চায়নার
ডায়রীঃ-১
(ঢাকা-কুনমিং-সাংহাই)
২৬/৮/২০০৭ইং
ব্যাবসায়ীক কাজে কয়েক
মাস আগেই চায়না যাওয়াটা আমার খুব
জরুরী হয়ে পরেছিলো। কিন্তু আমার অসুস্থ্যতার জন্য যথা সময়ে যেতে পারিনি।সিদ্ধান্ত
ছিল-সিঙ্গাপুর থেকে চিকিতসা শেষে ফিরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চায়না যাব। বেশীরভাগ সময় আমি একাই যাই। আমার অসুস্থ্যতার
কারনে এবার আমার সফর সংগী হয় আমার সিনিয়র এক্সিকিঊটিভ অফিসার(আমদামী-রপ্তানী) সাইফুদ্দিন আল মামুন (সাইফুদ্দিন)।আমাদের
সফর সংগী আছেন আরো ২ জন ডাইরেক্টর সংশ্লিষ্ঠ
বায়ারের পক্ষে। মনে করা যাক-তাদের একজনের নাম-“টমী”
অন্য জনের নাম-“জিমী”। “টমী-জিমী”
সাধারনত পোষা কুকুরের বহুল জনপ্রিয় নাম। ঐ স্বভাবের লোকদের
নাম এমনি হওয়া উচিত। টমী-জিমী উচ্চ পদস্থ্য আমলা এবং
দুইজনই মস্ত বর ঘুষখোর-তাই তাদের বিস্তারিত পরিচয়
কিছুই লিখবোনা-কারন, পেশাগত কারনে ঐ দুইজনের কাছে
আমরা কোনো অপরাধ ছাড়াই ধরা খাওয়া।
পাঠক, আপনারা বুঝে নিবেন ঐ দুই ঘুষখোর আমার ঘারের উপড় জগদ্দল পাথর হয়ে অক্টোপাশের
মত লেগেই আছে।
আমাদের প্রথম গন্তব্য
সাংহাই। আমরা টিকেট কিনেছি চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সে ঢাকা-কুনমিং-সাংহাই। ২৮
তারিখ দুপুর একটায় ঢাকা থেকে আমাদের ফ্লাইট ছাড়লো কুনমিং’এর
উদ্দেশ্যে। ২৫৭ সীটের
প্লেনে ২১৪ জন যাত্রী ছিলাম আমরা। যাত্রীদের মধ্যে ১৬ জন
বাংলাদেশী, ৮ জন ঊরোপীয়ান,৭ জন
ইন্ডিয়ান, ২ জন আফ্রিকান এবং ২ জন শ্রীলংকান
অন্যরা সবাই চায়নীজ। ওয়েদার বেশী ভালো ছিলনা। বেশ কয়েকবার এয়ার পকেটে পরেছিলাম। ২ ঘন্টা ৫ মিনিটে আমরা পৌছে যাই কুনমিং। কুনমিং পৌছেই আমি আমার সেল ফোনে চায়নীজ সীম কার্ড লাগিয়ে নেই। ইমিগ্রেশনে
আমার কোন ঝামেলা হলোনা। দুই ঘুষখোরেরো কোন প্রব্লেম হলোনা। কারন তারা দুইজন সরকারী
কর্মকর্তা। তাদের সাথে জিও (গভরমেন্ট অর্ডার) ছিলো। সাইফুদ্দিনের পাসপোর্ট অনেক
বার ঊল্টে পালটে দেখলো। তারপর ওকে ডেকে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেলো। আমি কিছু বলার চেস্টা করলাম।
কিন্তু নির্বিকার ভাবে সাইফুদ্দিনকে তার পিছনে পিছনে যেতে বল্লো। সাইফুদ্দিনের সেই
অফিসারকে ফলো করার ছারা কোনই কিছু করার নেই! আমি যতই ইমিগ্রেশন কর্তপক্ষকে বোঝাতে
চেস্টা করবো-ততোই জটিলতা বাড়বে।
আমি সাইফুদ্দিনকে অভয় দিলাম।
সাইফুদ্দিন বেশ স্মার্ট
ছেলে। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স শেষ করে আমার কোম্পানীতে জুনিয়র এক্সকিকিউটিভ পদে জয়েন করে- চাকরী করা অবস্থাতেই মাস্টার্স এবং ঢাকা ভার্সিটি থেকেই এক্সিকিঊটিভ এমবিএ
করে। আমি অপেক্ষায় আছি
সাইফুদ্দিনের জন্য। ইতিমধ্যে আমি আমাদের স্পন্সর কোম্পানীর সাথে ফোনে কথা বলি। ওরা
