বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

চায়নার ডায়েরী-১০



চায়নার ডায়েরী-১০
নানটং
০৩/৯/২০০৭ইং 

চায়নার একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে ফুল টাইম পাওয়ার সাপ্লাই থাকে। কখনো কারেন্ট যায়না। তাই বলে এরা কিন্তু কারেন্টের অপচয় করেনা। চায়নার অনেক বড় বড় ফ্যাক্টরী/ ইন্ডাস্ট্রীতেও স্টান্ড বাই জেনারেটর নেই! চায়নার বেশীর ভাগ এলাকাই শীত প্রধান। এদের সকল বাড়ী, অফিসেই সোলার পাওয়ার (সৌর বিদ্যুত) ব্যাবহার করে। বিশেষ করে বাড়ি/অফিসের গৃহস্তালী কাজে ব্যাবহারের জন্য পানি গড়ম করা বাধ্যতা মুলক সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে। চায়না সৌর বিদ্যুত ব্যাবহারকারী পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম দেশ। এখানকার হাউজিংগুলো দেখার মতো। কোথাও এমন একটা বাড়ী খুজে পাবেননা-যেখানে ১০ তলা একটা বাড়ীর পাশে ৯ তলা একটা বাড়ী আছে। সরকারী নিমম অনুযায়ী যেখানে ১০ তলা বাড়ী হবে-সেখানে সকল বাড়ীই ১০ তলা। যেখানে ১৫ তলা সেখানে সকল বাড়ীই ১৫ তলা! এক এক এলাকার সকল বাড়ীর উচ্চতা, বাড়ীর রঙ, ডিজাইন সব একই রকমই হবে! কেউ নিয়ম ভেঙ্গে কিম্বা বেশী টাকা আছে বলে টাকার গড়ম দেখিয়ে একটা বড় বাড়ী তৈরী করতে পারেনা। এখানে সবার ভিতর একটা নিয়ম মেনে চলার প্রতিযোগীতা। রাত ৩ টার সময় একদম খোলা রোডেও ড্রাইভার ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলবেই!

নানটং আরো একধাপ এগিয়ে। এরা ইচ্ছে করলেই কোন বাড়ীর সামনে কিছু পেয়ারা, আম, জাম গাছ লাগাবেনা। সরকার/ সিটিকর্পোরেশন নির্ধারিত নির্দিস্ট গাছ লাগাবে। বাড়ীর সামনে কোন একটা গাছের বাগানের ভিতর অন্য জাতের একটা গাছ ঢুকিয়ে দিবেনা!

ডেনিয়েলের অফিসময় ছড়িয়ে পরলো আমাদের না খেয়ে থাকার (রোজা)বিশয়টি! সকলের চক্ষু চড়ক গাছ-কি করে সারা দিনে কিছুই নাখেয়ে এমনকি পানি পর্যন্ত না খেয়ে থাকছি! ডেনিয়েল এবং তার বস কয়েকবার জানতে চাইলো-আমাদের শরিরে ডিহাইড্রেশন দেখা দেবে কিনা? তেমন অবস্থার জন্য ফ্যাক্টরীর ডক্টরকে বলা আছে... বলে অভয় দিল। ডেনিয়েল জানতে চাইলো-সন্ধা বেলা যখন খাবো-তখন এক্সট্রা এনার্জির জন্য কি ধরনের খাবার আমরা খাবো? আমি বল্লাম-কোন বাড়তি খাবারের দরকার হবেনা-নরমাল খাবারই খাবো আমরা। কিন্তু ডেনিয়েল খুব চিন্তিত আমাদের এক্সট্রা এনার্জি খাবারের জন্য।

আমরা অফিসিয়াল কাজ গুলো সেরে বিকেলে কিছু শপিং করার জন্য বের হতে চাইলাম ডেনিয়েলকে সাথে নিয়ে। ডেনিয়েল বল্ল-নাখেয়ে তুমি খুব দুর্বল, এখন রেস্ট করো, ডিনার করে তোমাদের নিয়ে শপিং করতে বেড় হবো। আমি আসলেই দুর্বল ছিলাম-এই কয়দিনের টানা পরিশ্রমে।
নানটং এ প্রচুর পরিমানে বিদেশী বিনিয়োগকারী। সিঙ্গাপুর, ইতালী, জার্মানী, জাপান, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশ এখানে প্রচুর শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশের EPZএলাকার মত। সেই ঊপলক্ষে এখানে প্রচুর বিদেশী বাস করে।বিদেশ বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো ইংলিশ স্কুল আছে। নানটং পর্যটকদের জন্য খুব আকর্ষনীয় স্থান। এখানকার গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেঃ। আজকের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রী। আমাদের জন্য খুব শীত হলেও চায়নীজরা সাধারন টি শার্ট পরেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছে! আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম। ঝামেলা এরাবার জন্য ডেনিয়েল কে জানালামনা ইফতারী বিশয়টা। আমাদের হোটেলে ড্রপ করার পর পাশেই কে এফ সি থেকে চিকেন উইংস সহ সামান্য কিছু খাবার কিনে নিলাম ইফতারী করার জন্য। আমরা ৭ টায় ডিনার করবো জানালাম।

সাতটা বাজার ১৫ মিনিট পুর্বেই ডেনিয়েল এলো আমাদের ডিনারে নিয়ে যাবার জন্য। হরের অভিজাত রেস্টুরেন্ট ম্যন্ডারিন(ম্যান্ডারিন চায়নীজ শব্দ-যার অর্থ ভূস্বর্গ)এ আমাদের নিয়ে গেলো। সেখানে আগে থেকেই তার বস, মিঃ জিয়া বিং এবং তার সেক্রেটারী মিজ কাই অপেক্ষায় ছিলো। যাথারিতি নানা রকমের স্যুপ সহ হরেক রকম খাবার এলো। আমার লবস্টার প্রীতির কথা ডেনিয়েল জানে।বিশাল সাইজের সামুদ্রীক লবস্টার ফ্রাই, মিঠা পানির ছোট স্রীম্প, প্রণ এলো। আমি ফ্রাই লবস্টার খেলাম। শুধু মিট এলো ৮/১০ প্রকার। সামুদ্রীক একধরনের ক্রাব দেয়া হলো। লাল টকটকে দেখতে খুব সুন্দর, শরীরের তুলনায় পা গুলো অনেক বড়(ইখতিয়ার উদ্দীন মোঃ বিন বখতিয়ার খিলজীরমত!)। এগুলো কোনটাই রান্না করা না, শুধু মাত্র অর্ধ সিদ্ধ করা। বড় বড় ব্রাউন ক্রাব ফ্রাই দেয়া হলো(ব্রাউন ক্রাব আমাদের দেশ থেকেও তাইওয়ান, হংকং, ইউরোপ আমারিকায় রপ্তানী করা হয়)। এগুলো খুব কস্টলী খাবার। আমি দেখেছি আমাদের গুলশানের অনেক অভিজাত রেস্টুরেন্টে প্রতিটা বড় কাকড়া বিক্রি হয় ৮০০ টাকায়। আমি স্রীম্প মুখে দিলাম-ওগুলো জাস্ট খোসা ছাড়িয়ে লবন মেখে একটু গড়ম পানিতে চুবিয়ে নেয়া। মাঝারী সাইজের কিছু লবস্টার ছিল-যেগুলোর শরীরে এখোনও ময়লা-কাদা, শেওলা লেগে আছে। রংগীন কোন কিছু দিয়ে(হতে পারে টমাটো শস) সিদ্ধ করা। হাতে গ্লাভস পড়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে হয়। সিদ্ধ বেবী কর্ণ ছিল-যা মধুতে মেখে খায়। আমি তা খেলাম। আমাদের দুই জনকে বেশী বেশী খাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল অন্য তিন জন-যেহেতু সারা দিনে আমরা কিছুই খাইনি।

এবার এলো স্যুপের বাটিতে অনেকগুলো চোখ(Eye) সিদ্ধ (এখানকার সিদ্ধ মানে-সামান্য সিদ্ধ)।ওগুলো ছাগল/ভেড়ার চোখ, হতে পারে শুকরের চোখ। চোখ গুলো অনেকটা মরা মানুষের চোখের মত দেখতে।কিম্বা অনেক মানুষ ঘুমালেও চোখ খোলা থাকে-দেখতে খুব ভয়ংকর লাগে-তেমন! চোখের পিছনে একধরনের মাংশ থাকে-সেই মাংশগুলো ছাড়ানো হয়নি। ডেনিয়েল বললো-এটা আমাদের জন্য স্পেসাল অর্ডার দিয়ে করা হয়েছে। এটায় অনেক মিনারেল, ক্যালসিয়াম সহ অনেক কিছুর নাম বললো-যা খেলে আমারদের শরীরের ঘাটতি পুরন হবে! ওরা চোখে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে-আর সাথে সাথে ভিতরের রস/ লালাগুলো গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছে! দেখে আমার বমি পাচ্ছিল-আমি নিজেকে বমি করা থেকে সামলালামকিন্তু সাইফুডিং ঐসব দেখে দৌড়ে গিয়ে বমি করে বসলো! ভাগ্যিস খাবার টেবিল থেকে দৌড়ে যেতে পেরেছিল! ডেনিয়েল বললো-দেখো তোমাদের আগেই বলেছিলাম-এভাবে নাখেয়ে থেকোনা, ডিহাইড্রেশন হবে-এখোন তাই হলো!

সাইফুডিং অন্য টেবিলে বসে ফ্রুটস জুস খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আমাদের খাওয়ানো এখোনো শেষ হয়নি! এবার এলো হাঁসের ডিম। ওগুলোও সিদ্ধ করা। ডিমগুলোর ভিতরে বাচ্চা। ডিমের ৪/১ অংশ ভেঙ্গে ভিতরের বাচ্চার মুখটা বের করা। আর ৩/৪ দিন পরেই ঐ ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো তেমন ডিম সিদ্ধ করা। বাচ্চাগুলোর গায়ে লম্বা লম্বা লোমে ভর্তি আর আটালো পদার্থ লেগে আছে! এই ডেলিসিয়াস খাবারটা খেলে আমাদের এনার্জী ফিরে পাবো। আমরা খেলামনা। সাইফুডিং আবারো বমি করলো ডিমের ভিতরে বাচ্চা দেখে।  ওরা তিন জন চুক চুক করে খেয়ে নিলো হাসের বাচ্চার লোম/পশম সহ। ডিমের খোসায় লেগে থাকা আটালো পদার্থ চেটে চেটে খেয়ে নিল!

পাঠক, আমরা দেখেছি শিয়াল, খাটাস, কুকুর, বিড়াল মুরগী/হাঁস শিকার করে খাবার সময় লোম/পশম খায়না-কিন্তু চায়নীজরা লোম সহ খেয়ে ফেল্লো সেই ডিমের ভিতরের হাসের বাচ্চাগুলো!!

ডিনার শেষ পর্যায়। ঠিক এই সময় এলো সেই মহামুল্যবান পারফর্মেন্স বাড়ানো স্যুপটা-যা আমাদের জন্য সাংহাইতে দেয়া হয়েছিল। তবে এবারে বল(Testis) একটা নয়, দুইটাই ছিল! আমরা ঐ সব কিছুই খেলামনা। আমরা কোনোই ভাল খাবার খাচ্ছিনা বলেই আমাদের শরীরে শক্তি নেই, সেই জন্যই আমরা ফিজিক্যালি আনফিট-বলে ওরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করলো!

এখানে ইলেক্ট্রোনিক্স পণ্যের দাম খুব কম। আমরা চলে যাই পোস্টাল ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট নামক একটা মার্কেটে।এই মার্কেটটা হলো আমাদের দেশীয় বংগ বাজার টাইপের। তবে এখানে শুধু মাত্র ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য পাওয়া যায়। আমি আগেও এই মার্কেটে এসেছি কেনা কাটা করার জন্য। এই মার্কেট থেকে আমি কয়েকটি চায়না ব্রান্ড ঘড়ি কিনি। আমার ঘড়ি কালেকশনের শখ। বিশ্বের নামি-দামী প্রায় ১৪০টির বেশী ঘড়ি আমার কালেকশনে আছে। নানটং এ বিশ্ব বিখ্যাত সুইস রোলেক্স এবং  ইতালীয়ান গুচ্চী, মন্ট ব্লাংক ঘড়ির কারখানা আছে। সাইফুডিং একটা নাইকন ১০ মেগা পিক্সেল ডিজিটাল ক্যামেরা ছাড়াও বেশ কিছু জিনিষ কেনে। ৭ বছর পুর্বে আমি আমার ব্যাবহারের জন্য এই মার্কেট থেকে একটা এইচপি ল্যাপটপ কিনেছিলাম। যার দাম পরেছিল বাংলাদেশী টাকায় ৯০ হাজার টাকা। তখন ঢাকায় ওটার দাম ছিল ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এই মার্কেটে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য খুব সস্তা।পরবর্তীতে আমি আমার ছেলের জন্যও একটা ল্যাপটপ কিনেছিলাম ৪ বছর পুর্বে। আমি এবার কেনার মত কোন জিনিষ খুজে পাচ্ছিনা!

আমি তাড়াতাড়ি হোটেল রুমে ফিরে আসি। কারন আমাকে ঘুমোতে হবে। আমি অসুস্থ্য শরীর নিয়ে রোজা করছি-তার ঊপড় এতো লং জার্নি! আমি বেশ দুর্বল ফিল করছি। কাল এখান থেকে আমরা সকাল সারে নয়টার ভিতর নানজিং এয়ারপোর্ট পৌছবো। আমাদের নানজিং-কুনমিং ফ্লাইট সকাল সারে দশটায়।সাইফুডিং ডেনিয়েলের সাথে নাইট ক্লাবে যায় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য।ও বয়সে তরুণ, ওর পক্ষে যা করা সম্ভব, আমার পক্ষে তা করা অনেকটাই অসম্ভব।এখানেও হোটেলে মাসাসীদের খুব উপদ্রপ। তাই আমি টেলিফোন রিসিভার তুলে রেখে ঘুমিয়ে পরি।

বাকী লেখাটুকু আগামী কাল-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন