসজিদ '৬৯'র গণঅভু্যত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তিত্ব ড.মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদটি এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী, শহীদ মিনার, শিশু পার্ক ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারসহ নানান স্থাপত্য রয়েছে যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আমাদের লক্ষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদটিকে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় একটি মসজিদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে বিভিন্ন দেশের কৌতুহলী মানুষ মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন। আমরা ছয় তলাবিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ জন্য আমরা মসজিদের নান্দনিক ডিজাইন আহবান করছি। বিভিন্ন ডিজাইনার ডিজাইন করছে। ডিজাইন বাছাই সম্পন্ন হলে সরকার ও বিদেশীদের কাছে মসজিদ নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করা হবে। ইতিমধ্যে এ মসজিদটি নির্মাণের ব্যাপারে সৌদি ও ইরান সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। 

বর্তমান কমিটি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী: মসজিদ পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নিবেদিতপ্রাণ কমিটি। কমিটির সদস্যরা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত ও জ্ঞানী-গুণী। সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড.মিজানুর রহমান, সদস্য সচিব- মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা খলিলুর রহমান, সদস্য- চীফ ইঞ্জিনিয়ার আমির হোসেন, ডঃইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া, পরিচালক,হিসাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

চল্ চল্ চল্’ রণসঙ্গীতের মহাশ্মশান বনাম গোরস্তান


চল্ চল্ চল্’ রণসঙ্গীতের মহাশ্মশান বনাম গোরস্তান

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ০১: ৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

‘চল্ চল্ চল্’ রণসঙ্গীতের মহাশ্মশান বনাম গোরস্তান

ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী মুসলমানের মৃতদেহ শায়িত রাখা হয় গোরস্তানে, হিন্দু মৃতদেহ চিতায় ভস্ম করা হয় শ্মশানে। বিতর্ক হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্’ রণসঙ্গীতের ‘গোরস্তান’ এবং ‘মহাশ্মশান’ শব্দ নিয়ে।

গোরস্তান মুসলমানের হলে হিন্দুর হবে শ্মশান, মহাশ্মশান হবে কেন? এখানে মহাশ্মশান শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সচেতন নজরুল সচেতনভাবেই মহাশ্মশান শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তাঁর রচিত বিখ্যাত রণসঙ্গীতে। যে মহাশ্মশানে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ বা বৃটিশ রাজত্ব। নজরুল সেই মহাশ্মশানকে সজীব করতে চান। ‘তাজা-বতাজার’ গান গেয়ে হিন্দু-মুসলমানকে অতীত গৌরবে উজ্জীবিত করতে চান। বাহুতে নবীন বল সঞ্চয় করে ইংরেজ তাড়িয়ে ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে চান। এজন্য আহবান করেন ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দলকে। হতে পারে এই মহাশ্মশান পলাশীর প্রান্তর অথবা পানি পথের তৃতীয় যুদ্ধের প্রান্তর। যেখানে দু’টি বীর গোষ্ঠী (হিন্দু-মুসলমান) আদিম জিঘাংসা নিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। সুযোগ করে দিয়েছিল ইংরেজদের রাজ্য প্রতিষ্ঠায়।

তবে হ্যাঁ, একথা আজ ধ্রুব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কি নজরুলের জীবদ্দশায়, কি জীবনান্তে চক্রান্ত চলেছে এবং চলছে তাঁর রচনার নানান বিকৃতির- কি শব্দে কি বাণী বিন্যাসে। নজরুল গবেষক শ্রদ্ধেয় শেখ দরবার আলম তাঁর দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় "নজরুলের কবিতার আদি লেখা পান্ডুলিপি"র একটি লেখায় উদ্ধৃতিটির উল্লেখ করেছেন “তাজা-বতাজার” গাহিয়া গান’।। এখন হয়েছে ‘নব-নবীনের গাহিয়া গান’, ‘নতুনের গান’ শিরোনামের স্থান দখল করেছে ‘চল্ চল্ চল্’।

বর্তমানে নজরুলের লেখা কবিতা-গানের কিছু কিছু শব্দের সংস্কার করা হচ্ছে সচেতন ভাবে এবং তা বাংলা একাডেমীর তত্বাবধানেই। আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত ব্যান্ড সংগীত শিল্পী(মাকসুদ) একটি রবীন্দ্র সংগীতের সুর বদল করে গান করেছিলেন। সেই অপরাধে সেই শিল্পীকে বয়কট করার জন্য রামেন্দু মজুমদার, কলিম শরাফীদের নেতৃত্বে কথিত সুশীল সমাজ প্রায় জাতীয় আন্দোলন করেছিলেন। অথচ, আমাদের "জাতীয় কবি" নজরুলের গানের, কবিতার বিকৃতি নিয়ে কারো কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত নেই! ‘নওবাহার’ পত্রিকার মত নজরুল কাব্যের শুদ্ধিকরণ কিংবা নজরুল কাব্যের পাকিস্তানি সংস্করণের মতো কোনো সংস্করণের চিন্তা যেন আর কোনোদিন না জাগে কারো মনে, আমরা যে কোনো মূল্যে নজরুল সাহিত্যকে অবিকৃত রাখবো এই হোক নজরুল সাহিত্যের প্রতি আমাদের অনুরাগের প্রথম অঙ্গীকার।

ভিক্ষুকের হাতকে কমর্ীর হাতে রূপান্তর করতে হবে


ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে হবে

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ১২: ১৮, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ভিক্ষুকের হাতকে কমর্ীর হাতে রূপান্তর করতে হবে

সবাই প্রকৃত ভিক্ষুক নয়। কেউ সামান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে, কেউ আবার প্রতিবন্ধী সেজে, কেউ নেশা বা পেশা হিসেবে বিনা পুঁজিতে বাড়তি আয়ের মাধ্যম হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছে। আবার কেউ কেউ কোনো কোনো প্রতিবন্ধীকে দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে নিজে ভোগ করছে। বাসা-বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে যারা কাজ করে তাদের কোলের শিশুকে অনেক সময় কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকে। আবার দেখাশোনার লোকের অভাবে বাসায় রেখে যাওয়াও সম্ভব নয়। তখন তারা কোনো ভিক্ষুকের কাছে তাদের বাচ্চাকে ভাড়া দিয়ে যায়। প্রকৃত ভিক্ষুক যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে কে যে প্রকৃত ভিক্ষুক আর কে ভিক্ষুক সেজেছে_ এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সাজানো ভিক্ষুক ভিক্ষার বাড়তি আয় দিয়ে আরাম-আয়েশ করছে আর প্রকৃত ভিক্ষুক ভিক্ষা না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এদেশের দানশীল, সংবেদনশীল মানুষ কিন্তু ভিক্ষাখাতে কম দান করছেন না। তবে প্রকৃত ভিক্ষুকদের হাতে সেই দান না গিয়ে ভিক্ষুক ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত ভিক্ষুকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অর্থনীতির ভাষায়, ভিক্ষুকদের কাজ হচ্ছে অনুৎপাদনশীল। এতে ভিক্ষুক নামের শ্রমিকের শ্রম অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে ভিক্ষুক সারাজীবনই ভিক্ষুক থাকবে, তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। একটি সংস্কৃত শেস্নাক হচ্ছে_ 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, তদর্ধং কৃষি কর্মণি তদর্ধং রাজ সেবায়ং, ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ।' এর সরল বাংলা হচ্ছে_ ব্যবসা-বাণিজ্য করলে সহজেই সম্পদশালী হওয়া যায়, কারণ হিন্দুমতে লক্ষ্মী হচ্ছেন ধন-সম্পদের অধিষ্ঠাথর্ী দেবী; এর অর্ধেক সম্ভাবনা রয়েছে কৃষিকাজে ও একচতুর্থাংশ সম্ভাবনা রয়েছে সরকারি চাকরিতে; তবে ভিক্ষাবৃত্তিতে কিছুই নেই। ভিক্ষুকের সংসারে কোনোদিনই সচ্ছলতা আসে না।

কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে জনগণের কল্যাণে, রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করা। বাংলাদেশ সরকারও কল্যাণ রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে বয়স্কভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাভাতা, শিক্ষাভাতা, ভিজিএফ কার্ড, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা, কৃষিতে ভতর্ুকি ইত্যাদি নানা কর্মসূচি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে আর্থিক ব্যয় হচ্ছে সে সব ব্যয় সরকার জনগণের কাছ থেকে যে ট্যাক্স-ভ্যাট পান তা দিয়ে এবং বিদেশি সাহায্য ও ঋণ বাস্তবায়ন করে থাকেন। সরাসরি জনগণের কাছ থেকে সংশিস্নষ্ট খাতে কোনো ট্যাক্স নেন না। কিন্তু ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকার উদ্যোগ নিলে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ট্যাক্স আদায় করতে পারবেন।

ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনে দাতা সংস্থা এবং সরকার যা করতে পারেনেঃ

১) সংসদে ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ ও ভিক্ষুক পুনবার্সন আইন পাস করে ব্যক্তিগতভাবে ভিক্ষা গ্রহণ ও ভিক্ষা প্রদান আইনত নিষিদ্ধ করে ভিক্ষা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদান এবং প্রকৃত ভিক্ষুকের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। শুধু এই আইনের ফলে বিনা পুঁজির এ ব্যবসা থেকে ৬০/৭০ ভাগ ভিক্ষুক আপনাআপনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাবে। বাকি প্রকৃত ৩০/৪০ ভাগকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, ভিক্ষুকভাতা দিয়ে, যারা একেবারে অক্ষম তাদেরকে আজীবন রাষ্ট্র কর্তিক রাষ্ট্রের দায়িত্বে রেখে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। একেবারে অক্ষমদের রাষ্ট্রের দায়িত্বে না রাখলে এদের ভাতা অন্যরা খেয়ে ফেলবে।

২) ভিক্ষুকদের একটি জরিপ করতে হবে। জরিপকালে ভিক্ষুকদের লিঙ্গ, বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, পোষ্য আছে কি না, থাকলে তাদের তথ্য, শারীরিক, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কি না, থাকলে কী রকম প্রতিবন্ধী, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, ভিটেবাড়ি আছে কি না ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যাতে সহজেই শনাক্ত করা যায় কাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, কাকে ভাতা দিয়ে কাকে আজীবন ভরণপোষণ দিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। এই জরিপ কাজ চালানোর জন্য মহানগর, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মাইকিংসহ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডে এক বা একাধিক কেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে, স্থানে ও সময়ে জরিপ কাজ চালাতে হবে।

৩) সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের তালিকা তৈরি করে প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট নম্বর দিতে হবে এবং ক্যাটাগরিভিত্তিক মাসিক/বার্ষিক সর্বনিম্ন ভিক্ষুক কর ধার্য করে দিতে হবে। কোনো দানশীল ব্যক্তি ইচ্ছে করলে যত ইচ্ছে এই তহবিলে দান করার সুযোগ রাখতে হবে। এই কর যাতে মোবাইল ম্যাসেজ, স্থানীয় ডাকঘর, ব্যাংকের শাখায় সহজেই জমা দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকেন না তাঁদের জন্য আলাদা নম্বর দেয়া যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় যাঁতে কেউ বাদ না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর ফলে ভিক্ষা দেবার সঙ্গতিসম্পন্ন সবাই ভিক্ষা দেবার সঙ্গে জড়িত হবেন। অন্যদিকে রাস্তাঘাট, বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যস্ততম সময় ও স্থানে ভিক্ষুক বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

৪) যে সব ভিক্ষুকের নিজস্ব ভিটাবাড়ি আছে তাদেরকে তার ভিটাবাড়িতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের ভিটাবাড়ি নেই তাদেরকে গুচ্ছগ্রাম বা অনুরূপ কর্মসূচির মাধ্যমে পুনর্বাসন করতে হবে। যারা একেবারে পঙ্গু তাদেরকে হোস্টেলের মতো বহুতল ভবন নির্মাণ করে আজীবন ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিভাগে এক হাজার ও অন্যান্য বিভাগে পাঁচশো জনের থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ আইন সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনুৎপাদনশীল শ্রম উৎপাদনশীল শ্রমে পরিণত হবে। ভিক্ষুকের হাত কর্মীর হাতে রূপান্তরিত হবে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কোমলমতি ভিক্ষুক শিশুরা বাধ্য হয়ে বিদ্যালয়ে যাবে। ফলে নিরক্ষরতা দূর হবে। ভিক্ষুকরা গ্রামে-গঞ্জে পুনর্বাসিত হলে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে।

শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ


শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৯: ২৫, ০৪ মার্চ, ২০১১

শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ

“শিশুশ্রম অবসানকল্পে দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু বিষয়ক রাওয়ালপিণ্ডি ঘোষণার অন্যতম সমর্থক ও স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সমর্থন আর স্বাক্ষর শুধু কাগজেই রয়েছে। বাস্তব চিত্র তার উল্টো। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় গত ২৮ আগস্ট ছাপা হয়েছিল ১২/১৩ বছরের একটা শিশু টেক্সটাইল মিলে কাজ করছে, তার ছবি এবং সেই টেক্সটাইল মিলস কর্তিপক্ষের সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য। আবার ২০ সেপ্টেম্বর তেরো পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিলÑ আট বছরের একটা শিশু স্কুল বাদ দিয়ে রিকশা চালাচ্ছে, সেই খবর। ২০ সেপ্টেম্বর বারো পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ- “লেহাপড়া হরতে মন চায়। মাছ ধরতে ইচ্ছা হরে না। কিন্তু কী হরমু! মাছ না ধরলে না খাইয়া থাহা লাগে”-এই কথাগুলো ১০ বছরের একটা শিশুর। এইসব শিশুর জন্যই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার না নিয়ে- এরা বড় হচ্ছে দারিদ্র্যের চার দেয়ালের মধ্যে। যেখানে জ্ঞানের আলো দূরে থাক, সূর্যের আলোই পৌঁছে না”-ইহা একটি মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট।

আমি পেশাগতভাবে শিল্প ব্যাবস্থাপনা, শ্রম আইন ইত্যাদি বিষয়ে মোটামুটি ধারনা রাখি। সত্যিকথা বলতে কী-তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুশ্রমিকের আধিক্য থাকলেও উন্নত দেশে শিশুশ্রম দূর হয়েছে এমন ধারণা করা ঠিক না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬%-এর বয়স ১৫ বছরের নিচে।বর্তমানে সরকারী নিয়মে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হলে আমরা ৫০%কেই শিশু হিসেবে ধরতে পারি। এই শিশুদের মধ্য থেকে সর্বাধিক সংখ্যকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কল-কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। অথচ এই শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের গড়ে তোলার ওপরই নির্ভর করবে দেশের উন্নতি অবনতি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার কাজটি কষ্টসাধ্য। কিন্তু কাজটি যতোই কঠিন হোক, ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের কথা চিন্তা করেই শিশুদের অধিকার সংরক্ষণে সবার উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। 

শিশুশ্রম আইনত নিষিদ্ধ হলেও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অধিকাংশ শিশুকে বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। এ কারণে কেবল শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নয়, কর্মক্ষেত্রে শিশুদের নানা রকম অত্যাচার নির্যাতন সহিংসতা ও প্রবঞ্চনার শিকার হতে হয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা প্রায়ই গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর দ্বারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়। অনেক সময় এ নির্যাতনের ফল হাসপাতাল পর্যন্ত গড়ায়। আবার কখনো মৃত্যুও ঘটে। অনেক ঘটনাই সংবাদপত্রে আসে না। 

যৌন কাজে এবং উটের জকি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এদেশের শিশুদের যখন বিভিন্নভাবে পাচার করা হয়, তখন কিন্তু মানবাধিকারের ধারক ও বাহক বলে দাবিদার উন্নত বিশ্বকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। শিশুর অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাসমূহ কর্তৃক সমন্বিত কার্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা অবশ্যক। বাসাবাড়ি, হোটেল, গ্যারেজ ও দোকানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের নির্যাতনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ থাকা উচিত। শিশুদের মৌলিকাধিকার রক্ষার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা জরুরি।সেই সংগে যেদেশের বড় একটি অংশ দারিদ্রসীমার নীচেও মানবেতর জীবন যাপন করছে-সেই দেশে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে ভাবনার সুযোগ রয়েছে।বেঁচে থাকার জন্য ক্ষুণ্ণীবৃত্তির মাধ্যমেও “মানব জীবন” রক্ষা পেলেইনা “মানবাধিকার”এর প্রশ্ন!মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি-তাঁরা মানবাধিকারের পুঁথিগত বিষয়টাকেই শুধু গুরুত্ব দেন-কিন্তু “বাস্তবতা” উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়েছেন।তাঁরা অনেক সময়ই বাস্তবতা নাজেনেই পত্রিকায় নিবন্ধন, সেমিনারে গালভরা বক্তৃতা দিয়েই ‘নিজের অধিকার’ ফলিয়ে কৃতিত্ব জাহির করেন।

আমার লেখার শুরুতেই ১২/১৩ বছরের যে শিশুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে (শিশুটির নাম বাবুল মিয়া)-সেই প্রসংগে আমার কিছু বলার আছে। আলোচ্য শিশুটির বয়স ১২/১৩ বছর নয়-শিশুটির বয়স ১৭ বছর। শিশুটির পিতা মোঃ মাসুদ মিয়া সেই টেক্সটাইল মিলেরই মাস্টাররোলে কর্মরত একজন অদক্ষ অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে মাত্র ৪ মাস কাজ করেছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিক মাসুদ মিয়া মৃত্যু বরন করলে লেবার ‘ল অনুযায়ী মালিক পক্ষ কর্তিক ঐ শ্রমিক কোনো প্রকার আর্থীক সুবিধা প্রাপ্তির অধিকারী নন।তারপরেও সম্পুর্ণ মানবিক কারনে মাসুদ মিয়ার বিধবা স্ত্রীর হাতে টেক্সটাইল মিলের তিনজন মালিকের ব্যাক্তিগত সহায়তায় ১ লক্ষ টাকা দান করেন।মাসুদ মিয়ার পরিবারের উপযুক্ত কাউকে চাকুরী দেবারও আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।পরে মাসুদ মিয়ার বেকার, শুধু মাত্র নাম দস্তখত করতে জানা বড় সন্তান বাবুল মিয়া চাকুরীর জন্য যোগাযোগ করলে শুধুমাত্র মানবিক কারনে তাকে “মেশিন ক্লিনার হেল্পার” হিসেবে চাকুরী দেয়া হয়।সেই সংগে মাসুদ মিয়ার নিরক্ষর বিধবা স্ত্রীকে টেক্সটাইল মিলস’র একজন পরিচালকের মায়ের নামে পরিচালিত সম্পুর্ণ ব্যাক্তিগত ব্যায়ে পরিচালিত ইয়াতীমখানায় “আয়া” পদে চাকুরী এবং বাসস্থানের ব্যাবস্থা করাহয়।বর্তমানে বাবুল মিয়া এবং তার মায়ের উপার্জনেই ওদের ৫ সদস্যের পরিবার বেশ ভালোভাবেই চলছে।এই খবরটি উপড়ে বর্ণিত প্রথম প্যারায় যে মানবাধিকার নেতা লিখেছিলেন-তিনি সব যেনেও ভালোটুকু এড়িয়ে গিয়েছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে!

মুক্তিযুদ্ধঃ কি চেয়েছি, কি পেয়েছি!


মুক্তিযুদ্ধঃ কি চেয়েছি, কি পেয়েছি!

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৯: ১৭, ১৯ মার্চ, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধঃ কি চেয়েছি, কি পেয়েছি!

১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের যাবতীয় নির্মমতার মধ্যে দিয়ে আমরা একটি নতুন দেশ পেয়েছি।আমরা দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি, জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়েছি। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশ। বাংলাদেশী বাঙালি জাতিসত্তার একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যার ফলে, বিশ্বের কাছে আমাদের বাংলা ভাষা ও জাতিসত্তা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।জাতিসংঘে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। আমাদের আরো প্রাপ্তি হলো স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে একটি দেশের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছি। গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে এবং আমাদের কছু সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড আছে। যার ফলে আমাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি একটি অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছি।

আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে সার্বভৌমও পেয়েছি(যদিও সংবিধান বিরোধী তথাকথিত ‘শান্তি চুক্তি’র আওতায় স্বার্বভৌমত্ব যায়যায় করছে), নিজেদের মতো করে রাজনীতি করার অধিকার এবং সুযোগ পেয়েছি(এখন এই অধিকার শুধু শাসক দলেরই আছে); দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে অবহেলা করে দল কেন্দ্রিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের লাগামহীন স্বাধীনতা(!)পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা স্বাধীন একটি রাষ্ট্র পেয়েছি-কিন্তু সাধারন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা এখন রুদ্ধ। এর জন্যে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এং আরো অনেক মূল্য দিতে হবে। 

যা আমরা পাইনি তা যদি সরাসরি বলি-তার অর্থ হলো একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র আজও পাইনি। আমরা সাধারণভাবে জনগনের রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা হলো ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থা থেকেও কয়েক ধাপ পিছিয়ে, যার জন্য আমরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেশি দূর এগোতে পারিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কতগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছি, যেমন স্বাধীন বিচার ব্যাবস্থা, সম অধিকারের নুন্যতম নিশ্চয়তা। সে জন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা দুর্বল করেছি, বিকৃত করেছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা চলে জাতীয় সংসদকে আমরা নুন্যতম কার্যকর করতে পারিনি। আরও কিছু গুরুত্বপুর্ণ সুযোগ সেগুলো কাজে না লাগাতে পারায় মানুষের কল্যাণকর অনেক কিছুই করতে ব্যার্থ হয়েছি। যেমন, রাজনীতিবিদদের সুস্থ্য রাজনীতি নাকরা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত করা,এক দলীয় গণতন্ত্র কায়েম করা, বিশাল যুবসমাজকে যথাযথ ব্যাবহার করতে নাপেরে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে একটা আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চরম ব্যার্থতা।


আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এতোদিনেও উন্নত হয়নি। ছাত্র সংখ্যা,পাশের সংখ্যা অবশ্য বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান আশানুরূপ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ, মানবিক-মানষিক মুক্তিতো আজও পাইনি। আমরা কিছু কিছু পশ্চাৎপদ ধারণা লালন করি যার ফলে দেশে দারিদ্র্য এবং অসহায়দের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়েছে। এর অভিশাপ থেকে কবে মুক্তি পাবো জানি না।স্বধীন বিচার ব্যাবস্থার নামে যা পেয়ছি তাশধু লজ্জা জনকই না-অত্যন্ত ঘৃণা আর উপহাসের বিষয়! আমরা চেয়েছিলাম সত্যিকারের গণতন্ত্র এবং মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যেখানে ঘটবে অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি-কিন্তু এগুলো আমরা আদৌ পাইনি। আমাদের মাথা-পিছু গড় আয় হয়তো বেড়েছে কিন্তু সেই আয়ে কি সৎ ভাবে জীবন যাপন সম্ভব?

কি পাইনি বললে আরো বলতে হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ আন্তরিকতা, আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা, সামাজিক নেতৃত্বের উন্নয়নমুখী দৃঢ়তা এবং ব্যবসায়ীক নেতৃত্বের সাহসী সততা। আরও কি পাইনি, তার তালিকা অতি দীর্ঘ কেবল দু’একটি মাত্র উল্লেখ করতে চাই। পৃথিবীর বুকে আরও দশটা দেশের নাগরিকদের মতো ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে সম্মান পাইনি, মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গঠনমূলক সম্মান পায়নি, দারিদ্রতা ধনীদের আন্তরিক সহমর্মীতা পায়নি যার ফলশ্রুতিতে পাইনি বলিষ্ঠ জাতীয় নেতৃত্ব। যেটা এত দুঃখের মধ্যে পেয়েও গর্বিত থাকি সেটা হচ্ছে একটি গণমুখী, উন্নয়নমুখী, শৃংখলামুখী, সংবিধানমুখী সামরিক বাহিনী(যদিও এখন এবিষয়েও সাধারন মানুষের মনে দ্বিধা দন্দের অবকাশ আছে)।পাইনি বুদ্ধিজীবী মহলের দেশ গঠনমূলক সমালোচনা ভিত্তিক মমত্ব। পেয়েছি সুবিধাবাদী মিডিয়া, পাইনি দেশ ও জাতি গঠনমূলক একতাবদ্ধ মিডিয়া। পেয়েছি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, পাইনি ঐতিহ্য রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার।

আমাদের রাজনীতি যেন স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়। রাজনীতি যদি স্বাধীনতাকে আত্মীকরণ করতে না পারে, তবে সে রাজনীতি জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং এক্ষেত্রে জাতীয় সংকট তৈরি হয়, জাতিসত্তার সংকট তৈরি হয়। স্বাধীনতার অন্তর্গত শক্তি ও আবেদন যেন আমাদের সব সময় উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা যেন জাতিগঠনে উদ্বুদ্ধ হই। মুক্তিযুদ্ধ যেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রতীক হিসাবে কাজ করে। রাজনীতির নানা মত ও পথ, বিরোধ ও ঐক্য যেন স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী না হয়। স্বাধীনতার চেতনা, ত্যাগ, আগুন ও অশ্রুপাত, ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যেন আমাদের দেশ গড়ার কাজে এক এবং একাকার হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব যেন কোনোভাবেই বিপন্ন না হয়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, স্বাধীনতা বিরোধীদের অপতৎপরতা যেন আমাদের রাজনীতি , অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। জাতীয় প্রেরণার অবিনাশী উৎস স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনা থেকে আমরা যেন বিচু্যত না হই।

পেয়েছি যুদ্ধ বিজয়, পাইনি বিজয়কে অর্থবহ করার দৃঢ় নেতৃত্ব আর সামাজিক-রাস্ট্রীয় অঙ্গীকার।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।


মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ০১: ০২, ১২ মার্চ, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।

"এই জাদুঘর বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ এবং ধর্ম-জাতিসত্তা ও সার্বভৌমত্বের নামে নৃশংসতার শিকার সকল মানুষের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আদর্শিক ভিত্তিসমূহ অর্জনের জন্য দেশবাসীর ত্যাগ ও বীরত্বের ঘটনাবলি হৃদয়ঙ্গম করতে উৎসাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই ইতিহাসের আলোকে চলমান সামাজিক সমস্যা ও মানবাধিকারের বিষয় বিবেচনায় সচেষ্ট রয়েছে।"

দ্বাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও স্বাধীনতা উৎসবের ব্রুসিয়ারে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের লক্ষ্যসমূহ সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। রাজধানীর ৫ সেগুনবাগিচায় ছিমছাম ছোট্ট একটি তিনতলা বাড়ি। কিন্তু আকর্ষণ চুম্বকের চেয়েও শক্তিশালী। বাঙালির ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম আর ত্যাগের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত চেতনায়। বাড়ির একটি কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে মুছে যাবে বর্তমানের গ্লানি। মন চলে যাবে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রাচীন বাংলায়। এরপর মনের মধ্যে ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে বাঙালির এগিয়ে চলার ইতিহাস। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের ছবি ও ইতিহাস মনকে আন্দোলিত করবে। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস মনকে সাময়িক ব্যথিত করলেও, গর্বে ভরে উঠবে মন। এই জাদুঘরটি ভালো করে দেখলে জীবন পাল্টে যাবে। ঠিক ওয়াশিংটনের হলোকাস্ট মিউজিয়ামের প্রবেশ দ্বারে লেখা "গভীর বিষাদের স্থানে এ যেন উজ্জ্বল আশাবাদের আশ্রয়" বাণীটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। এখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, বই, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, তথ্য, স্মৃতি সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন। বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত বিভেদের নামে নৃশংসতার শিকার সকল মানুষের উদ্দেশে উৎসর্গিত হয়েছে এ জাদুঘর। মুক্তি ও স্বাধীনতার স্পৃহায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মানুষই যে পারে সকল বাধা বিপত্তি দূর করে এগিয়ে যেতে তারই প্রমাণ মেলে ধরেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও দলিলপত্রাদি সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যা দেশে নতুন প্রজন্ম পূর্ব পুরুষদের সংগ্রাম এবং দেশের জন্য তাদের মহৎ আত্মত্যাগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে। দেশ ও জাতি সম্পর্কে তাদের চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াস পাবে। জাদুঘরের প্রবেশ পথেই রয়েছে শিখা চিরন্তন। এ শিখা জ্বলছে পৃথিবীর সেই সব মানবদের উদ্দেশে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার জন্য। এ শিখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পৌঁছে দেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাঙালির অতীত, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ছয়টি গ্যালারিতে উপস্থাপন করেছে।

প্রথম ও ২য় গ্যালারিতে বাংলার অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা থেকে স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের সংগ্রামের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আছে মহৎ বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের একটি মূর্তি। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে রাজা কল্যাণ শ্রী ও রাণী প্রভাবতীর মধ্যমপুত্র চন্দ্রগর্ভ জন্মগ্রহণ করেন। ভিক্ষু হওয়ার পর তার নাম হয় অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ভারতবর্ষে বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও দন্তপুরী, সামপুরী ও বিক্রমশীল বিহারে অধ্যাপনা ও পরিচালনা করার সময় তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে অতীশ দীপঙ্কর দেহভস্ম ও রচিত গ্রন্থের পান্ডুলিপি চীন থেকে ঢাকায় ধর্মরাজিক বিহারে আনা হয়। সেই পান্ডুলিপির একটি সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে।

তৃতীয় গ্যালারিটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ, ১৯৭১ এর উদাত্ত আহ্বানের উদ্দেশে। এ আহ্বান ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামের ডাক। এর মাধ্যমে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জনতার অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাসনে "এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম" অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ২৬/২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার উপস্থাপন, ২৫ মার্চ কালরাত্রির ভয়াল চিত্রের অপুর্ব উপস্থাপন রয়েছে। ছবি, পেপার কাটিং এবং অন্যান্য তথ্যাদির মাধ্যমে লাখ লাখ শরণার্থীর দুর্গতির চিত্রও রয়েছে। তাদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেরও কয়েকটি ছবি আছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায় উঠার সময় দর্শকরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালীন কিছু ছবি দেখতে পারবেন। এর মধ্যে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সদস্যভুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক প্রতিরোধ। পাকবাহিনীর সংগঠিত নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞের প্রমাণাদি বারান্দায় বিভিন্ন পেপার কাটিং এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। রয়েছে অসংখ্য গলিত বিকৃত লাশের ছবি। এ গ্যালারিতে প্রদর্শিত ভাগ্যক্রমে পাকসেনাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের আর্তি মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেবে। বালুঘাটের পাকসেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের পাশে দুটি শিশু বসে আছে। তারা জানে না তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কি-না কিংবা কিছুক্ষণ পর তারা নিজেরাও বেঁচে থাকবে কি-না। এ ছবির কথা ভোলার নয়!

চতুর্থ গ্যালারিতে আছে কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির ব্যবহৃত জিনিস। এরা পাকবাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা ও প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও দলিলাদি রয়েছে এতে। রয়েছে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ব্যবহৃত সামগ্রী। ব্যালকনিতে আছে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র। সেক্টর কমান্ডার এবং আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান যোদ্ধাদের ছবি সম্বলিত বিস্তারিত বিতরণ দেয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পতাকা, যা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। ৫নং গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের সাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার, নৌকমান্ডো, বিমান বাহিনী, নারী সমাজ, বৈদেশিক সমর্থ বিশেষ করে ভারতীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রতিচ্ছবি। ৬নং গ্যালারি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সর্বশেষ কক্ষ। দর্শক এখানে একাত্তরের পরম ত্যাগ ও বেদনার দংশন অনুভব করবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে হারানো দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের চিত্র এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। আরও রয়েছে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে আমাদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের পরিচয়।

সবশেষে রয়েছে আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীসহ পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র এবং তাদের কাপুরুষোচিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন। ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে মিরপুর ১২নং সেকশনের ডি ব্লকে নূরী মসজিদ সংলগ্ন মুসলিম বাজার বধ্যভূমির একটি পরিত্যক্ত কুয়া থেকে মাথার খুলিসহ পাঁচ শতাধিক হাড় উদ্ধার করা হয়। একই বছর মিরপুর ১০নং সেকশনের ডি ব্লকের ১নং এভিনিউতে জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫৩৯২টি ছোট-বড় হাড় পাওয়া যায়। এসব হাড় এ গ্যালারিতে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বেশিরভাগ স্মৃতিচিহ্ন দিয়েছেন শহীদদের স্ত্রী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। শহীদ ড. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেছেন তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। রোকাইয়া হাসিনা তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শহীদ রাশিদুল হাসানের ব্যবহৃত কলম সীল, স্যুট ও আলোকচিত্র জাদুঘরে জমা দেন। শহীদ ডাক্তার আতিকুর রহমানের মেয়ে মিমি রহমান তার বাবার ব্যবহৃত একটি কোর্ট ও একটি টুপি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সংগৃহীত উপকরণ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

বর্তমানে জাদুঘরে সংগৃহীত স্মারক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪১৭টি। এর মধ্যে ৮০০টি আলোকচিত্র, ৫০৬টি দলিলপত্র, ৫০০টি পত্রিকা কাটিং, ৬৬৫টি অন্যান্য স্মারক। এগুলোর মধ্যে ৩১০ আলোকচিত্র, ৮৪টি দলিলপত্র, ২২৭ পত্রিকার কাটিং এবং ৪৭০টি বিভিন্ন স্মারক গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাকিগুলো সংরক্ষণাগারে সযতেœ রক্ষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই জাদুঘরটি সম্মানজনক আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংস্থা আমেরিকান এসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের সদস্য পদ লাভ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি লিফলেটের শিরোনামে লেখা হয়েছে "সত্যের মুখোমুখি হোন ইতিহাসকে জানুন"। হ্যাঁ, বর্তমানের ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে বাঙালির বীরত্বগাঁথা দেখে আসুন। জানুন বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তির ইতিহাস।