বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

চায়নার ডায়েরী-১১



চায়নার ডায়েরী-১১
নানটং-নানজিং-কুনমিং-ঢাকা
০৩-০৪/৯/২০০৭ইং 

আমি রাতে যখন সেহরী খেতে উঠি(রাত সারে তিনটা) তখোন পর্যন্ত সাইফুডিং নাইট ক্লাব থেকে ফেরেনি। ভোর ৫ টায় ফজর নামাজ পরে ওর রুমের সামনে গিয়ে দেখি তখনো ফেরেনি। আমি অপেক্ষা করছি কখন ফিরবে.........ঠিক সেই মুহুর্তেই বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে সাইফুডিংকে ফিরে আসতে দেখে আমি অন্য দিকে চলে যাই-যাতে আমাকে দেখতে না পায়।

সকাল বেলা ডেনিয়েল পার্সোনালি আমাকে, আমার বৌ বাচ্চা এবং সাইফুডিং কে বেশ কিছু গিফট দিয়েছে। ঠিক সারে ছয়টা আমরা নানজিং এর উদ্ধেশ্যে রওয়ানা করি। আজ ড্রাইভ করছে ডেনিয়েলের ড্রাইভার। আমি ডেনিয়েল পিছনে এবং সাইফুডিং ড্রাইভারের পাশে বসা। সাইফুডিং এবং ডেনিয়েল দুজনের চোখেই ঘুম! ডেনিয়েল জোড় করে আমার সাথে কথা বলার চেস্টা করছে।

নানটং এয়ারপোর্ট খুব বেশী বড় না। এখান থেকে ২৪ টা ডমেস্টিক রুটে ফ্লাইট যাওয়া আসা করে। কিন্তু কুনমিং কোন ফ্লাইট যায়না। তাই আমাদের নানটং থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দুরে নানজিং আসতে হয়। আমরা নয়টার আগেই নানজিং এয়ারপোর্ট চলে আসি। ওখানে আমাদের জন্য আগে থেকেই রিচার্ড ওয়াং, ভিকি অপেক্ষা করছিলো। ওরা আমাদের জন্য অনেক গিফট নিয়ে এসেছে। আমার বৌ এর জন্য কিছু জুয়েলারী দিয়েছে মিসেস ওয়াং। সাইফুডিং এর বাচ্চার জন্য বেশ কিছু টেডিবিয়ার এবং টয়।আমার জন্য অনেকগুলো গ্রীন টি প্যাকেট, বাচ্চাদের জন্য নানান রকমের ক্যাটবেরী এবং ডোভ চকোলেট।এই চকোলেটগুলো বৃটিশ কিন্তু চায়নাতেই ফ্যাকটরী। আমারা দুজনে অনেক গিফট পেয়েছি-যাতে করে আলাদা একটা লাগেজ হয়েছে! জানি এই সব গিফট নিয়ে আমাদের জিয়াতে কাস্টমস কর্তিপক্ষ ঝামেলা করবেই।

আমাদের এই ফ্লাইট ডাইরেক্ট কুনমিং যাবেনা। ইতিমধ্যে এই ফ্লাইট সাংহাই থেকে এসেছে। নানজিং থেকে যাবে ফুযিয়ান। তারপর কুনমিং। বেশ ঘুরে যেতে হয়। সময় লাগবে সারে চার ঘন্টা। আমরা নির্দিস্ট সময়ে কুনমিং পৌছি।কুনমিং পৌছেই বুক ভরে নিঃশ্বাশ নিলাম। মনে হলো বাড়ীর দড়জায় এসেছি। একাহ্নে বসেই আমি আমাদের দেশের সুন্দর ঘ্রান পাচ্ছি-যে ঘ্রানটা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাইনা!আমি জানিনা আমার মায়ের শরিরের ঘ্রান কেমন ছিল! আমার ধারনা আমার মায়ের শরিরের ঘ্রানটাই আমি আমার মাতৃভুমিতে অন্তর থেকে অনুভব করি।এখান থেকে মাত্র দুই ঘন্টার পথ ঢাকা। খুশীতে আমার মন ভরে গেলো! আহ! ঐতো আমার দেশ!!! কিন্তু আজ আমাদের ঢাকা যাওয়া হচ্ছেনা। কারন আজ ঢাকা যাবার জন্য আর কোন ফ্লাইট নেই। আমাদের ফ্লাইট আগামীকাল সকাল দশটায়।

কুনমিং এ অনেকটাই বাংলাদেশের আমেজ পাওয়া যায়। অনেক শিক্ষিত বাংলাদেশীরা চায়নাতে বিভিন্ন রকম কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।এরা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসে। কিছু দিন চায়না থেকে আবার হংকং চলে যায় ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য।হংকং চায়নার একটা অংশ হলেও আলাদা দেশের মর্যাদা দেওয়া হয়। আগে এই সব অবৈধ বাংলাদেশীরা হংকং বিভিন্ন কাজ করতো। এখন ওখানে খুব কড়াকড়ির জন্য থাকা সম্ভব নয় বলে কুনমিং থাকে এবং বিভিন্ন কাজ করে। কেউ কেউ ব্যাবসাও করে। চায়নীজ সরকার তাড়িয়ে দেয়না-যদি বড় কোন অপরাধ না করে।

এখানে অনেকগুলো বাংলাদেশী রেস্ট/গেস্ট হাঊজ আছে। এনটিভি এবং প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক মিলে বড় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গেস্ট হাঊজ করেছে।নাম দিয়েছে অবসর বাংলা। আমি বেশীর ভাগ সময় কুনুমিং এই অবসর বাংলায় থাকি। অন্য যারা তারাও ফ্ল্যাট ভাডা নিয়ে গেস্ট হাঊজ ব্যাবসা করে। এদের সার্ভিসটাও খুব ভালো। ওদের অনেক এজেন্ট এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঙ্গালী দেখলেই খুব আন্তরিকতার সাথে দৌড়ে আসে। লাগেজগুলো নিজেরাই তূলে নিয়ে ট্যাক্সিতে তুলবে। নিয়ে যাবে গেস্ট হাঊজে।২৪ ঘন্টা থাকা খাওয়া, নাস্তা, এয়ারপোর্ট আপ ডাউন ট্রান্সপোর্ট সহ সিঙ্গেল রুম উইথ এটাস্টড বাথ রুম ১৫০ আরএমবি আর যদি শেয়ার রুম হয় তাহলে নিবে ১০০ আরএমবি। ওখানেও কুমিল্লা হোটেল, জালালাবাদ গেস্ট হাউজ, ভাই ভাই হোটেল এন্ড গেষ্ট হাউজ এবং বিসমিল্লাহ হোটেল আছে! প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশে মোটামুটি বড় এমন কোন স্টেশন নেই যেখানে কুমিল্লা হোটেল, বিসমিল্লাহ হোটেল কিম্বা ভাইভাই হোটেল নেই! আমি পাকিস্তানের করাচী, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাই, জেদ্দা, রিয়াদ, মক্কা-মদীনা শরীফ, কোলকাতা, দিল্লী, আজমীর, বোম্বেতে এমন কি ফ্লোরিডা, নিউইয়র্কেও এই নামের হোটেল/ স্টোর দেখেছি!

রেস্ট হাঊসে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সাইফুদ্দিনকে নিয়ে ওর সৌজন্যে বেড়াতে বের হই। আমরা যাই কুনমিংযের বিখ্যাত রক ফরেস্ট দেখতে। আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে টেক্সীতে যেতে সময় লাগে এক ঘন্টা। ভাড়া ওঠে ১০৮ আরএমবি। রক ফরেস্ট হলো পাথরের বন/বাগান! আমাদের যেমন আছে সুন্দর বন-ঠিক তেমনি কুনমিং এর রক ফরেস্ট। নানান আকৃতির নানান ধরনের পাথর। বিশাল বিশাল এক একটা পাথর গাছের মত উচু! কোনটা সাদা, কোনটা কালো রংযের পাথর। কথিত আছে-কয়েক লক্ষ বছর পুর্বে আগ্নেয়গিড়ির অগ্ন্যুতপাতে এই রক ফরেস্টের সৃস্টি হয়েছিল। চোখে না দেখলে কল্পনাও করা যাবেনা-পাথরের বাগান কেমন হতে পারে! ওখানে প্রচুর বিদেশী পর্যটকের ভীড়। এখানে একটা মজার বিশয় লক্ষ্য করলাম-কিছু লোকের কাছে ছোট ছোট তুলি এবং রংয়ের বোতল। তাদের কাছ থেকে রঙ-তুলি নিয়ে পয়সার বিনিময়ে কেউ কেউ পাথরের উপর প্রেমিক প্রেমিকার নাম লিখে রাখে। আমাদের দেশে যেমন বাথরুম কিম্বা ওয়ালে প্রেমিক প্রেমিকার নাম লিখে রাখে-স্বাতু+কলি অমি+পিয়াল কিম্বা আলী+বেবী টাইপের! আমরা ঘন্টা খানেক পর রেস্ট হাঊজে ফিরে আসি।

আজ আমরা ইফতার করি দেশী স্টাইলে! আমার অতি প্রিয় লেবুর শরবত, পিয়াজু, বেগুনী, ছোলা-মুড়ি দিয়ে! আহ! কি মজা! কি সুখ!! রাতে আমরা ভাত খাই-ছোট চিংড়ি, মিস্টি কুমড়া, ডাটা শাক, করল্লা ভাজী,দেশীিকেন(হাইব্রীড ব্রয়লার নয়), শিং মাছ, গরুর গোস্ত আর ডাল চচ্চড়ী দিয়ে! সেহরী খাই- ছোট চিংড়ি ভূণা, ডিম ভাজা আর ডাল দিয়ে। পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ খাবার হলো আমার বাংলাদেশী খাবার! যদিও কুনমিং এর খাবার আমাদের দেশীয় খাবারের মত মজাদার নয়। কারন ওখানকার বেশীরভাগ স্বব্জী, ফল হাইব্রীড।

পর দিন সকাল দশটার ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ফিরি। বাংলাদেশ সময় ঠিক ১২ টায় জিয়া এয়ারপোর্ট ল্যান্ড করি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম! আহ! কি সুখ!!

ইনহাস্ত ওয়াতানাম-এই আমার মাতৃভুমি!!!
আমার জন্ম ভূমি-আমার মা।
তোমাকে হাজার সালাম।

(শেষ)।


চায়নার ডায়েরী-১০



চায়নার ডায়েরী-১০
নানটং
০৩/৯/২০০৭ইং 

চায়নার একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে ফুল টাইম পাওয়ার সাপ্লাই থাকে। কখনো কারেন্ট যায়না। তাই বলে এরা কিন্তু কারেন্টের অপচয় করেনা। চায়নার অনেক বড় বড় ফ্যাক্টরী/ ইন্ডাস্ট্রীতেও স্টান্ড বাই জেনারেটর নেই! চায়নার বেশীর ভাগ এলাকাই শীত প্রধান। এদের সকল বাড়ী, অফিসেই সোলার পাওয়ার (সৌর বিদ্যুত) ব্যাবহার করে। বিশেষ করে বাড়ি/অফিসের গৃহস্তালী কাজে ব্যাবহারের জন্য পানি গড়ম করা বাধ্যতা মুলক সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে। চায়না সৌর বিদ্যুত ব্যাবহারকারী পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম দেশ। এখানকার হাউজিংগুলো দেখার মতো। কোথাও এমন একটা বাড়ী খুজে পাবেননা-যেখানে ১০ তলা একটা বাড়ীর পাশে ৯ তলা একটা বাড়ী আছে। সরকারী নিমম অনুযায়ী যেখানে ১০ তলা বাড়ী হবে-সেখানে সকল বাড়ীই ১০ তলা। যেখানে ১৫ তলা সেখানে সকল বাড়ীই ১৫ তলা! এক এক এলাকার সকল বাড়ীর উচ্চতা, বাড়ীর রঙ, ডিজাইন সব একই রকমই হবে! কেউ নিয়ম ভেঙ্গে কিম্বা বেশী টাকা আছে বলে টাকার গড়ম দেখিয়ে একটা বড় বাড়ী তৈরী করতে পারেনা। এখানে সবার ভিতর একটা নিয়ম মেনে চলার প্রতিযোগীতা। রাত ৩ টার সময় একদম খোলা রোডেও ড্রাইভার ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলবেই!

নানটং আরো একধাপ এগিয়ে। এরা ইচ্ছে করলেই কোন বাড়ীর সামনে কিছু পেয়ারা, আম, জাম গাছ লাগাবেনা। সরকার/ সিটিকর্পোরেশন নির্ধারিত নির্দিস্ট গাছ লাগাবে। বাড়ীর সামনে কোন একটা গাছের বাগানের ভিতর অন্য জাতের একটা গাছ ঢুকিয়ে দিবেনা!

ডেনিয়েলের অফিসময় ছড়িয়ে পরলো আমাদের না খেয়ে থাকার (রোজা)বিশয়টি! সকলের চক্ষু চড়ক গাছ-কি করে সারা দিনে কিছুই নাখেয়ে এমনকি পানি পর্যন্ত না খেয়ে থাকছি! ডেনিয়েল এবং তার বস কয়েকবার জানতে চাইলো-আমাদের শরিরে ডিহাইড্রেশন দেখা দেবে কিনা? তেমন অবস্থার জন্য ফ্যাক্টরীর ডক্টরকে বলা আছে... বলে অভয় দিল। ডেনিয়েল জানতে চাইলো-সন্ধা বেলা যখন খাবো-তখন এক্সট্রা এনার্জির জন্য কি ধরনের খাবার আমরা খাবো? আমি বল্লাম-কোন বাড়তি খাবারের দরকার হবেনা-নরমাল খাবারই খাবো আমরা। কিন্তু ডেনিয়েল খুব চিন্তিত আমাদের এক্সট্রা এনার্জি খাবারের জন্য।

আমরা অফিসিয়াল কাজ গুলো সেরে বিকেলে কিছু শপিং করার জন্য বের হতে চাইলাম ডেনিয়েলকে সাথে নিয়ে। ডেনিয়েল বল্ল-নাখেয়ে তুমি খুব দুর্বল, এখন রেস্ট করো, ডিনার করে তোমাদের নিয়ে শপিং করতে বেড় হবো। আমি আসলেই দুর্বল ছিলাম-এই কয়দিনের টানা পরিশ্রমে।
নানটং এ প্রচুর পরিমানে বিদেশী বিনিয়োগকারী। সিঙ্গাপুর, ইতালী, জার্মানী, জাপান, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশ এখানে প্রচুর শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশের EPZএলাকার মত। সেই ঊপলক্ষে এখানে প্রচুর বিদেশী বাস করে।বিদেশ বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো ইংলিশ স্কুল আছে। নানটং পর্যটকদের জন্য খুব আকর্ষনীয় স্থান। এখানকার গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেঃ। আজকের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রী। আমাদের জন্য খুব শীত হলেও চায়নীজরা সাধারন টি শার্ট পরেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছে! আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। ঝামেলা এরাবার জন্য ডেনিয়েল কে জানালামনা ইফতারী বিশয়টা। আমাদের হোটেলে ড্রপ করার পর পাশেই কে এফ সি থেকে চিকেন উইংস সহ সামান্য কিছু খাবার কিনে নিলাম ইফতারী করার জন্য। আমরা ৭ টায় ডিনার করবো জানালাম।

সাতটা বাজার ১৫ মিনিট পুর্বেই ডেনিয়েল এলো আমাদের ডিনারে নিয়ে যাবার জন্য। হরের অভিজাত রেস্টুরেন্ট ম্যন্ডারিন(ম্যান্ডারিন চায়নীজ শব্দ-যার অর্থ ভূস্বর্গ)এ আমাদের নিয়ে গেলো। সেখানে আগে থেকেই তার বস, মিঃ জিয়া বিং এবং তার সেক্রেটারী মিজ কাই অপেক্ষায় ছিলো। যাথারিতি নানা রকমের স্যুপ সহ হরেক রকম খাবার এলো। আমার লবস্টার প্রীতির কথা ডেনিয়েল জানে।বিশাল সাইজের সামুদ্রীক লবস্টার ফ্রাই, মিঠা পানির ছোট স্রীম্প, প্রণ এলো। আমি ফ্রাই লবস্টার খেলাম। শুধু মিট এলো ৮/১০ প্রকার। সামুদ্রীক একধরনের ক্রাব দেয়া হলো। লাল টকটকে দেখতে খুব সুন্দর, শরীরের তুলনায় পা গুলো অনেক বড়(ইখতিয়ার উদ্দীন মোঃ বিন বখতিয়ার খিলজীরমত!)। এগুলো কোনটাই রান্না করা না, শুধু মাত্র অর্ধ সিদ্ধ করা। বড় বড় ব্রাউন ক্রাব ফ্রাই দেয়া হলো(ব্রাউন ক্রাব আমাদের দেশ থেকেও তাইওয়ান, হংকং, ইউরোপ আমারিকায় রপ্তানী করা হয়)। এগুলো খুব কস্টলী খাবার। আমি দেখেছি আমাদের গুলশানের অনেক অভিজাত রেস্টুরেন্টে প্রতিটা বড় কাকড়া বিক্রি হয় ৮০০ টাকায়। আমি স্রীম্প মুখে দিলাম-ওগুলো জাস্ট খোসা ছাড়িয়ে লবন মেখে একটু গড়ম পানিতে চুবিয়ে নেয়া। মাঝারী সাইজের কিছু লবস্টার ছিল-যেগুলোর শরীরে এখোনও ময়লা-কাদা, শেওলা লেগে আছে। রংগীন কোন কিছু দিয়ে(হতে পারে টমাটো শস) সিদ্ধ করা। হাতে গ্লাভস পড়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়। সিদ্ধ বেবী কর্ণ ছিল-যা মধুতে মেখে খায়। আমি তা খেলাম। আমাদের দুই জনকে বেশী বেশী খাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল অন্য তিন জন-যেহেতু সারা দিনে আমরা কিছুই খাইনি।

এবার এলো স্যুপের বাটিতে অনেকগুলো চোখ(Eye) সিদ্ধ (এখানকার সিদ্ধ মানে-সামান্য সিদ্ধ)।ওগুলো ছাগল/ভেড়ার চোখ, হতে পারে শুকরের চোখ। চোখ গুলো অনেকটা মরা মানুষের চোখের মত দেখতে।কিম্বা অনেক মানুষ ঘুমালেও চোখ খোলা থাকে-দেখতে খুব ভয়ংকর লাগে-তেমন! চোখের পিছনে একধরনের মাংশ থাকে-সেই মাংশগুলো ছাড়ানো হয়নি। ডেনিয়েল বললো-এটা আমাদের জন্য স্পেসাল অর্ডার দিয়ে করা হয়েছে। এটায় অনেক মিনারেল, ক্যালসিয়াম সহ অনেক কিছুর নাম বললো-যা খেলে আমারদের শরীরের ঘাটতি পুরন হবে! ওরা চোখে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে-আর সাথে সাথে ভিতরের রস/ লালাগুলো গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছে! দেখে আমার বমি পাচ্ছিল-আমি নিজেকে বমি করা থেকে সামলালামকিন্তু সাইফুডিং ঐসব দেখে দৌড়ে গিয়ে বমি করে বসলো! ভাগ্যিস খাবার টেবিল থেকে দৌড়ে যেতে পেরেছিল! ডেনিয়েল বললো-দেখো তোমাদের আগেই বলেছিলাম-এভাবে নাখেয়ে থেকোনা, ডিহাইড্রেশন হবে-এখোন তাই হলো!

সাইফুডিং অন্য টেবিলে বসে ফ্রুটস জুস খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আমাদের খাওয়ানো এখোনো শেষ হয়নি! এবার এলো হাঁসের ডিম। ওগুলোও সিদ্ধ করা। ডিমগুলোর ভিতরে বাচ্চা। ডিমের ৪/১ অংশ ভেঙ্গে ভিতরের বাচ্চার মুখটা বের করা। আর ৩/৪ দিন পরেই ঐ ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো তেমন ডিম সিদ্ধ করা। বাচ্চাগুলোর গায়ে লম্বা লম্বা লোমে ভর্তি আর আটালো পদার্থ লেগে আছে! এই ডেলিসিয়াস খাবারটা খেলে আমাদের এনার্জী ফিরে পাবো। আমরা খেলামনা। সাইফুডিং আবারো বমি করলো ডিমের ভিতরে বাচ্চা দেখে।  ওরা তিন জন চুক চুক করে খেয়ে নিলো হাসের বাচ্চার লোম/পশম সহ। ডিমের খোসায় লেগে থাকা আটালো পদার্থ চেটে চেটে খেয়ে নিল!

পাঠক, আমরা দেখেছি শিয়াল, খাটাস, কুকুর, বিড়াল মুরগী/হাঁস শিকার করে খাবার সময় লোম/পশম খায়না-কিন্তু চায়নীজরা লোম সহ খেয়ে ফেল্লো সেই ডিমের ভিতরের হাসের বাচ্চাগুলো!!

ডিনার শেষ পর্যায়। ঠিক এই সময় এলো সেই মহামুল্যবান পারফর্মেন্স বাড়ানো স্যুপটা-যা আমাদের জন্য সাংহাইতে দেয়া হয়েছিল। তবে এবারে বল(Testis) একটা নয়, দুইটাই ছিল! আমরা ঐ সব কিছুই খেলামনা। আমরা কোনোই ভাল খাবার খাচ্ছিনা বলেই আমাদের শরীরে শক্তি নেই, সেই জন্যই আমরা ফিজিক্যালি আনফিট-বলে ওরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করলো!

এখানে ইলেক্ট্রোনিক্স পণ্যের দাম খুব কম। আমরা চলে যাই পোস্টাল ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট নামক একটা মার্কেটে।এই মার্কেটটা হলো আমাদের দেশীয় বংগ বাজার টাইপের। তবে এখানে শুধু মাত্র ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য পাওয়া যায়। আমি আগেও এই মার্কেটে এসেছি কেনা কাটা করার জন্য। এই মার্কেট থেকে আমি কয়েকটি চায়না ব্রান্ড ঘড়ি কিনি। আমার ঘড়ি কালেকশনের শখ। বিশ্বের নামি-দামী প্রায় ১৪০টির বেশী ঘড়ি আমার কালেকশনে আছে। নানটং এ বিশ্ব বিখ্যাত সুইস রোলেক্স এবং  ইতালীয়ান গুচ্চী, মন্ট ব্লাংক ঘড়ির কারখানা আছে। সাইফুডিং একটা নাইকন ১০ মেগা পিক্সেল ডিজিটাল ক্যামেরা ছাড়াও বেশ কিছু জিনিষ কেনে। ৭ বছর পুর্বে আমি আমার ব্যাবহারের জন্য এই মার্কেট থেকে একটা এইচপি ল্যাপটপ কিনেছিলাম। যার দাম পরেছিল বাংলাদেশী টাকায় ৯০ হাজার টাকা। তখন ঢাকায় ওটার দাম ছিল ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এই মার্কেটে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য খুব সস্তা।পরবর্তীতে আমি আমার ছেলের জন্যও একটা ল্যাপটপ কিনেছিলাম ৪ বছর পুর্বে। আমি এবার কেনার মত কোন জিনিষ খুজে পাচ্ছিনা!

আমি তাড়াতাড়ি হোটেল রুমে ফিরে আসি। কারন আমাকে ঘুমোতে হবে। আমি অসুস্থ্য শরীর নিয়ে রোজা করছি-তার ঊপড় এতো লং জার্নি! আমি বেশ দুর্বল ফিল করছি। কাল এখান থেকে আমরা সকাল সারে নয়টার ভিতর নানজিং এয়ারপোর্ট পৌছবো। আমাদের নানজিং-কুনমিং ফ্লাইট সকাল সারে দশটায়।সাইফুডিং ডেনিয়েলের সাথে নাইট ক্লাবে যায় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য।ও বয়সে তরুণ, ওর পক্ষে যা করা সম্ভব, আমার পক্ষে তা করা অনেকটাই অসম্ভব।এখানেও হোটেলে মাসাসীদের খুব উপদ্রপ। তাই আমি টেলিফোন রিসিভার তুলে রেখে ঘুমিয়ে পরি।

বাকী লেখাটুকু আগামী কাল-

চায়নার ডায়েরী-৯



চায়নার ডায়েরী-৯
নানটং
০৩/৯/২০০৭ইং 

সকাল ছয়টার সময় আমরা জীপ গাড়ীতে নানটং রওয়ানা করি। নানজিং থেকে নানটং এর দুরত্ব প্রায় ৩০০ কিঃমিঃ। নানটংও নানজিং এর মত জিয়াংসু প্রভিন্সের একটা অত্যাধুনিক সিটি।খুব সাজানো গোছানো সিমসাম সিটি নানটং।এ টা একটা কোস্টাল টুরিস্ট সিটি। আমার দেখা চায়নার অন্যতম সুন্দর সিটি নানটং। এখানেই জন্ম নিয়েছেন চায়নার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমীন। আমি চায়নার অনেক কোমপানী থেকে শুধু ইমপোর্ট করি, কিন্তু শুধু মাত্র ডেনিয়েলের কোম্পানীতেই এক্সপোর্ট এবং ইম্পোর্ট করি গত ৬/৭ বছর যাবত। আমি গত সাত বছরে নানটং এসেছি আট বার। আগে নানজিং থেকে নানটং যেতে সময় লাগতো চার ঘন্টা। এখন লাগে ২ ঘন্টা। নানজিং এবং নানটংয়ের মাঝে বিশাল একটা নদী আছে। নাম- ইয়াংসু/ ইয়াংবেজ রিভার। এটা ভয়ংকর উত্তাল একটা নদী-যা চীন সাগরের একটা শাখা নদী। আমরা আগে যেখানটায় ফেরী পার হতাম-সেখানে এই নদী চওড়া ছিল ১২ মাইল।এখন সেখানে ব্রীজ হয়েছে। যার নাম ইয়াংবেজ ব্রীজ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পরীক্ষামূলক চালু হয়েছে এই ব্রীজ-আগামী বছর বানিজ্যিক ভাবে এই ব্রীজ চালু হবেএটা এখন চায়নারই শুধু নয় এশিয়ার সব চাইতে বড় ব্রীজ। সম্ভবত পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম ব্রীজ।

ডেনিয়েল ড্রাইভ করছে। আমি তার পাশের সীটে। পিছনে সাইফুডিং এবং ডেনিয়েলের লেডি পিএস লী ঊই কাই। আমরা ডাকি কাই। মাঝে মাঝে আমি মজা করে বলি তোমাকে খাই- আমি কাইকে বুঝিয়ে বলেছি-তোমাকে খাইয়ের মানেটা! ডেনিয়েল এই কম্পানীতে জব করে জিএম হিসেবে। এখানে জিএম হলো কম্পানীর ডেপুটী চীপ।এমন কি কোথাও কোথাও জিএম একই সাথে কোম্পানীর মালিক/সিইও হয়। কম্পানীর মালিকের নাম Jawo Jia Bing। ডেনিয়েল নানটং ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করে মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল বিজিনেস স্টাডিজে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এই কম্পানীতে ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করেছিল।নিজ যোগ্যতায় ৮ বছরে জেনারেল ম্যানেজার হয়েছে।

হাইওয়েতে মাঝে মাঝে খুব সুন্দর সুন্দর মোটেল আছে।ওয়াশ এন্ড ক্লিনের অত্যাধুনিক ব্যাবস্থা আছে। আরো আছে উন্নত মানের খাবারের রেস্টুরেন্ট। ডেনিয়েল এক যায়গায় গাড়ী থামালো আমাদের কিছু খাওয়ানোর জন্য। আমি বললাম-রোজা রেখে কিছু খাওয়া যাবেনা। কিন্তু ডেনিয়েল নাছোর বান্দা-অন্তত কিছু হলেও খাওয়াবে! আর কিছু না হোক অন্তত ফ্রুটস, কেক খাও, নাহলে দুধ খাও............- এমন সব আন্তরিক বায়না!

আমরা আবার চলছি নানটংয়ের উদ্দেশ্যে। আমি ডেনিয়েলকে আবারো ব্যাখ্যা করলাম রোজা বিষয়। ব্যাখ্যা করলাম আমাদের ধর্মীয় বিষয়। সাথে সাথে ডেনিয়েল গাড়ীটা দাড় করিয়ে উচ্চ শব্দ করে বলে উঠলো(ইউরেকা, ইউরেকা ভাব)-
মিঃ কাবির, নাউ আই য়্যাম ভেরী ক্লিয়ার! আই আন্ডারস্টান্ড, আই নো ফুসা, ফুসা!!বুড্ডা, বুড্ডা!!
হি ইজ ভেরী ক্লেভার এন্ড বিগ ফাকার (fucker)!
হি ইজ ইল ফেইম ফাকার!!

প্রিয় পাঠক, ডেনিয়েল যা বুঝেছে-সে সম্পর্কে আপনাদের ক্লিয়ার করছিঃ-কয়েক শত বছর পুর্বে চীন দেশে বুদ্ধ ধর্মাম্বলীর একজন ধর্ম যাজক ছিলেন তার নাম ফুসা।চীনারা তাকে কংও বলে। সে এবং তার অনুসারীরা সাধারনত উচু পাহাড়ের উপড়ে, সাগর/নদীর তীরবর্তী এলাকার নির্জন স্থানে অনেক উচু দালান করে ধর্ম সাধনা/প্রচার করতো(এখানে উল্ল্যখ্য যে-পৃথিবীর সব ধর্ম যাজকরাই অমন নিরিবিলি যায়গা ধর্ম সাধনার জন্য বেছে নিত)।সেই সব দালানে অনেক গুলো ছোট ছোট রুম থাকতো। ঐ সব রুমে নাকি সুন্দরী নারীদের নিয়ে ফুর্তি করতো...প্রথমে ফুসা পরে তার সাগরেদরা.......। সেই সব ধর্ম যাজকদের প্রচন্ড ক্ষমতা থাকতো রাস্ট্রীয় সব ব্যাপারে। তারা সাধারন মানুষ তথা প্রজাদের ধর্মীয় নেশায় বশ করে রাখতো।যার জন্য প্রজারা উতপাদনশীল তথা রাস্ট্রীয় কাজে মনোযোগ দিতোনা। ফলে চীন দেশ উন্নয়ন থেকে খুব পিছিয়ে পরেছিল! কমুনিস্টরা ধর্মকে তুলোনা করতো আফিমএর সাথে। আফিম খেয়ে মানুষ যেমন বেহুশ হয়ে থাকতো-তেমনি ধর্ম যাজকগন মানুষদের ধর্মীয় নেশায় কর্ম বিমুখ করে রাখতো। মাও সে তুং এর ঐতিহাসিক লং মার্চের পর থেকে চায়নাতে সকল প্রকার ধর্মীয় প্রথা ব্যান করা হয়। সকল উপশানালয় ধংশ কিম্বা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখনো চায়নাতে অনেক যায়গায় সেই সব টেম্পল আছে। যা এখন দর্শনীর বিনিময় দেশী বিদেশী পর্যটকদের দেখানো হয়। ফুসা হলো তেমন একজন ধর্ম যাযক! ডেনিয়েলের ভাষায়- হি ইজ ভেরী ক্লেভার এন্ড বিগ ফাকার (fucker)! হি ইজ ইল ফেইম ফাকার!!
 নানটং তেমন একটি বিখ্যাত বুদ্ধিস্ট টেম্পল আছে-যা আমি দেখেছি। সেখানে ফুসার স্বর্ন নির্মিত বিশাল মুর্তি আছে। বিদ্গুটে রাক্ষুইস্যা চেহারা! সেই ফুসার মুর্তি দেখে আমি অনেক রাত ভয়ে ঘুমাতে পারিনি! সুযোগ পেলে সেই বিষয় অন্য কোন সময় লিখবো।

আমি আবারো ডেনিয়েল কে বুঝিয়ে বললাম-আমাদের ধর্ম-তোমার সেই ফুসা নয়............ আমার কথা শুনে অনেক্ষন চুপ করে থেকে বল্ল-তোমাদের রোজা খুব অমানবিক!

আমরা ২ ঘন্টায় নানটং পৌছে যাই। আমাদের জন্য নানটং হোটেলে বুকিং ছিল। আমরা কিছুক্ষনের জন্য হোটেলে যাই। চেঞ্জ হয়ে আধা ঘন্টা রেস্ট করে ডেনিয়েলের সাথে চলে যাই ওর ফ্যাক্টরিতে। আমি আমাদের দেশ থেকে পেট বোতল স্ক্রাপ/ফ্লেক্স রপ্তানী করি ডেনিয়েলের কম্পানীতে। পেট বোতল হল-আমরা যেসব প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যাবহার করি সেগুলো। এগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন কোয়ালিটি আছে। যেগুলো আগুনের তাপে পুড়ে যায় সেগুলো তেমন একটা রপ্তানী করা যায়না। যেগুলো আগুনের তাপে গলে যায়-সেগুলো খুব দামী এবং চাহিদা পুর্ন। পানি খেয়ে ফেলে দেয়া সেই বোতলগুলো টোকাইরা নিয়ে ভাঙ্গারী দোকানে বিক্রি করে দেয়। তাদের কাছ থেকে ছোট বড় মহাজনেরা কিনে বড় আড়তদারের নিকট বিক্রি করে। অনেকগুলো হাত হয়ে ইউজড বোতলগুলো চলে যায়  স্ক্রাপ রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরীতে। স্ক্রাপ ফ্যাক্টরী বোতলগূলো বায়ারের অর্ডারমত ফ্লেক্স তৈরী করেআমরা প্রতি টোন পেট ফ্লেক্স কোয়ালিটি ভেদে টন প্রতি ১৪০০/১৫০০ ডলারে রপ্তানী করি ডেনিয়েলের কম্পানীতে।২০০২ সনে বাংলাদেশ থেকে আমিই সর্ব প্রথম অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে পেট ফ্লেক্স বিদেশে রপ্তানী করি। আমার সাথে ডেনিয়েলের এগ্রীমেন্ট আছে মান্থলী মিনিমাম ২০০ টন সাপ্লাই করতেই হবে। আমি আমার টার্গেট পুরন করতে পারি।ওরা এগুলো দিয়ে একধরনের সিন্থেটিক্স ফাইবার/ষ্টাপল ফাইবার তৈরী করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করে। অপর দিকে আমি ডেনিয়েলের অন্য একটা কম্পানী থেকে নিয়মিত ইম্পোর্ট করি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট।

পেট ফ্লেক্স ব্যাবসায় এখোন আমাদের অনেক কম্পিটিশন। আমাদের দেশের ব্যাবসায়ীদের একটা অভ্যাস আছে-যে কেউ, যেকোনো ব্যাবসায় কিছুটা ভাল করবে-তাকে প্রতিদন্দীরা যেকোন হীন চক্রান্তে ক্ষতি করে ব্যাবসার ভরা ডুবি করানো। আমিও সেই চক্রান্তের শিকার! অসুস্থ্যতার জন্য আমি বহু দিন ব্যাবসায়ে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। এই সুযোগে আমার প্রতিদ্বন্দীরা অসাধু লেবার দিয়ে আমার রপ্তানীর জন্য রেডিঙ্কন্সাইন্মেন্টের ভিতর নিম্ন মানের পেট ফ্লেক্স এবং বস্তার ভিতরে মাটি, ইটের টুকরা সহ অন্যান্য বাজে জিনিষ মিশিয়ে দিয়ে শিপমেন্ট করে দেয়! তাছারাও সবগুলো কন্টেইনারেই ওজনে কম ছিল(এগুলো চট্টগ্রাম পোর্টের সেডে খারাপ লোকদের টাকা দিয়ে করানো হয়েছিল)।যার কারনে ইম্পোর্টার আমার ঊপড় নাখোশ হয়।
যেহেতু আমার পারফর্মেন্স বিষয়ে ডেনিয়েল জানে এবং তাদের সাথে আমার অন্য বিজনেস আছে-তাই দয়া পরশ হয়ে আমার সাথে এগ্রীমেন্ট ক্যান্সেল না করে সরেজমিনে ঐ সব দেখে একটা সিদ্ধান্ত দেবার জন্য আমাকে তার ফ্যাক্টরীতে ইনভাইট করে। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি ঝামেলাটা খুব সুন্দর ভাবে ওভারকাম করতে সক্ষম হই।

সব চাইতে মজার এবং খুশীর খবর হলো- যারা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো-ডেনিয়েল তাদের সাথে সব কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল করেছে। আগে আমি মান্থলী ২০০ টন সাপ্লাই করতাম, এখন আমাকে ৪০০ টন (বাংলাদেশ থেকে সর্ব সাকুল্যে ৩০০০ টন ফ্লেক্স এক্সপোর্ট হয়)পেট ফ্লেক্স সাপ্লাই করার অর্ডার দিয়েছে এবং রেট টন প্রতি ১২ ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে!

চায়নার ডায়েরী-৮



চায়নার ডায়েরী-৮
নানজিং
০১/৯/২০০৭ইং 

নানজিং অনেকটা আমাদের ঢাকা সিটির মত। মানে ওল্ড নানজিং এবং নিঊ নানজিং। আমাদের যেমন পুরোনো ঢাকা টাইপের........। নিউ নানজিং অনেক গাছ আছে রোডের দু পাশে। সেই গাছগুলোর বৈশিস্ট হলো-সব গাছ, গাছের ডাল, উচ্চতা, পাতা দেখতে একই রকম। এমন একটা গাছ নেই-যে গাছটা এক্টুখানি বাঁকা-ত্যাড়া, কিম্বা সামান্যতম ছোট বড়! আমি এক সময় মনে করতাম গাছগুলো বোধ হয় আর্টিফিসিয়াল। তানাহলে কেমন করে এমন মিল হতে পারে একটা গাছের সাথে অন্য গাছের! আমি রিচার্ডের কাছে বিষয়টা জানতে চাইলাম। রিচার্ড জানালো ওগুলো আর্টিফিসিয়াল গাছ নয়। ন্যাচারাল গাছ। গাছগুলো সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানী থেকে ইম্পোর্ট করে আনা। এই গাছ গুলো রোদের তাপ এবং আলোতে খুব সেন্সিটিভ। রোদ একদম সয্য করতে পারেনা (আমার মত)। শীতের সময় গাছগুলো স্বাভাবিক ভাবেই থাকে। গ্রীস্ম কালে গাছ গুলোর শরির পাটের মোটা রশি দিয়ে জড়িয়ে রাখে। প্রতি দিন দুই বার পানির গাড়ী এসে পানি দিয়ে ওই পাটের রশি ভিজিয়ে দিয়ে যায়-যাতে রোদের তাপ/ আলো গাছে সরাসরি না লাগে। তখন দেখতে অন্য রকম সৌন্দর্য! এই গাছের জন্য সরকারের অনেক খরচ। এমন গাছ চায়নার নানটং সিটিতে অনেক অনেক বেশী আছে। নানটং শীত প্রধান এরিয়া বলে সেখাকার গাছগুলোতে গ্রীস্ম কালে রশি বেঁধে দিতে হয়না।

নানজিং এতোদিন পর্যন্ত সাবওয়ে/ পাতাল রেল ছিলনা। দুই বছর যাবত সাবওয়ের কন্সট্রাকশন কাজ চলছে। সেই কারনে রোডে চলাচল করতে কিছুটা অসুবিধা হয়। এই নানজিং সিটি অনেক কারনে চায়নীজদের কাছে খুব গুরুত্বপুর্ন। মাও সে তুং যখন কোয়াংমিংটং পার্টির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন তখন চিয়াং কাইসেক মাও সে তুং কে ফাঁসির আদেশ দেন। মাও কে ধরতে নাপেরে মাও এর এক বোন এবং তার স্ত্রী কে ধরে ফাঁসি দিয়েছিলেন এই নানজিং শহরেই।

আমরা লাঞ্চ করি রিচার্ডের অফিসের কাছেই একটা দামী রেস্টুরেন্টে। আমরা ৪ জন। রিচার্ড, মিসেস রিচার্ড, ভিকি আর আমি। আমি আগেই বলেছি-চায়নিজরা খুব অথিতি পরায়ন জাতি। তারা খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসে।তবে ওরা প্রচুর খাবার অপচয়ও করে। প্রায় ২৭/২৮ টি আইটেম ছিল মেন্যুতে।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ন্যুডুলস, লবস্টার, চিকেন, বীফ, ল্যম্ব, কাওইয়া(ডাক রোস্ট, চায়না ডাকের সুনাম পৃথিবীব্যাপী), শামুক, ঝিনুক, ব্যাং এর পা, নানা পদের স্যুপ, বীন, কর্ণ, নাট, সব্জী ইত্যাদি। স্পেসাল খাবার ছিলো-বড় কচ্ছপের  পেটের ভিতর থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ ডিম। প্রতিটা গুচ্ছে ৭০/৮০ টা ডিমের কম নয়। মুরগীর পেটের ভিতরে থাকা ডিম ছোট বড় হয়ে থাকে। কিন্তু কচ্ছপের পেটের ভিতর থাকা সব ডিম একই আকারের হয়। কারন কচ্ছপ মুরগীর মত প্রতিদিন একটি করে ডিম দেয়না। কচ্ছপ একবারেই সব ডিম দেয়। আরো একটা স্পেসাল খাবার ছিল-একধরনের পোকা। আমাদের দেশে পঁচা গাছের ভিতর জন্ম নেয়া বড় বড় সাস্থ্যবতী পোকা। পোকাগুলো দেখতে অনেকটা সৌদি খেজুড়ের মতো। ঐ পোকার কোনো পাখা/ঠ্যাং নেই। শরিরটা নাদুস নুদুস নরম তুলতুলে। নরমালি গায়ের রঙ হলদে। হালকা ফ্রাই করার পর রঙ বাদামী/কালো হয়ে যায়। পেট ভর্তি ঘন লিকুইড পদার্থ। ওটাকে সামান্য ফ্রাই করলে পেটের ভিতরের লিকুইড পাদার্থটা কিছুটা ঘনত্ব বেড়ে যায়! পাটি সাপ্টা পিঠার ভিতরে যেমন ক্ষীর দেয়া থাকে-তেমন দেখতে। ঐ পোকাগুলো চায়নীজরা খুব মজা করে খায়!

সব খাবারই যথারিতী রান্না না বলে-অল্প সিদ্ধ বলাই ভালো। আমার কোন খাবার পছন্দ সব ভিকি, রিচার্ড ও তার বজানে, আরো জানে আমার অসুস্থ্যতার কথা-তাই আমার খাবার নিয়ে কেঊ কোন জোড়া জুড়ি করেনা। সব পদের খাবারই সামনে দেয়া থাকে-আমার যেটা পছন্দ সেটা নিয়েই আমি খাই ঘড়ের খাবারের মত।

লাঞ্চ করে আমি আবারো চলে যাই ওদের ফ্যাক্টরীতে। এবার আমার সাথে মিসেস ওয়াং। রিচার্ড ওয়াং এর আরো নতুন বায়ার এসেছে নাইজেরিয়া থেকে। রিচার্ড এবং ভিকি তাকে সময় দিচ্ছে। সাইফুডিং বিকেল নাগাদ ফ্যাক্টরীতে আমাদের সাথে জয়েন করলো। আমি ওদের খাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম। এলান চো বললো-মিত্তার কবির, সাইফুডিং  হ্যাজ ইট মী আপ টু থ্রোট। সো আই ঊইল নট ইট নেক্ত টু ডেজ! পাঠক আপনারা এলান চোর ইংলিশের কোন আগা মাথা বুঝতে পেরেছেন? না পারেননি। তাই আমি এই ইংলিশের অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি-সাইফুডিং আমাকে খাইয়েছে গলা পর্যন্ত। সুতরাং আমি আগামী দুই দিন খাবোনা!

আমাদের কাজ শেষ হলে আমাদেরকে হোটেলে ড্রপ করে মিসেস ওয়াং চলে যায় অফিসে। আমাদেরকে সন্ধ্যা সাতটায় রেডি থাকার জন্য বলা হলো ডিনারের জন্য।
আমরা ফ্রেশ হয়ে রেডি হতেই ঠিক সাতটার সময় মিসেস ওয়াং এলেন আমাদের ডিনারে নেবার জন্য। এবার রিচার্ড ওয়াং আসেনি। তিনি নাইজেরিয়ান বায়ারদের সময় দিচ্ছেন।আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ম্যাকডোনালসে ডিনার করি। রাত সারে নয়টার সময় হোটেল রুমে ফিরে আসি।

রোজা চলছে কিন্তু রোজা বিষয় রিচার্ডকে কিছুই জানালামনা। কারন ওদের রোজা সম্পর্কে বোঝাতে এক দিন লাগবে! তার উপর আমাদের সেহরী খাবারের কথা যেনে অন্য রকম একটা ঝামেলা করবে। আমরা ওদেরকে কস্ট দিতে চাইনা। রাতে সেহরী খেতে হবে। আমি সেহরী করি এক গ্লাশ পানি সাথে একটি খেজুর কিম্বা একটা বিস্কুট দিয়ে। সাইফুডিং এর জন্য ম্যাকডোনালস থেকে সেহরীর খাবার নিয়ে নিলাম।

আমরা কাল সকাল ৬ টায় চলে যাব নানটং। আমরা বাই রোড যাবো। তারিখ সকালেই আবার নানটং থেকে নানজিং ফিরবো। কারন ৪ তারিখ সকাল সারে দশটায় নানজিং থেকে আমাদের কুনমিং যাবার ফ্লাইট রিকনফার্ম করা আছে। আমাদের নানটং নিয়ে যাবার জন্য-ওখানকার বিজিনেস প্রিন্সিপাল মিঃ ডেনিয়েল সি(Daniel Shi) রাতেই তার জীপ গাড়ী নিয়ে চলে এসেছে এবং আমাদের হোটেলেই সে ঊঠেছে।আমরা হোটেল রুমে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেই। ডেনিয়েলের সাথে রোজা বিশয় অনেক কথা হয়েছিল আমাদের।