মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

জেলখানার চিকিত্সা এবং আমাদের অর্থনীতিঃ


জেলখানার চিকিত্সা এবং আমাদের অর্থনীতিঃ
লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ০১: ১৫, ৩০ জুন, ২০১১


জেলখানার চিকিত্সা এবং আমাদের অর্থনীতিঃ

কোনো সাধারণ লোককে দেশের অবস্থা কেমন জিজ্ঞাসা করলে সে বাজারের জিনিসপত্রের দামের অবস্থা বুঝে উত্তর দেবে। যদি জিনিসপত্রের মূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তবে বলবে দেশ ভালো চলছে। আর যদি মূল্য অস্বাভাবিক হয় তবে খারাপ বলবে। দেশের অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক হবে না ধনতানতান্ত্রিক হবে তা দেশের জনসাধারণ ভাবে না। আমাদের মতো দেশের ম্যাংগো পাবলিক পেটপুরে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত চায়। দেশে চলছে খোলা বাজার অর্থনীতির নামে লুটপাট। খোলা বাজারের দৌরাত্ম্যে বিদেশের বহু রকমের জিনিসপত্র দেশে আসছে বৈধ এবং অবৈধ ভাবে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যখনমাত্র দাঁড়াতে শুরু করেছিল-সে সময় এ অবস্থা হওয়ায় এখন দেশীয় শিল্প টিকে থাকতে হিমসীম খাচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান যাঁরা গড়তে আগ্রহী তাঁরাও থিতু হয়ে বসে গেছেন। তৈরি জিনিসের উপাদান খরচ অনেক বেশি হওয়ায় এবং বিদ্যুত, গ্যাস ও শ্রমিক ঝামেলাসহ অনেক রকম ঝামেলা সামাল দিয়ে উত্পাদিত পণ্য বাজারজাত করে বিদেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারছে না বলে তাঁরাও হাত গুটিয়ে বসে আছেন। অলাভজনক হওয়ায় একদিকে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। এমন দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সবরকম ব্যবহারিক পণ্যের জন্য বিদেশের ওপর একশো ভাগ নির্ভর করতে হবে। দেশ সবদিক থেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেকারের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

শুনেছি-বৃটিশ আমলে জেলখানায় আসামিদের চিকিত্সার এক সুন্দর পদ্ধতি ছিল। যারা আমাশয়, পেট খারাপ, গ্যাস্ট্রিক অথবা অন্য কোনো পীড়ায় ভুগতেন তাদের এক লাইনে বসানো হতো এবং যাদের জ্বর, আঁঘাত জনিত কিম্বা বাতের ব্যথা বা অন্য কোনো রোগ হতো তাদের বসানো হতো অন্য লাইনে। জেলের চিকিত্সা বিভাগের লোকজন একটি বড় বোতলে কিছু রংগীন পানীয় মিকচার এনে প্রথম লাইনের লোকজনকে মুখ হা করতে বলতো এবং তারা হা করা মাত্র বোতল থেকে প্রত্যেকের মুখে ওষুধ ঢেলে দিতো। অন্য দলের জন্যও একই অবস্থা ছিল। সব রোগের জন্য একই ওষুধ।

বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ উন্নতশীল দেশগুলোর জন্য, স্পেশালী বাংলাদেশের জন্য জেলখানার চিকিত্সা পদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। কোন্ দেশের কী অবস্থা তা যাচাই না করে ঢালাওভাবে ফ্রি ইকোনোমির প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছে। আর সরকার তা বিনা প্রশ্নে মেনে নিচ্ছেন এবং বিদেশীদের কাছ থেকে উন্নয়নের সনদ প্রাপ্তির তৃপ্তির ঢেকুর উদ্বগীরণ করে চলছেন। ফ্রি ইকোনোমির হোতারা বলছেন—সবকিছুই বেসরকারিভাবে চলবে। সরকার দেশে চালাবেন, ব্যবসা নয়। কিন্তু আজ ব্যবসা ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছেন কেন, কেন দেশীয় শিল্পগুলো লাভজনক হতে পারছে না? কেন ব্যবসায়ীরা প্রচণ্ডভাবে ঋণখেলাপি হচ্ছেন? শেয়ার মার্কেট থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা কারা লুটপাট করেছে—আমলারা নাকি ব্যবসায়ীরা নাকি সুযোগ সন্ধানী ব্যাবসায়ী রাজনীতিবিদরা? শেয়ার মার্কেট ধ্বংস হওয়ার ফলে নতুন শিল্প গড়তে জনগণ থেকে কোনো পুঁজি পাওয়া যাচ্ছে না। আর আগামী বিশ বছরে তা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বিশ্বাসের খেয়ানত অনেক সুদূরপ্রসারী।

যখন সরকারের কর্তব্য খুব ঠাণ্ডা মাথায় অর্থনীতির প্রতিটি স্তরকে পরিমাপ করা-তখন সরকার করে চলছে সম্পুর্ণ উল্টোটা! গনতন্ত্র ও আইনের শাসন আর সাধারণ জনগণের উন্নয়ন সব সময় কেন যেন মানুষ খুব বেশি আশা করে। মানুষ চায় সমাজে স্থিতিশীলতা। সেটা পরিবার হোক, রাজনীতি হোক, ব্যবসা হোক বা দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই। কিন্তু অস্থিরতার এত বেশি গতি যে মানুষ কোনো কিছুতেই পেরে ওঠে না। তারপরও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছবক দেয়া হয়েছে, হচ্ছে।

গণতন্ত্রের ফুলে ওঠা বেলুন আরব বিশ্বকে ভালোভাবেই নাড়া দিয়েছে। রাজনীতির উত্তাপ সেখানে এখন চরম অবস্থানে। উত্তাপের কারণে জ্বালানি তেলের দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কিত। তারপর গত প্রায় তিন বছরে মূল্য সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজেদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেয়নি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হলেও সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপি বলে বেড়াচ্ছেন, বিরোধী দল পরিকল্পিতভাবে এটা করছে। ভালো কথা—তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। কমিটি হয়েছে। প্রতিবেদন হবে। কিন্তু শাস্তি হবেনা সেটা নিশ্চিত।

সেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকরীরা বার বার এভাবে পুঁজি হারাবেন? বাজারে গেলেই চড়া দামের কারণে মানুষ কীভাবে যে অসহায় অবস্থায় বাড়িতে ফেরত আসে সেটা বোধহয় নেতারা অনুভব করেন না। চাল, ডাল, চিনি, তেল এমন নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামের কারণে মানুষ যতই দিশেহারা হচ্ছে তা নিয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী নেতারা আজকে অনেক শক্তিশালী। ব্যবসায়ীদের সংগঠন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখবে। সেটাই তো স্বাভাবিক।
সিন্ডিকেট নামক বস্তুকে সরকার এখনো দেখতেই পায়নি। পারবেই বা কীভাবে-বানিজ্য মন্ত্রী নিজেইতো ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন! তাই তো জনগণের ভোগান্তি বাড়িয়ে হলেও তারা ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থ সঠিকভাবেই রক্ষা করছে। নিয়মিত দ্রব্যমূল্য মনিটর করা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে এফবিসিসিআই’র অঙ্গীকার ইতিহাস হতে চলেছে। সরকারও সে পথেই হাঁটছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, ট্যারিফ কমিশন, এনবিআরসহ সব মূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো চলছে ব্যাবসায়ী বানিজ্যমন্ত্রীর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অঙ্গুলি হেলনে। আমরা মূল্য সিন্ডিকেট ও তাদের শাস্তি বা দ্রব্যমূল্য কমার কোনো প্রত্যাশা কেন করতে পারি না সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা ও বৈষম্য বা আয় নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। যতটুকু আছে তা ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি-এগিয়ে যাও বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন