রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

প্রতারকঃ


প্রতারকঃ
ধানমন্ডি ১০ নম্বর রোড থেকে ধানমন্ডি নম্বর রোডের আঁলিয়েস ফ্রাঁসেজ যেতে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিসাথে আমার ছোট ছেলে- ওখানে ফ্রেঞ্জ ভাষা শিক্ষা কোর্স করছেসেডিউল মতো আমি ওকে ওখানে রিকশায় নামিয়ে দিয়ে লেকের পাড়ে ঘন্টা হাটবো তারপর ওকে নিয়ে আবার বাসায় ফিরবো একটা রিকশা কাছে আসতেই আমার গন্তব্যের কথা বলি রিকশাওয়ালা বললো-বাহে, মুই ঢাকাত নতুন আইচু, চিনাইয়া লিবার পারলে যাইয়্যাম-ল্যায্য ভাড়া দিয়েন আমি বললাম-আমার ল্যায্যতো-আপনার ল্যায্যের সাথে নাও মিলতে পারে-তাহলেতো ভাড়া নিয়ে আপনার সাথে ঝামেলায় পরতে হবে আপনি যান-আমি অন্য রিকশা নেবো রিকশাওয়ালার কাকুতি মিনতিতে ওর রিকশাতেই যাচ্ছি......

রিকশাওয়ালা বলছে-সার, হামাক বাড়ি অংপুর, মুই হামাক একটা ব্যাটাক ছাওয়াল ব্যেইচবার চাই মুইয়ের দুইডা ব্যাটাক ছাওয়ালএক্টাক ব্যেইচ্যা মুইয়ের বৌকে কেন্সার চিকিস্যা করাইমু একজন বাবা তার সন্তান বিক্রি করতে চায়!আমি রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বলি জানতে চাই-কি হয়েছে,খুলে বলো? রিকশাওয়ালা বলছে-পেশায় সিকিউরিটি গার্ডের জব করতো একটা গোডাউনে......।বৌ ক্যান্সার হয়েছে রংপুর মেডিকেলে কলেজ হাসপাতাল থেকে জানিয়েছে-ঢাকা নিয়ে চিকিতসা করাতে বাড়ীর শেষ সম্বল বসত বাড়ির ভিটেটুকু ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ঢাকা এসেছিল ২০/২২ দিন পুর্বে ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় বারান্দায় ঘুড়েও চিকিতসা করাতে পারেনি দালাল নিয়ে যায় মোহাম্মদপুরের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ডাক্তারের এডভাইস মতে-রোগীনিকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয় মাত্র / দিনে সব টাকা শেষ এখন ইঞ্জেকশন, কেমোথেরাপী, রেডিও থেরাপী নিতে হবে......কিন্তু ঔষধ কেনার পয়শা নেই খাবার পয়শা নেই!বাচ্চা দুটো রাস্তায় ভিক্ষা করে...সেই উপার্যনে কিচ্ছু হয়না। শক্ত সামর্থ রিকশাওয়ালাকে কেউ ভিক্ষা দেয়না। রিকশাওয়ালা আরো বললো-দালাল ধরে দিনে তিন বারঅক্ত(রক্ত) বিক্রি করেছে, আজই প্রথম রিকশা চালাচ্ছে-এই কথাগুলো বলতে বলতে রিকশাওয়ালা রিকশার সীটের নীচ থেকে তার স্ত্রীর চিকিতসা সংক্রান্ত একটি ফাইল বের করে আমার হাতে দিল

আমি ঢাকার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা দেখলাম প্রেস্ক্রিপশন করেছেন-ডাঃ আব্দুল ওয়াদুদ, সিনিয়র ক্যান্সার কন্সাল্টেন্ট-যাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি তিনি বর্তমানে মিরপুরস্থ্য ডেল্টা ক্যান্সার হাস্পাতালের সব থেকে সিনিয়র চিকিতসক(ক্যন্সার চিকিতসক হিসেবে দেশেরও অন্যতম সিনিয়র চিকিতসক) এবং হাসপাতালের একজন পরিচালকও তিনি কেনো ডেল্টা হাসপাতালে রোগীকে এডমিট নাকরিয়ে এই রাক্ষুসে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি/ চিকিতসা নিতে উতসাহিত করেছেন-সেই অসুস্থ্য ভাবনাটা আমি ভাবতে চাইনি কারন ডাঃ ওয়াদুদ সাহেবের প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। দেশে উনিই প্রথম আমার ক্যান্সারের প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট করেছিলেন। প্রেসক্রিপ্সনে অন্যান্য খাবার ঔষধের সাথে লেখা আছে-১০০ এম এল সিসপ্লাটিন ইঞ্জেকশন টি সাত দিনে নিতে হবে প্রসল ১০০০ মিঃলিঃ স্যালাইনের সাথে।ক্যান্সারের সব ঔষধই কস্টলী। তবে এই ঔষধ দুটিই সব থেকে কম দামী। আমার জানা আছে-মেড কাউন্ট্রি ভেধে প্রতিটা ইঞ্জেকশনের দাম কম পক্ষে ৯ শত টাকা এবং দেশী স্যালাইনের দাম ৩৫০ টাকা করে।রিকশাওয়ালা আমাকে হাত জোড় করে বললো-“সার, বাহে, মোর বৌর চিকিতসার জন্যি একটা ইঞ্জেকশন কিন্না দ্যান।না হইলেক ৫/৭ বছরের হামাক দুইডা ব্যাটাক ছাওয়াল-ইয়াতীম হইয়া যাইবে”। সারা শরির ঘামে ভেজা রিকশাওয়ালা আবেগে কাঁপছে......
“মাতৃহীন/ইয়াতীম” শব্দটা আমার কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি শব্দ। আমার ছেলে আমার হাতটি শক্ত করে ধরে আছে। আমার চোখের সামনে আমার অতীত, আমার চোখের সামনে আমার বর্তমান...... আমার মনের ভিতর রিকশাওয়ালার ছোট্ট দুটি সন্তানের ভবিষ্যত! ছেলে বললো-“আব্বু, ওকে হেল্প করো। আমিও আমার বৃত্তির টাকাটা ওকে দান করতে চাই...”!

রিকশাওয়ালার সাথে আমার অনেক কথা হয়।ও কোথায় থাকে-সেই ঠিকানাটা আমি লিখে নিলাম। আমি রিকশাওয়ালাকে নিয়ে ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের ল্যাভেন্ডার নামক ঔষধের দোকানে যাই- এই দোকানটা ক্যান্সারের ঔষধের জন্য বিখ্যাত। আমি ওকে ৭ টা ইঞ্জেকশন, ৭ টা স্যালাইন কিনে দেই এবং হাতে নগদ ৫০০ টাকা। আমার অফিসের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলি-যে কোনো ‘পে ফোন’ থেকে কল করে আমাকে প্রতি দিনের আপ ডেট জানাতে এবং এই ইঞ্জেকশন শেষে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করতে।

শামসেল হক-প্রায় প্রতিদিনই ওর বৌ’র চিকিতসার আপ ডেট জানায়। ইঞ্জেকশন নিতে গিয়ে আরো বেশী দুর্বল/অসুস্থ্য হবার কথা জানায়। আমি অভয় দেই-আস্তে আস্তে সয্য শক্তি বাড়বে বলে। ক্যান্সার চিকিতসা অনেক সময় সাপেক্ষ চিকিতসা। যে ক্লিনিকে সামসেল হকের স্ত্রী চিকিতসা নিচ্ছে-সেটা কস্টলী।ওখানে রেখে ওকে চিকিতসা করা সম্ভব নয়।আমি মহাখালীস্থ্য সরকারী ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এ এফ এম ফজলে করিমের সাথে যোগাযোগ করি-ঐ হাসপাতালে ভর্তি করে সরকারী ভাবে চিকিতসা করাতে। তিনি জানালেন-সিরিয়াল অনুযায়ী এখানে ২/৩ মাসের আগে আবাসিক চিকিতসা দেয়া সম্ভব নয়।আমি সাস্থ্য মন্ত্রীর পি এস এর সাথে যোগাযোগ করে ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি এবং চিকিতসার ব্যবস্থা করি।

ষষ্ঠ দিন, সপ্তম দিন এবং তারপরের দিনও সামসেল হকের ফোন নাপেয়ে আমি চিন্তিত হই।মনে আশংকা জাগে-অসুস্থ্য/দুর্বল বৌটি ইঞ্জেকশনের যন্ত্রনা সয্য করতে নাপেরে হয়ত মারা গিয়েছে! কিন্তু সামসেল হক আমাকে জানায়না কেনো? তাহলে কি ওকে আমার অফিসে সিকিউরিটি গার্ড আমার সাথে দেখা করতে দেয়নি?না কি সামসেল হক আনাড়ী ভাবে রিকশা চালাতে গিয়ে নিজেই বেওয়ারিশ লাশ হয়েছে! এখন সামসেল হকের অসুস্থ্য বৌ কি করবে? কোথায় যাবে ছোট্ট দুটি বাচ্চা নিয়ে। নাকি সামসেল হক মরে নি, ওর বৌ মরেগেছে। তাহলে কি সামসেল হক ২য় বিয়ে করবে আর বাচ্চাদুটো সত মায়ের অত্যাচারে, শিশু শ্রমিক হতে বাধ্য হবে? নাকি অনাহারে রাস্তায় বেওয়ারিশ বিড়াল-কুকুরের মত মরে পরে থাকবে!আমি আর সয্য করতে পারছিনা। অফিসের একজন স্টাফ আর ড্রাইভারকে পাঠালাম সেই হাসপাতালে। ওরা এসে জানালো ঐ হাসপাতালে ঐ নামে কোনো রোগী ছিলনা...আমি ওদেরকে পাঠালাম সামসেল হকের দেয়া বস্তির ঠিকানায়-না বস্তির ঠিকানাটা ভুয়া! আমার চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পরলো। বাসায় কাউকে জানতে দিলামনা বিষয়টা। আমি ভেবে স্বস্তি পেলাম-যাক তাহলে “আমেনা খাতুন” নামে একজন গৃহ বধু ক্যান্সারের মত যন্ত্রনাময় অসুখে ভোগেনি, সামসেল হক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়নি-ওদের দুটি বাচ্চা “ইয়াতীম” হয়নি।

ঘটনাটি এখানেই শেষ হলে-ভালই হত। আরো ১০/১২ দিন পর সামসেল হক উস্কো শুস্কো চেহারায় অফিসে দেখা করে জানালো-ওর বৌ চিকিতসা নিয়ে এখন অনেকটাই ভাল আছে।কিন্তু ডাক্তার বলেছে-আরো অনেক দিন চিকিতসা করাতে হবে।আগামী চার মাসে তিন সাইকেলের ৪ টা কেমোথেরাপী নিতে হবে...... আমি ওকে জানতে চাই-এতো দিন আমার সাথে যোগাযোগ/দেখা করে নাই কেন?সামসেল হক জানায়-ওর একটা ছাওয়াল রাস্তা পার হতেগিয়ে দাড়ির ধাক্কায় আহত হয়। আমেনা খাতুনের চিকিতসার জন্য সারাক্ষন সে ক্লিনিকেই সময় দেয়-এবস্থায় বাচ্চাদেরকে ঢাকা রাখা সম্ভব ছিলনা। তাই ও বাচ্চাদুটোকে ওর শাশুড়ীর কাছে রেখে আসতে “অংপুর” গিয়েছিল-আজই বাসে করে ঢাকা ফিরেছে”!

আমি সামসেল হকের মুখের দিকে তাকাতে পারছিনা-মানুষ কতটা অমানুষ হলে এমন করে মিথ্যা কথা বলতে পারে......! এই প্রতারনার ঘটনাটা আর দীর্ঘায়ীত করতে চাইনা। আপনাদেরকেও জানাতে চাইনা-সামসেল হকের পরিনতির কথা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন