মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

চায়নার ডায়েরী-৩



চায়নার ডায়েরী-
সাংহাই
২৯//২০০৭ইং 

সিকিউরিটি ফরমালিটিস শেষ করে আমরা জয়েসের পাশাপাশি হেটে ঢুকে যাই কোম্পানীর Board Chairman & CEO Mr. Yang Kang Yu’ চেম্বারেখুব হ্যান্ডসাম দেখতে, বয়স ৩৫ হতে পারে, আবার ৫৫ বছরো হতে পারে! খুব রাশভারী কিন্তু মিস্টি চেহারাজাপানী, চায়নীজদের আসল বয়স অনুমান করা খুব কঠিনমিঃ ক্যাং আমাদের সাথে খুব আন্তরিকতার সাথে হাত মেলালেনসাথে সাথে চায়নীজ প্রথামত আমাদের গ্রীন টি দিয়ে আপ্যায়ন করলেনভদ্র লোক আমাদের সাথে Hanyu(চায়নীজ) ভাষায় কথা বলছেনআমিও কিছু কিছু চায়নীচ ভাষা জানি বলে চায়নীজ ভাষায় রিপ্লাই করছি-তাতে ঊনি আরো বেশী খুশী হলেনতারপরো আমাদের ইন্টারপ্রেটর িসাবে মিস জয়েস কাজ করছেনআমাদের সব কথোপথোন মিঃ ক্যাং' লেডি সেক্রেটারী নোট করে নিচ্ছেন অপর দিকে সব কথা ভিডিও রেকর্ড হচ্ছে

১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের নিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকলেনআমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো আরো জন বিভিন্ন লেভেলের উচ্চপদস্থ্য অফিসারের সাথেটেবিলে অনেক ফ্রুটস সাজানোরান্ডম চলছে গ্রীন টি পান করাআমাদের দেশী মানুষদের(যারা সারাক্ষণ গ্রীণ টি পানে অভ্যস্থ নন) জন্য গ্রীন টি পানের জন্য ছোট্ট একটা টিপস দিচ্ছিঃ- আপনার গ্লাশ খালি হবার সাথে সাথেই ওরা পুনরায় আপনার গ্লাশ পুর্ণ করে দিবে নতুন গ্রীণ টি দিয়েকাজেই আপনি শরবতের মত শুধু গ্রীণ টি পান করে পেট ভরে ফেললে আর কিছু খেতে পারবেননাকাজেই ধীরে ধীরে একটু মুখে দিয়ে খাবার ভান করবেনগ্লাশের চা যেনো শেষ নাহয়। কারন গ্লাশের চা শেষ হবার সাথে সাথেই ওরা আবার গ্লাশ ভর্তি করে দিবেই! সব চায়নীজদের কাছে/ গাড়ীতে ্লাক্স ভর্তি গ্রীন টি থাকবেই

প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছে কন্ডম তৈরীর টু জেড প্রক্রিয়া, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, প্রিন্টিং,প্যাকিং ইত্যাদিশো দেখানো শেষ হতেই লাঞ্চ টাইম হয়ে গেলোঅফিসেই আমাদের লাঞ্চের ব্যাবস্থা করা হলোকারন আমাদের লাঞ্চের পর ওদের প্রজেক্ট প্রাক্টিক্যালি দেখার সেডিঊল আছেযার কারনে অল্প সময়ে লাঞ্চ শেষ করতে হবেম্যাগডোনালসের প্যকেট লাঞ্চ সরবরাহ করা হলোসাথে চায়নিজ বিয়ারচায়নিজদের অভ্যাস হলো-ওরা লাঞ্চ/ ডিনারের সময় রয়্যন্ডম সিগারেট ফুকতেই থাকেসিগেরেটের ধোঁয়ায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়! লাঞ্চ শেষে আমাদেরকে ওদের রেস্ট হাঊসের প্রতি জনকে আলাদা আলাদা রুমে ৩০ মিনিটের জন্য রেস্ট নেয়ার সুযোগ দিয়ে যে যার মত চলে যায়ক্লান্তিতে আমার শরীর ভেঙ্গে আসছিলোআমি ঘুমিয়ে পরলাম আমার রুমে

ঠিক ৩০ মিনিট পরেই জয়েস এসে রুমের দড়জায় নক করলোআমরা এখন ফ্যক্টরী ঘুরে ঘুরে েখবোএই ফ্যক্টরীটা কিলো মিটার জুড়েচায়নাতে সব বড় বড় ইন্ডাস্ট্রীগুলো অনেক বড় এরিয়া নিয়েইন্ডাস্ট্রী এরিয়াতে পার্ক, খেলার মাঠ, হেলথ ক্লাব, ক্লিনিক থাকা বাধ্যতা মুলকআর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলাই বাহুল্যএই সব সুযোগ সুবিধা না থাকলে ISO, FDA,GMP োয়ালিটি সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয় এবং এই কোয়ালিটি সার্টিফিকেট ছাড়া কোন প্রডাক্ট এক্সপোর্ট করা সম্ভব নয়ফ্যাক্টরী ঘুরে দেখার জন্য বেটারী চালিত একধরনের হুড তোলা গাড়ী চড়ে আমরা এক সেড থেকে অন্য সেডে যাচ্ছিএক একটা সেডে এক একধরনের কাজ হচ্ছেযখ যে সেডে ঢুকছি তখ সেই সেডে ঢোকার পুর্বে একটা বাথরুম ওয়েট/ ওয়িং মেশিনের মত দেখতে মেশিনের ঊপর দাড়াই-অমনি আমাদের ডিস্পোসাবল জুতা, পাজামা পরা হয়ে যায়! হাত উচু করে দাড়ালেই শার্ট পরা হয়ে যায়! ড্রেসটা পড়লে নভোচারীদের মতো লাগেআবার যখ দেখা শেষে বেড়িয়ে আসি-তখোন সেই ড্রেসটা নস্ট করে দেয়া হয়

আমরা কন্ডম তৈরীর বিভিন্নস্তর ঘুরে ঘুরে দেখছিকন্ডম তৈরী হবার পর প্যাকিংয়ের পুর্বে টি স্তরে কোয়ালিটি পরীক্ষা করা হয়প্রথমে ভিজুয়াল টেস্ট, তারপর এয়ার টেস্ট, এর পর ওয়াটার টেস্ট, ইলেক্ট্রনিক্যাল টেস্ট এবং সব শেষে লেজার টেস্ট করা হয়সব শেষে এক্সপোর্ট প্যাকিং এবং মার্কিং হয়চায়নার বেশীর ভাগ কোম্পানী যারা ম্যানুফ্যাক্সারিং করে তারাই এক্সপোর্ট করেনাএক্সপোর্ট করার জন্য অন্য কোম্পানী নিয়োজিত

আমাদের দেখা শেষবিকেল সারে চারটা বাজেওদের অফিস টায় শিপ্ট বদল হয়ে যাবেযারা নতুন শিপ্টে কাজ করবে তারা অফিসে ঢুকবেএই ফ্যাক্টরীটা ২৪ ঘন্টাই চলেএই ফ্যক্টরীতে সর্বোমোট ৪৪৫ জন কর্মচারী-কর্মকর্তাএখানে সবাই ঢোকার সময় একটা ইলেক্ট্রোনিক কার্ড(দেখতে অনেকটা আমাদের ভিসা/ক্রেডিট কার্ডের মত যা এখ আমাদের দেশেও অনেক অফিস/ ফ্যাক্টরীতে অমন ইলেক্ট্রোনিক পাঞ্চ মেশিন ইঊজ হচ্ছে)ডিজিটাল পাঞ্চ করে ঢোকে, আবার বের হবার সময়ও সেই কার্ডটা পাঞ্চ করে বের হয়

আমরা আবার ফিরে এলাম রেস্ট রুমেসবাই ওয়াস এন্ড ফ্রেস হয়ে বোর্ড রুমে যাইকিছু হাল্কা নাস্তা করে কালকের প্রোগ্রাম নিয়ে আলাপ করিচায়নার ঊন্নয়নের ঊপর একটা ডকুমেন্টারী ্লিম দেখি প্রজেক্টরেচায়নাতে কমন ডিনার টাইম শুরু হয় বিকেল/সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে রাত টা। তবে অনেক বড় বড় দামী হোটেলে গভীর রাত পর্যন্ত হোটেল খোলা থাকে...... আমাদের নিয়ে সারে ছয়টায় একটা দামী এবং অভিজাত রেস্টুরেন্টে যায়-যেখানে আমাদের জন্য আগেই বুকিং দেয়াছিলো

আমাদের যদিও সবার হাতে একটা করে খাবার মেনু লিস্ট দেয়া হয়েছিলোকিন্তু আমরা জানি-আগে থেকেই খাবারের মেইন ডিস অর্ডার দেয়া আছেআমরাও কিছু কিছু খাবার চুজ করলামসব চাইতে বড় অসুবিধা হলো-ওদের খাবারের নাম দেখে কিছুই আন্দাজ করার ঊপায় নেইকারন যে সব নাম দেয়া থাকে-তা সবি চায়নীজ নামওদেরকে কিছু জিজ্ঞাস করা মানেই নিজ মাথায় যন্ত্রনা বাড়ানো!

চায়নীজরা খুব বেশী অতিথি পরায়ন-যেমনটি আমরা বাংলাদেশীরাআমি অনেক দেশ ঘুরেছি-কিন্তু চায়নীজদের মতো কোথাও অতিথি পরায়নতা দেখিনিবিশেষ করে খাবারেখাবার টেবিল একের পর একধরনের ড্রীংকস দিয়ে ভরে ফেলল! সাথেতো সিগারেট আছেইকিছু সালাদতারমধ্যে পরিচিত পেলাম ছোট ছোট তরমুজ, শশা, লেটুস, বড় রশুন সিদ্ধবাকী সব অপরিচিতনানান রকমের স্যুপআগেই আমি বার বার জয়েসকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম-"পোর্ক" জাতীয় কোন খাবার যেনো আমাদের না দেয়া হয়আমি প্রণ (Shrimp) জাতীয় খাবার বেশী লাইক করি-তাও বলেছিলাম পদের স্যুপ এলো, ন্যুডুলস এলোআমি গোপনে গোপনে কনফার্ম হচ্ছিলাম-কিসের স্যুপজানালো সার্ক ফিনের স্যুপ, ছোট ছোট ঝিনুক উইথ মাশরুম স্যুপ, আর একটা প্রণ ঊইথ কর্ণ স্যুপআমি প্রণ ঊইথ কর্ণ স্যুপ নিয়ে সময় কাটাচ্ছিমাঝে মাঝে তরমুজের স্লাইস মুখে দিচ্ছি! ভীষন মিস্টি তরমুজ! একের পর এক খাবার আসতেই থাকলোআমি রাইস(রাইস না বলে নরম গলানো ভারী জাউ ভাত বলাই উত্তম) নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করি-মাঝে মাঝে মুখে দেইএবার এলো কঙ্গার (Conger) মানে সামুদ্রীক বাইম মাছআসলে ওটা বাইম মাছ নাওটা লো আমাদের দেশী কুইচ্চা সাপ। আমাদের দেশের সিলেট অঞ্চলে বেশী পাওয়া যায় এবং ওখানকার উপজাতীয়দের পছন্দের খাবারসব মিলিয়ে ৩০ টা আইটেমের কম হবেনা! আমি কোনটা থেকে একটু একটু মুখে তুলছি-আর সময় পার করছি চিকেন/ রাইস খেয়েচিকেন কাটার সাথে সাথে গল গলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে! ওরা সবাই গোগ্রাশে খাচ্ছেএমন কি আমাদের "সাইফুডিং" পর্যন্ত খাচ্ছে! টমী আর জিমীও খাচ্ছে, সাথে নাক ডুবিয়ে অনেক ড্রীংক করছে-আমি সাইফুডিংকে ইশারায় বেশী খেতে নিষেধ করলামচায়নিজরা প্রতিটা খাবার খাচ্ছে আর বলছে-"হাও জেইল, হাও জেইল" (মানে হলো-ভেরী নাইস, ভেরী নাই ...)আমি খাবার নেবার ভান করি কিন্তু খাইনাখাবার শেষ পর্যায় বিশাল একটা থালায় করে ধুমায়িত একটা খাবার নিয়ে এলোচায়নিজরা সবাই খুব খুশী হয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করলো-তার ভাবার্থ হলো-"মারহাবা! মারহাবা!!"- টাইপের! ঢাকনাটা সরানোর পর দেখলাম আস্ত একটা বিশাল মাছাছের বড় বড় দাঁতগুলো হা করে আছেমাছটার সেইপ্টা যদিও আস্ত কিন্ত ওটা স্লাইস করাচপসটীক দিয়ে ধরলেই টুকরো টুকরো হয়ে চলে আসেআমি চপ্সটীক দিয়ে খেতে পারিআমার অন্য তিন সংগী কাটা চামচ ইঊজ করছেআমাকে কোম্পানীর সি বল্লেন-"নিম চ্যাংচ্যাং"-মানে প্লীজ, হ্যাভ টেস্টি!আমিও আমার বৃদ্ধা আঙ্গুলটা উচিয়ে জিং (ok) বললাম-অর্থাত তাঁর কথায় সমর্থন জানালাম

আমি মাছটাকে চিনলামএটা হলো ব্যারকুডা (Barracuda), ক্যারাবিয়ান সাগরে পাওয়া যায়-খুব হিংস্র এক ধরনের মাছ! আমি জানিনা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের মানুষ এই মাছ খায় কিনা! তারপর িয়ে আসে অন্য রকম একটা আস্ত সামুদ্রীক প্রানীর রোস্টদেখতে শুশকের মত! নাম পপাস ইয়া

খাবার শেষ পর্যায়এবার এলো ছোট ছোট বাটিতে অল্প করে একটা খাবারআমি মনে করলাম-দৈ/ মিস্টি বা আইস্ক্রীম জাতীয় কিছু হবেপ্রথমে আমি খাবারটা কিছুতেই  চিনতে পারছিনাদেখতে কিছুটা ছাগলের আস্ত মগজের মত মনে হচ্ছে, কিছু রক্ত বেয়ে বেয়ে বেড়িয়ে আসছেনাকের কফ কিম্বা বুড়ো মানুষের সর্দি/কাশির মত একটা আটালো পদার্থ লেগে আছে!  আমি জয়েসকে জানতে চাইলাম-এটা কী? জয়েস বিশাল একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো-এটাও তোমাদের সৌজন্যে-খুব ডেলিসিয়স খাবার-"স্টীম পিগ ব্রেইন"!

আমি জয়েসকে বল্লাম-"আমি তোমাকে বার বার বলেছিলাম-আমাদের কে যেনো পর্ক জাতীয় খাবার না দেয়া হয়"!

জয়েস খুব সুন্দর করে, অবাক হয়ে বল্ল-"এটাতো পর্ক নয়,বেবী পিগ ব্রেইন (বেবী শুকরের মগজ)"! "হাওছি! হাওছি"!!(Delicious! Delicious!!)

বাকী লেখা আগামী কাল পড়ুনঃ-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন