চায়নার ডায়েরী-১১
নানটং-নানজিং-কুনমিং-ঢাকা
০৩-০৪/৯/২০০৭ইং
আমি রাতে যখন সেহরী
খেতে উঠি(রাত সারে তিনটা) তখোন পর্যন্ত সাইফুডিং নাইট ক্লাব থেকে ফেরেনি। ভোর ৫
টায় ফজর নামাজ পরে ওর রুমের সামনে গিয়ে
দেখি তখনো ফেরেনি। আমি অপেক্ষা করছি কখন ফিরবে.........ঠিক সেই মুহুর্তেই বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে সাইফুডিংকে
ফিরে আসতে দেখে আমি অন্য দিকে চলে যাই-যাতে আমাকে দেখতে না পায়।
সকাল বেলা ডেনিয়েল পার্সোনালি আমাকে, আমার বৌ
বাচ্চা এবং সাইফুডিং কে বেশ কিছু গিফট দিয়েছে। ঠিক
সারে ছয়টায় আমরা
নানজিং এর উদ্ধেশ্যে রওয়ানা করি। আজ ড্রাইভ করছে ডেনিয়েলের ড্রাইভার। আমি ডেনিয়েল
পিছনে এবং সাইফুডিং ড্রাইভারের পাশে বসা। সাইফুডিং এবং ডেনিয়েল দুজনের চোখেই ঘুম! ডেনিয়েল জোড় করে আমার সাথে কথা
বলার চেস্টা করছে।
নানটং এয়ারপোর্ট খুব বেশী বড় না। এখান থেকে ২৪ টা ডমেস্টিক রুটে ফ্লাইট যাওয়া
আসা করে। কিন্তু কুনমিং কোন ফ্লাইট যায়না। তাই আমাদের নানটং থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দুরে নানজিং আসতে হয়। আমরা নয়টার আগেই নানজিং এয়ারপোর্ট চলে আসি। ওখানে আমাদের জন্য আগে
থেকেই রিচার্ড ওয়াং, ভিকি অপেক্ষা করছিলো। ওরা আমাদের জন্য অনেক গিফট নিয়ে
এসেছে। আমার বৌ এর জন্য কিছু জুয়েলারী
দিয়েছে মিসেস ওয়াং। সাইফুডিং এর বাচ্চার জন্য বেশ কিছু টেডিবিয়ার এবং টয়।আমার জন্য
অনেকগুলো গ্রীন টি প্যাকেট, বাচ্চাদের জন্য নানান রকমের ক্যাটবেরী এবং ডোভ চকোলেট।এই
চকোলেটগুলো বৃটিশ কিন্তু চায়নাতেই ফ্যাকটরী। আমারা দুজনে
অনেক গিফট পেয়েছি-যাতে করে আলাদা একটা লাগেজ হয়েছে!
জানি এই সব গিফট নিয়ে আমাদের জিয়াতে কাস্টমস কর্তিপক্ষ ঝামেলা করবেই।
আমাদের এই ফ্লাইট ডাইরেক্ট কুনমিং যাবেনা। ইতিমধ্যে এই ফ্লাইট সাংহাই থেকে এসেছে। নানজিং থেকে যাবে ফুযিয়ান।
তারপর কুনমিং। বেশ ঘুরে যেতে হয়। সময় লাগবে সারে
চার ঘন্টা। আমরা
নির্দিস্ট সময়ে কুনমিং পৌছি।কুনমিং পৌছেই বুক ভরে নিঃশ্বাশ নিলাম। মনে হলো বাড়ীর
দড়জায় এসেছি। একাহ্নে বসেই আমি
আমাদের দেশের সুন্দর ঘ্রান পাচ্ছি-যে ঘ্রানটা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাইনা!আমি জানিনা
আমার মায়ের শরিরের ঘ্রান কেমন ছিল! আমার
ধারনা আমার মায়ের শরিরের ঘ্রানটাই আমি আমার মাতৃভুমিতে অন্তর থেকে অনুভব করি।এখান থেকে মাত্র দুই ঘন্টার পথ ঢাকা। খুশীতে আমার মন ভরে গেলো! আহ!
ঐতো আমার দেশ!!! কিন্তু আজ আমাদের ঢাকা যাওয়া হচ্ছেনা। কারন আজ ঢাকা যাবার জন্য আর
কোন ফ্লাইট নেই। আমাদের ফ্লাইট আগামীকাল সকাল
দশটায়।
কুনমিং এ অনেকটাই বাংলাদেশের আমেজ পাওয়া যায়। অনেক
শিক্ষিত বাংলাদেশীরা চায়নাতে বিভিন্ন রকম কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।এরা টুরিস্ট
ভিসা নিয়ে আসে। কিছু দিন চায়না থেকে আবার হংকং চলে যায় ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য।হংকং
চায়নার একটা অংশ হলেও আলাদা দেশের মর্যাদা দেওয়া
হয়। আগে এই সব অবৈধ বাংলাদেশীরা হংকং বিভিন্ন কাজ
করতো। এখন ওখানে খুব কড়াকড়ির জন্য থাকা সম্ভব নয় বলে কুনমিং থাকে এবং বিভিন্ন কাজ
করে। কেউ কেউ ব্যাবসাও করে। চায়নীজ সরকার তাড়িয়ে দেয়না-যদি বড় কোন অপরাধ না করে।
এখানে অনেকগুলো বাংলাদেশী রেস্ট/গেস্ট হাঊজ আছে। এনটিভি
এবং প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক মিলে বড় একটা
ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গেস্ট হাঊজ করেছে।নাম দিয়েছে “অবসর বাংলা”। আমি বেশীর ভাগ সময়
কুনুমিং এই অবসর বাংলায় থাকি। অন্য যারা তারাও
ফ্ল্যাট ভাডা নিয়ে গেস্ট হাঊজ ব্যাবসা করে। এদের
সার্ভিসটাও খুব ভালো। ওদের অনেক এজেন্ট এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঙ্গালী দেখলেই খুব আন্তরিকতার
সাথে দৌড়ে আসে। লাগেজগুলো নিজেরাই তূলে নিয়ে ট্যাক্সিতে তুলবে। নিয়ে যাবে গেস্ট
হাঊজে।২৪ ঘন্টা থাকা খাওয়া, নাস্তা, এয়ারপোর্ট আপ ডাউন ট্রান্সপোর্ট সহ সিঙ্গেল
রুম উইথ এটাস্টড বাথ রুম ১৫০ আরএমবি আর যদি শেয়ার রুম হয় তাহলে নিবে ১০০ আরএমবি। ওখানেও কুমিল্লা হোটেল, জালালাবাদ
গেস্ট হাউজ, ভাই ভাই হোটেল এন্ড গেষ্ট হাউজ এবং বিসমিল্লাহ হোটেলও আছে! প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশে মোটামুটি বড় এমন কোন স্টেশন নেই যেখানে কুমিল্লা হোটেল,
বিসমিল্লাহ হোটেল কিম্বা ভাইভাই হোটেল নেই! আমি পাকিস্তানের করাচী, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাই, জেদ্দা, রিয়াদ, মক্কা-মদীনা শরীফ, কোলকাতা,
দিল্লী, আজমীর, বোম্বেতে এমন কি ফ্লোরিডা, নিউইয়র্কেও এই নামের হোটেল/ স্টোর
দেখেছি!
রেস্ট হাঊসে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সাইফুদ্দিনকে নিয়ে ওর
সৌজন্যে বেড়াতে বের হই। আমরা যাই কুনমিংযের বিখ্যাত “রক
ফরেস্ট” দেখতে। আমাদের রেস্ট হাউজ
থেকে টেক্সীতে যেতে সময় লাগে এক ঘন্টা। ভাড়া ওঠে ১০৮ আরএমবি। রক ফরেস্ট হলো পাথরের
বন/বাগান! আমাদের
যেমন আছে সুন্দর বন-ঠিক তেমনি কুনমিং এর রক
ফরেস্ট। নানান আকৃতির নানান ধরনের পাথর। বিশাল বিশাল এক একটা পাথর গাছের মত উচু! কোনটা সাদা, কোনটা কালো রংযের
পাথর। কথিত আছে-কয়েক
লক্ষ বছর পুর্বে আগ্নেয়গিড়ির অগ্ন্যুতপাতে এই রক
ফরেস্টের সৃস্টি হয়েছিল। চোখে না দেখলে কল্পনাও করা যাবেনা-পাথরের বাগান কেমন হতে
পারে! ওখানে
প্রচুর বিদেশী পর্যটকের ভীড়। এখানে একটা
মজার বিশয় লক্ষ্য করলাম-কিছু লোকের কাছে ছোট ছোট তুলি
এবং রংয়ের বোতল। তাদের কাছ থেকে রঙ-তুলি নিয়ে পয়সার বিনিময়ে কেউ কেউ পাথরের উপর
প্রেমিক প্রেমিকার নাম লিখে রাখে। আমাদের দেশে যেমন বাথরুম কিম্বা ওয়ালে প্রেমিক
প্রেমিকার নাম লিখে রাখে-“স্বাতু+কলি” অমি+পিয়াল” কিম্বা “আলী+বেবী” টাইপের! আমরা ঘন্টা খানেক
পর রেস্ট হাঊজে ফিরে আসি।
আজ আমরা ইফতার করি দেশী স্টাইলে! আমার অতি প্রিয়
লেবুর শরবত, পিয়াজু, বেগুনী, ছোলা-মুড়ি দিয়ে! আহ! কি মজা! কি সুখ!! রাতে আমরা ভাত
খাই-ছোট চিংড়ি, মিস্টি কুমড়া, ডাটা শাক, করল্লা ভাজী,দেশী চিকেন(হাইব্রীড ব্রয়লার নয়), শিং মাছ, গরুর গোস্ত আর ডাল চচ্চড়ী দিয়ে! সেহরী খাই- ছোট চিংড়ি ভূণা, ডিম ভাজা আর ডাল দিয়ে। পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ খাবার
হলো আমার বাংলাদেশী খাবার! যদিও কুনমিং এর খাবার আমাদের দেশীয় খাবারের মত মজাদার নয়। কারন ওখানকার বেশীরভাগ স্বব্জী, ফল হাইব্রীড।
পর দিন সকাল দশটার ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ফিরি।
বাংলাদেশ সময় ঠিক ১২ টায় জিয়া এয়ারপোর্ট ল্যান্ড করি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম! আহ!
কি সুখ!!
ইনহাস্ত ওয়াতানাম-এই আমার
মাতৃভুমি!!!
আমার জন্ম ভূমি-আমার মা।
তোমাকে হাজার সালাম।
(শেষ)।