জানালো কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। একজন অফিসারকে দেখছি সাইফুদ্দিনের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে এ টেবিল থেক অন্য টেবিল দৌড়াচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশী আরো ৪/৫ জন যাত্রীর একই
অবস্থা হয়েছিলো। প্রায়
২০ মিনিট পর সাইফুদ্দিন তার
পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে
আসে।
কুনমিং চায়নার ইঊনান
প্রভিন্সের ক্যাপিটাল সিটি এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন সিটি। চির বসন্তের দেশ
কুনমিং। সর্বোচ্চ ২০ ডিগ্রী এবং
সর্বোনিম্ন ৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা বিরাজ
করে। সারা বছর পর্যটকদের ভীর
লেগেই থাকে। জিনিষ পত্রের দাম অনেক। তবে তুলনামুলক ভাবে বাংলাদেশী খাবার খুব
সস্তা। ফুলের দেশ কুনমিং।হাল্যান্ডের পর একমাত্র কুনমিং একক ভাবে বেশী
ফুল ঊতপাদনকারী দেশ। এই কুনমিং থেকে চায়নার ব্যাবসায়ীরা ইঊরোপ সহ অন্তত ১৪ টি দেশে
ডাইরেক্ট ফুল রপ্তানী করে।আজকের
কুনমিং এর তাপমত্রা ১২
ডিগ্রী সেঃ। বেশ শীত পড়ছে। আমি, টমী-জিমী শীতের কাপড় বের করে পরে নিলাম। সাইফুদ্দীন একজন ন্যাচারাল বডি বিল্ডার-মূলত সব সময়েরমতই পেশী শো
করার জন্যই হালকা কাপড় পরেছিল-এখন শীতে কাঁই-কুঁই করছে! এয়ারপোর্টের ভিতরেই আমরা অপেক্ষায় আছি
পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য। আমাদের ট্রাঞ্জিট ফ্লাইট সাংহাই ছেড়ে যাবে স্থানীয় সময় রাত ৮ টায়।একটানা সোয়া
তিন ঘন্টার জার্নি। আমাদের সাথে
চায়নার সময়ের ব্যাবধান ২ ঘন্টা
বেশী এগিয়ে। অর্থাত-আমাদের যখন রাত ৮ টা, তখন চায়নায় রাত ১০ টা।
অপেক্ষা করছি পরবর্তী
ফ্লাইটের জন্য। আমি জানি টাইমিং এর কারনে এই রুটের প্লেনে হাল্কা খাবার ছারা কোনই খাবার
দিবেনা। আমাদের ফ্লাইট ডিনার টাইমের পর। আমরা ডিনার করে নিলাম। বোর্ডিং পাস নিয়ে আমরা প্লেনে বসেছি।এটা
অনেক বড় জাহাজ, বোয়িং ৭৪৭, ৪৪৫ সীটের উড়োজাহাজ। কোন ডমেস্টিক ফ্লাইটে এতো বড়
উড়োজাহাজ কল্পনাই করা
যায়না! সব সীট পরিপুর্ণ। গড়পরতা বাংলাবর্ণের আমরা ৪ জন বাংলাদেশী সহ
২০/২২ জন বিদেশী যাত্রী। অন্য সব
চায়নীজ। আমাদের ৪ জনকে ইয়াং ছেলে-মেয়েরা উইশ করছে। আমি Hanyu (চীনা) ভাষায় কথা বলায় ওরা আরো বেশী খুশী!
ওরা সবাই একচোট বেশ হৈ-হুল্লোর করছে। নাস্তা
পর্ব শেষ করেই ৯০% যাত্রী ঘুমিয়ে পড়লো-ওদের একযোগে ঘুমানো দেখে মনে হলো কোনো
ঘুমের মেশিন ওদেরকে ধাম করে ঘুম পারিয়ে দিল! বাকীদের কেউবা ম্যাগাজিন পড়ছে, কেউ ল্যাপ্টপে কাজ করছে। আমি
কুনমিং থেকে চায়না এক্সপ্রেস নামক কেনা একটা দৈনিক পেপারে চোখ বুলাচ্ছি
.........আমি ঘুমাইনা। আমি
কোন দিন জার্নিতে ঘুমাতে পারিনা-তাতে যত লম্বা এবং আরামদায়ক জার্নিই হোকনা কেনো। সাইফুদ্দিন কিছুটা অস্বস্থি বোধ করছে। এটা ওর প্রথম চীন ভ্রমন।
কুনমিং পৌছানোর পর থেকেই বলছে-“স্যার, চীন দেশটায় যেনো কি রকম একটা গন্ধ
লাগে”! আমি মনে মনে বল্লাম-“অপেক্ষা করো বাছা-গন্ধের দেখেছো কি”!
স্থানীয় সময় রাত সাড়ে
এগারটায় আমরা সাংহাই ল্যন্ড করি। সাংহাই ২ টা এয়ারপোর্ট। একটা পুডং ইন্টারন্যাশনাল
এয়ারপোর্ট, অন্যটা সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সাংহাই এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য আমার নাম সম্বলীত ব্যানার নিয়ে
অপেক্ষা করছিলো আমাদের স্পন্সর
কোম্পানী Shanghai Latex Co., Ltd. র GM Mr.
Feng, কোম্পানীর Export
Manager Miss Joeys. Miss Joeys আমাদের গাইড হিসাবেও থাকবেন-যে কয়দিন
আমরা সাংহাই থাকবো। উল্লেখ্য যে, চায়নার ওভারসীস/এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ১০০%
অফিসেই একজন/দুইজন করে সুন্দরী মহিলা সেক্রেটারী থাকেন-যিনি/যারা
বিদেশীদের সাথে সব ধরনের ব্যাবসায়ীক যোগাযোগ এবং এন্টারটেইন্মেন্ট
করেন। এরা বেশীর ভাগই সিংগাপুর, লন্ডন,
আমেরিকা থেকে লেখা পড়া শিখে আসা। অফিসের বাকীদের মধ্যে ইংলিশ জানে এমন লোক খুব কমই
আছেন। এখানে
যারা ইংলিশ জানেন তাদের ইংলিশ বলার মধ্যে চায়নীচ এক্সেন্স পুরোটাই।
তাই অনেকেই মজা করে চায়নীজ ইংলিশকে “চিংলিশ”
বলে। হোস্ট আমাদের নিয়ে সরা
সরি আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল Shanghai CCECC Plaza Hotel চলে
যায়। অস্ট্রেলীয়ান মালিকানাধীন এই ফোর স্টার হোটেলটা
একটা চেইন হোটেল। চায়নাতে এর ৬৬ টা ব্রাঞ্চ আছে। সারা
পৃথিবী জুড়ে আছে ১৫৫ টা ব্রাঞ্চ। আমার সীট ১৬ তলা
হোটেলের ১২ তলায়। আমার ফ্লোরেই সুইমিংপুল আছে। এই হোটেলে বোর্ডারদের জন্য মোট ৬ টা
সুইমিংপুল আছে। আমার কয়েকটি রুম পরেই সাইফুদ্দিনের রুম। তারপর দুই ঘুষখোরের জন্য একটা
ডাবল রুম। আমি টেকনিক্যালি তাদের ডাবল রুমে রেখেছি-কারন তাদের
স্বভাব আমি জানি......... কিছু বিজনেস টেকনিক্যাল
কারনে এই দু’টা
লোক বিষয় আমি তেমন কিছুই লিখবোনা। চেঞ্জ করে আমরা হোস্টদের আমন্ত্রনে হালকা কিছু
খাবার খেতে খেতে কালকের কাজের সেডিউল জেনে নিলাম। মিজ জয়েস এই হোটেলেই থাকবেন। কারন
তার বাসা এখান থেকে প্রায় ১৯০ কিঃমিঃ
দূরে-তাই এতো রাতে বাসায় ফিরবেননা। সকাল ৯
টায় মিজ জয়েস আমাদের নিতে অপেক্ষা করবেন। মিঃ ফেং চলে যান তার বাড়ী। আমরা ঘুমোতে
যাই। আমি আমার রুমে পৌছে সারা দিনের ‘কাজা’
নামাজ পরে ঘুমিয়ে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক সেই সময় মিজ জয়েস দড়জায় মৃদু নক করে
জানতে চাইলেন-“মিত্তার
কবির, দু ঊ ওয়ান্ট মাছাসী”?
আমি বল্লাম-“নো মিজ জয়েস, নো-থ্যাংস”।
জয়েস আবারো বল্লেন-“ইট ইজ অনার অব ঊ ফ্রম আওয়ার
কোম্পানী”।
আমি আবারো অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় করলাম।
বাহ,,,খুব ভাল লাগলো।।।
উত্তরমুছুন