পাথরে স্বাধীনতা সংগ্রামঃ-২
বিশ্ববিদ্যালয়ের
টিএসসি সড়কদ্বীপে রয়েছে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটি। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এ ভাস্কর্যটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এ ভাস্কর্যের নির্মাতা
চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক শামীম সিকদার। ২৫ মার্চ বাঙালী
জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ
গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালীর উপর পাক হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে
বাঙালিকেও অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়।। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের
স্মৃতিকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরার বাসনা ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের। ৮৭ সালের নভেম্বর
মাসের ১০ তারিখে নূর হোসেনের রক্তে যে দিন ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো সেই দিন থেকেই তিনি
তাঁর সহকারি শিল্পী হিমাংশু রায় ও আনোয়ার চৌধুরীকে নিয়ে শুরু করেন এই ভাস্কর্যটির কাজ। নানা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা
সম্ভব হয়েছে।
ভাস্কর শামীম সিকদার
বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী এবং শিক্ষক। বিভিন্ন বাধা ও প্রতিকুলতা
উপেক্ষা করে বেশ কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমার নিজস্ব শ্রম
ও অর্থ দিয়েই নির্মাণ করেছি "স্বাধীনতা সংগ্রাম" ভাস্কর্যটি। তবে ভাস্কর্যের প্রথম
অংশটির স্থানান্তর এবং বাকি চারটি স্তর নির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা সহযোগিতা
করেছে।
শিল্পী বলেন, আমাদের সমাজে ভাস্কর্য
সম্পর্কে একটি অনীহা ও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। ভাস্কর্য শিল্পীর
মনের কল্পনা এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ইট-পাথরে রূপ দেয়। এতে পূজা বা অর্চনার
কোন বিষয় থাকে না। ইতিহাসকে বিধৃত করাই ভাস্কর্যের
মূল লক্ষ্য। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক মুসলিম দেশেই
ভাস্কর্য তাদের সংস্কৃতির একটি অঙ্গ। উদার দৃষ্টিভঙ্গি
ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে এ শিল্পকর্মের মূল্যায়ন করলে সকলের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ জাতির সকল আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের
এসব গৌরবোজ্জ্বল অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি
শিল্পী এ বিশ্ববিদ্যালয়কে উৎসর্গ করেছেন।
"স্বাধীনতা সংগ্রাম"
ভাস্কর্যটি দেশের সর্ববৃহৎ। বাঙালির ইতিহাসে
বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সমস্ত বীরত্বগাথাকে
ধারণ করে সৃষ্টি করা হয়েছে এ ভাস্কর্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফুলার রোডের সড়ক দ্বীপে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। ভাস্কর শামীম শিকদার
১৯৮৮ সালে ফুলার রোডে অবস্থিত সেকেলে বাংলো স্টাইলের বাড়ির (বর্তমানে প্রোভিসির ভবন)
সামনে পরিত্যক্ত জায়গায় "অমর একুশে" নামে একটি বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু
করেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক
ঘরোয়া পরিবেশে প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফ এটি উদ্বোধন করেন। ১৯৯৮ সালে ঐ স্থানে
উদয়ন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হলে ভাস্কর্যটি স্থান্তরের প্রয়োজন হয়। ভাস্কর্যটি শেষমেষ
সড়কদ্বীপে এনে রাখা হয়। পরে ভাস্কর শামীম
শিকদার ওই ভাস্কর্যটির অবয়ব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে "স্বাধীনতা সংগ্রাম"
নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। এই সঙ্গে সড়ক দ্বীপটিকেও
তিনি নিজের মনের মত গড়ে তোলেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
এটি উদ্বোধন করেন।
"স্বাধীনতা সংগ্রাম"
ভাস্কর্যটি বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে নির্মিত। এ ভাস্কর্যটি মহান
ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬-র স্বাধিকার আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, ২৫শে মার্চের কালরাত্রি, ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু
কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের
বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি আন্দোলনে
নিহত হয়েছেন এমন ১৮ জন শহীদের ভাস্কর্য দিয়ে পুরো ভাস্কর্য নির্মিত। সবার নীচে ভাষা শহীদের
ভাস্কর্য এবং সবার উপরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যে আরো
তুলে ধরা হয়েছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক আমাদের লাল সবুজের পতাকা।
মূল ভাস্কর্য স্বাধীনতা
সংগ্রামকে ঘিরে অরো অনেক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে এ সড়কদ্বীপে। ভাস্কর্যের নিরাপত্তা
কর্মী ও মালি বাদল গোয়াল জানান, তিনি গণনা করে দেখেছেন
মোট ভাস্কর্য ১১৬টি। সবগুলোই শামীম সিকদারের গড়া। সবগুলোর রঙ শ্বেত
শুভ্র। মূল ভাস্কর্য ছাড়া অন্য ভাস্কর্যগুলোর
গড় উচ্চতা তিন থেকে চার ফুট। ত্রিভূজাকৃতির এই
দ্বীপটির তিন কোনে তিনটি ভাস্কর্য রয়েছে। বাকিগুলো ফুলগাছ
আর পাতাবাহর গাছের সারির মধ্যে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত। এখানে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশ চন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসুদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত, ড. মোঃ শহীদুল্লাহ, শিল্পী সুলতান, জিসি দেব, সুভাস বোস, কামাল আতাতুর্ক, মহাত্মাগান্ধী, রাজা রামমোহন রায়, মাও সে তুং, ইয়াসির আরাফাত, কর্ণেল ওসমানী, তাজউদ্দিন আহমেদ, সিরাজ সিকদার প্রমুখের
প্রতিকৃতি রয়েছে। ভাস্কর শামীম সিকদারেরও দুটি
প্রতিকৃতি রয়েছে। আরও রয়েছে একটি হাতির চিত্তাকর্ষক
ভাস্কর্য। মূল ভাস্কর্য স্বাধীনতা সংগ্রামসহ
অন্য ভাস্কর্যগুলো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য দেশী বিদেশী নানা জাতের ফুলগাছসহ একটি
সবুজ বাগান গড়ে তুলেছে বর্তমান কর্মরত মালি বাদল গোয়ালা। শামীম সিকদার লিখিতভাবে
এ ভাস্কর্য নির্মান কাজের সার্বিক তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডাকসুর চিত্রগ্রাহক গোপাল
দাসকে।
ফুলার রোডের ত্রিভূজাকৃতির
এই সড়কদ্বীপের এক চিলতে জমিতে শুধু ইট-পাথরের ভাস্কর্য গড়ে ওঠেনি, রয়েছে একটি কৃত্রিম
ফোয়ারা, চমৎকার ফুলের বাগান
ও অন্যান্য গাছগাছালি। প্রতিটি জিনিসই পরিপাটি
করে সাজানো। সবুজ সর্গোদ্যানে যেন দেশ
বিদেশের শ্রেষ্ঠ মনীষী, বিপ্লবীরা অবস্থান করছেন। হাসনাহেনা, বেলি, রজনীগন্ধা, গোলাপ, চিনিচাপা, ক্যামেলিয়া, শিউলি, গন্ধরাজ, গাঁদা, চেরি ও ডালিয়াসহ
নানা ফুল গাছে ভরা এ ছোট আকৃতির উদ্যানটি। প্রতিদিন অসংখ্য
দেশী বিদেশী দর্শনার্থী এ ভাস্কর্য দেখতে এখানে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাসে এছাড়াও ছোট বড় আরো অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। টিএসসি সড়কদ্বীপে
রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রাজুর স্মৃতি ধারণ করে রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান হলের সামনে রয়েছে মা ও শিশু ভাস্কর্য। মুহসীন হলের সামনে
রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্য। শামসুন্নাহার হলের
সামনে ৮৭ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য। এছাড়াও এ হলের সামনে
ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদলের ভাস্কর্য রয়েছে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের
মধ্যে রয়েছে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যসহ ছোট বড় নাম না জানা অনেক ভাস্কর্য।
(শেষ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন