সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমেরিকার কড়চা-২


আমেরিকার কড়চা-২

লিখেছেন বাবুয়া, সন্ধ্যা ০৭: ০৮, ১২ অক্টাবর, ২০১১

আমেরিকার কড়চা-২ 

আমার জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছি বিদেশ ভ্রমনে। পৃথিবীর ৫ টা মহাদেশের ২২ টি দেশের কৃস্টি-কালচার,সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমি পেয়েছি। কিন্তু সেই ২২ দেশের কারও জন্য কোনই ভালো মন্দ অবদান আমি রাখতে পারিনি!কোন দিন কিছু করতেও পারবোনা।ইরাক,ফিলিস্তিন,আফগানিস্তান,কাশ্মীর,শ্রীলংকা,ইরিত্রিয়াকংগো,চেচনিয়া,আইভরীকোস্টের অসহায় মানুষগুলোর দু'চোখে এখনো দুঃসহ যন্ত্রনার অশ্রু ঝড়ে।আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয়-শুধু অদুর ভবিষ্যত নয়, সুদুর ভবিষ্যতেও সেই সব হতভাগ্য মানুষের চোখে একটুখানি আশার আলোর রেখা,এক বিন্দু সুন্দরের আলোকরশ্মি দেখা দেবেনা তাদের ভাগ্যাকাশে। তাদের জীবন মৃত্যু এখনো আবর্তিত হয়-আশা নিরাশার দোলাচলে!মানুষের এমন নিপীড়নের কারন যে দেশ,যে মানুষ-যারা এই পৃথিবীর ঈশ্বর,আমরা যাদের হাতের পুতুল,আমি সেই আমেরিকার কথা লিখছি,লিখছি তাদের ঐষর্যের কথা-এটা আমার জীবনের বড় একটা পরাজয়।কিন্তু এটাই নিয়তির খেলা!

বিশাল দেশ আমেরিকা!একটি মহাদেশের নাম আমেরিকা।একটি মহাদেশ নিয়ে আমেরিকা। ৫০ টা অংগ রাজ্য নিয়ে বিশাল আমেরিকার ১৮ টি স্টেস্টেস'র প্রধান প্রধান সিটিতে আমি বেড়িয়েছি। আমেরিকা কত বড় দেশ তার ছোট্ট একটা ধারনা দিচ্ছিঃ-বাই এয়ার (নন স্টপ)নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল যেতে সময় লাগে প্রায় ছয় ঘন্টা!প্রাচুর্যের দেশ আমেরিকা। স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। সেই আমেরিকায় গাড়ীর মালিক হওয়া খুব সোজা! সোস্যাল সিকিউরিটি কার্ড এবং যেনো তেনো একটা ইনকামের ব্যাবস্থা থাকলেই হলো। গাড়ী কেনার কথাতো খুবই সামান্য বাড়ী কিনতে চাইলেও মাত্র ৫-১০% ডাউন পেমেন্টে ব্যাংক আর প্রমোটরেরা হুমড়ী খেয়ে পরে-লোন দিয়ে গাড়ী বাড়ীর মালিক বানানোর জন্য। ওদের ব্যাংক ইন্টারেস্ট খুবই কম। ৩% থেকে সর্বোচ্চ ৬%!ব্যাংকে টাকা জমা রাখবেন-ইন্টারেস্ট পাবেন সর্বোচ্চ মাত্র ৩%!কোথাও কোথাও কোনো ব্যাংকে নির্দিস্ট পরিমানের কম টাকা রাখলে উলটো ব্যাংক’কেই ফি দিতেহয়!বৌ আমার কাছ থেকে কিছু লোন নিয়ে অত্যন্ত প্রযোজনে একটা গাড়ী কেনার জন্য এপ্লাই করার দুই দিনের মাথায় ব্যাংকের লোক এবং গাড়ীওয়ালা এসে দড়জায় হাজির। আমিই পছন্দ করি লেক্সাস। কারন বরফের দেশে/রাস্তায় বড় গাড়ী কম স্লীপ করে। একটু ভাড়ী গাড়ী এক্সিডেন্ট কম হয় তুলনামুলক। আমারিকাতে একাধীক গাড়ী থাকা কোনই বিলাশিতা নয়,নিত্য প্রয়োজনীয়। যদি সেকেন্ড হ্যান্ড মাত্র ২/৩ বতসর ইউজ করা গাড়ী কিনেন-তাহলে হয়ত ৩০ হাজার ডলারের গাড়ীটাই ৫/৬ হাজার ডলারে কেনা যায়।

আমার বৌ থাকেন তার বড় বোনের বাড়ী। বড় বোন আমারিকার একটি বিখ্যাত চেইন শপ’র ম্যানেজার(একাউন্ট্স)!যারা আমেরিকায় থাকেন-তাঁরা জানেন ওটা বেশ বড় জব। উইকলী ৪০ ঘন্টা কাজ করতে হয়। আমেরিকাতে সেলারী দেয়া হয় দুই ভাবে। উইকলী এবং মান্থলী। আমার ভায়রাও অনেক বড় জব করেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বিখ্যাত থ্রী এম কোম্পানীর সিনিয়র সাইন্টিস্ট তিনি। তিনি ঢাকা ভার্সিটি থেকে কেমেস্ট্রীতে অনার্স-মাস্টার্স করে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচডি করে আমেরিকাতেই সেটেল্ড হন। ৩০ বছর যাবত আমেরিকায় থাকেন। পরিবারের সবাই(দুটি মেয়ে সহ)আমেরিকান সিটিজেন। মেয়ে দুইটির বড় জন ডেন্টিস্ট,স্বামী সহ থাকেন পেনসিলভেনিয়ায়। অন্যজন তখন এইট গ্রেড স্টুডেন্ট। বিশাল বাড়ীতে মানুষ নেই বললেই চলে। আমার বৌ এবং একমাত্র ছেলেটি থাকে ওদের সাথে। আমি যখন ওখানে যাই-সারা দিন ঘুড়ে বেড়াই। কখোনো ডেট্রয়েট,কখনো গ্রান্ড রেপিডস,বাংগালী অধ্যুসিত হ্যামট্রামিক কিম্বা আরব-আমেরিকান অধ্যুসিত ডিয়ারবোর্ন।মিশিগান ফল,মিশিগান লেক গার্ডেনে,মিসিসিপি নদীতে মাছ ধরা কোন কিছুই আমি বাদ দেইনা! ছেলেকে নিয়ে বরফের উপড় দৌড়াই.....আইস স্কীটিং শিখতে যাই! মাত্র দুই মাসের ভিতর আমি পুরো মিশিগান চষে বেড়াই!রাতে বাড়ী ফিরে সবাই খুব হৈ-হুল্লোর করি।তখন সাগিনাওতে মোট ১০ টা বাংলা ভাষী পরিবার বাস করে। তাদের ভিতর তিন পরিবার বাংলাদেশী বাঙ্গালী অন্যরা ইন্ডিয়ান বাংগালী। তবে সবাই খুব ইউনাইটেড,একটা পরিবারের মতো।

মিশিগানকে বলা হয় "লেক সিটি"। তুলনা মুলক ভাবে মিশিগানে জন বসতি খুব কম। আমারেরিকার সব শীত প্রধান এলাকাতেই জনবসতি কম। কিন্তু ওইসব এলাকাতেই জনবসতি বাড়ানোর পরিকল্পনা মতে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রীজ গড়ে তোলা হয়। মিশিগানের ডেট্রয়েটে পৃথিবী বিখ্যাত জেনারেল মোটর্সের মেইন ইন্ডাস্ট্রীজ। ডেট্রয়টে অনেক বাংলাদেশী বাস করেন। আমেরিকাতে বিভিন্ন স্টেটসে অনেক বাংলাদেশী থাকলেও এখানকার বাংগালীদের ভিতর তফাত হলো-এরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং টেকনোক্রাট। বেশীর ভাগ অড জব(আমেরিকানরা যে সব কাজ নিজেরা করেনা-যেমন পয়নিঙ্কাষন,ক্লিনিং ইত্যাদি কাজকে অডজব জব বলে। যদিও আমি মনে করি-সকল পেশার কাজই সন্মান জনক। বরং অন্যের দেশ দখল করা,ধন সম্পদ লুট করা অনেক নোংড়া কাজ)বাঙ্গালীরা বাস করেন নিউইয়র্ক সিটিতে। নিউইয়র্ক সম্পর্কে অন্য সময় লিখবো।

আমি এখন মনের সুখে ড্রাইভিং করছি। বাজার ঘাট করছি। বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি পরিচিত হচ্ছি ওদের কালচারের সাথে।ওখানকার তেলের পাম্পের নাম গ্যাস স্টেশন!কেনা কাটা করে,হোটেল রেস্টুরেন্টে খেয়ে "বিল" চাইলে হবেনা,বলতে হবে-"চেক"।তখন আপনাকে "বিল" ধরিয়ে দিবে। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার করার জন্য নানা ধরনের হাট/বাজার আছে!যেমন-পাইকারী বাজার,রিটেইলার,ডিপার্ট্মেন্ট স্টোর্স এবং গ্রোসারী স্টোর্স-এই তিন ধরনের বাজার।

পাইকারী বাজারকে ওরা বলে "Sam's Club"।সামস ক্লাবে আপনি যাবেন-অনেক বেশী বাজার করার জন্য। তা হতে পারে মান্থলী বাজার কিম্বা কোন পার্টী বাজার করা।ওখানে সব কিছুই বাল্ক কিনতে হবে। অর্থাত ওই বাজারে আপনি কোন কিছুই ৫ কেজির কম কিনতে পারবেননা। জাস্ট লাইক আওয়ার পাইকারী কাওরান বাজার!এখানকার কোন জিনিষের দামের সাথে রিটেইলারদের দাম গালফ অব ডিফারেন্টস!উদাহরণ সরুপ বলা যায়- সামস ক্লাব থেকে ৫ কেজি আলু কিনলে হয়ত দাম প্রতি কেজি ২৫ টাকার সমান। কিন্তু সে আলুই যদি আপনি রিটেইলার থেকে কিনেন-তাহলে তার দাম হবে ৪০ টাকার সমান। সামস ক্লাবে আপনি এ টু জেড সব জিনিষ কিনতে পাবেন। 

ওদের বাড়ীগুলো খুবই নাজুক। রড সিমেন্টের তেমন কারবার নেই-তাই খুব বেশী সস্তা! আমাদের যেমন ধানমন্ডি এলাকায় একটা মাঝারী মানের ফ্লাট কিনতেই কোটি টাকা লাগে। কিন্তু ওদের কয়েক বিঘা জমির উপড় একটা বাড়ী বানাতেও এক লক্ষ ডলার লাগেনা!জমির দাম খুব কম। বাড়ীর ভিতরে সিক্রেসি নেই বললেই চলে। খুব হালকা তালা চাবি। এক রুম থেকে অন্য রুমের সকল কথা বার্তা শোনা যায়!বেশীর ভাগ বাড়ীরই দুটো এন্ট্রান্স থাকে। সামনের দড়জা দিয়ে নর্মালী বাড়ীর সদস্যরা কম আসা যাওয়া করে। গ্যারাজ সবগূলোই অটোমেটিক। বাড়ীর মেইন গেইট এবং গ্যারাজ অন/অফ করার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ীর চাবির রিং এর সাথেই থাকে। গাড়ী নিয়ে ঢুকে গ্যারাজ বন্ধ করে পিছন থেকেই বেশীর ভাগ লোক বাড়ীতে ঢুকে। বাড়ীর ফ্লোর কাঠের। সিলিং পর্যন্ত মানানসই সিন্থেটিক্স টাইলস কিম্বা উডেন টাইলস!শীত প্রধান এলাকা বলেই সব কিছু কাঠের! সব বাড়ীর সামনে পিছনে প্রশস্থ্য লন। খেলা ধুলার জন্য বেশ কিছু যায়গা। প্রায় প্রতি বাড়ীতেই বাস্কেট খেলার জন্য সিঙ্গেল বাস্কেট।

বাড়ীর সামনে পিছনে অনেক গাছ পালা। আপনি গাছের মালিক,কিন্তু ঐ গাছের একটা ডাল পর্যন্ত আপনি কাটতে পারবেননা। ঝড় বৃস্টিতে যদি একটা গাছ পড়ে যায়, কিম্বা ডাল ভেঙ্গে যায়-আপনাকে তা কর্তিপক্ষের কাছে জানাতে হবে। তাদের লোক এসে গাছ/ডাল কেটে নিয়ে যাবে-কিন্তু বিল পেমেন্ট করতে হবে আপনাকেই!বাড়ীর সামনের,পিছনের ঘাস আপনিই কাটবেন,কিম্বা ডলার খরচ করে প্রফেশনাল লোক কল করে ঘাষ কাটাবেন এবং সপ্তাহের নির্দিস্ট দুই দিন রাতে এসে সব গার্বেজ গাড়ীতে করে নিয়ে যাবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন