বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

চায়নার ডায়েরী-৯



চায়নার ডায়েরী-৯
নানটং
০৩/৯/২০০৭ইং 

সকাল ছয়টার সময় আমরা জীপ গাড়ীতে নানটং রওয়ানা করি। নানজিং থেকে নানটং এর দুরত্ব প্রায় ৩০০ কিঃমিঃ। নানটংও নানজিং এর মত জিয়াংসু প্রভিন্সের একটা অত্যাধুনিক সিটি।খুব সাজানো গোছানো সিমসাম সিটি নানটং।এ টা একটা কোস্টাল টুরিস্ট সিটি। আমার দেখা চায়নার অন্যতম সুন্দর সিটি নানটং। এখানেই জন্ম নিয়েছেন চায়নার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমীন। আমি চায়নার অনেক কোমপানী থেকে শুধু ইমপোর্ট করি, কিন্তু শুধু মাত্র ডেনিয়েলের কোম্পানীতেই এক্সপোর্ট এবং ইম্পোর্ট করি গত ৬/৭ বছর যাবত। আমি গত সাত বছরে নানটং এসেছি আট বার। আগে নানজিং থেকে নানটং যেতে সময় লাগতো চার ঘন্টা। এখন লাগে ২ ঘন্টা। নানজিং এবং নানটংয়ের মাঝে বিশাল একটা নদী আছে। নাম- ইয়াংসু/ ইয়াংবেজ রিভার। এটা ভয়ংকর উত্তাল একটা নদী-যা চীন সাগরের একটা শাখা নদী। আমরা আগে যেখানটায় ফেরী পার হতাম-সেখানে এই নদী চওড়া ছিল ১২ মাইল।এখন সেখানে ব্রীজ হয়েছে। যার নাম ইয়াংবেজ ব্রীজ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পরীক্ষামূলক চালু হয়েছে এই ব্রীজ-আগামী বছর বানিজ্যিক ভাবে এই ব্রীজ চালু হবেএটা এখন চায়নারই শুধু নয় এশিয়ার সব চাইতে বড় ব্রীজ। সম্ভবত পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম ব্রীজ।

ডেনিয়েল ড্রাইভ করছে। আমি তার পাশের সীটে। পিছনে সাইফুডিং এবং ডেনিয়েলের লেডি পিএস লী ঊই কাই। আমরা ডাকি কাই। মাঝে মাঝে আমি মজা করে বলি তোমাকে খাই- আমি কাইকে বুঝিয়ে বলেছি-তোমাকে খাইয়ের মানেটা! ডেনিয়েল এই কম্পানীতে জব করে জিএম হিসেবে। এখানে জিএম হলো কম্পানীর ডেপুটী চীপ।এমন কি কোথাও কোথাও জিএম একই সাথে কোম্পানীর মালিক/সিইও হয়। কম্পানীর মালিকের নাম Jawo Jia Bing। ডেনিয়েল নানটং ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করে মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল বিজিনেস স্টাডিজে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এই কম্পানীতে ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করেছিল।নিজ যোগ্যতায় ৮ বছরে জেনারেল ম্যানেজার হয়েছে।

হাইওয়েতে মাঝে মাঝে খুব সুন্দর সুন্দর মোটেল আছে।ওয়াশ এন্ড ক্লিনের অত্যাধুনিক ব্যাবস্থা আছে। আরো আছে উন্নত মানের খাবারের রেস্টুরেন্ট। ডেনিয়েল এক যায়গায় গাড়ী থামালো আমাদের কিছু খাওয়ানোর জন্য। আমি বললাম-রোজা রেখে কিছু খাওয়া যাবেনা। কিন্তু ডেনিয়েল নাছোর বান্দা-অন্তত কিছু হলেও খাওয়াবে! আর কিছু না হোক অন্তত ফ্রুটস, কেক খাও, নাহলে দুধ খাও............- এমন সব আন্তরিক বায়না!

আমরা আবার চলছি নানটংয়ের উদ্দেশ্যে। আমি ডেনিয়েলকে আবারো ব্যাখ্যা করলাম রোজা বিষয়। ব্যাখ্যা করলাম আমাদের ধর্মীয় বিষয়। সাথে সাথে ডেনিয়েল গাড়ীটা দাড় করিয়ে উচ্চ শব্দ করে বলে উঠলো(ইউরেকা, ইউরেকা ভাব)-
মিঃ কাবির, নাউ আই য়্যাম ভেরী ক্লিয়ার! আই আন্ডারস্টান্ড, আই নো ফুসা, ফুসা!!বুড্ডা, বুড্ডা!!
হি ইজ ভেরী ক্লেভার এন্ড বিগ ফাকার (fucker)!
হি ইজ ইল ফেইম ফাকার!!

প্রিয় পাঠক, ডেনিয়েল যা বুঝেছে-সে সম্পর্কে আপনাদের ক্লিয়ার করছিঃ-কয়েক শত বছর পুর্বে চীন দেশে বুদ্ধ ধর্মাম্বলীর একজন ধর্ম যাজক ছিলেন তার নাম ফুসা।চীনারা তাকে কংও বলে। সে এবং তার অনুসারীরা সাধারনত উচু পাহাড়ের উপড়ে, সাগর/নদীর তীরবর্তী এলাকার নির্জন স্থানে অনেক উচু দালান করে ধর্ম সাধনা/প্রচার করতো(এখানে উল্ল্যখ্য যে-পৃথিবীর সব ধর্ম যাজকরাই অমন নিরিবিলি যায়গা ধর্ম সাধনার জন্য বেছে নিত)।সেই সব দালানে অনেক গুলো ছোট ছোট রুম থাকতো। ঐ সব রুমে নাকি সুন্দরী নারীদের নিয়ে ফুর্তি করতো...প্রথমে ফুসা পরে তার সাগরেদরা.......। সেই সব ধর্ম যাজকদের প্রচন্ড ক্ষমতা থাকতো রাস্ট্রীয় সব ব্যাপারে। তারা সাধারন মানুষ তথা প্রজাদের ধর্মীয় নেশায় বশ করে রাখতো।যার জন্য প্রজারা উতপাদনশীল তথা রাস্ট্রীয় কাজে মনোযোগ দিতোনা। ফলে চীন দেশ উন্নয়ন থেকে খুব পিছিয়ে পরেছিল! কমুনিস্টরা ধর্মকে তুলোনা করতো আফিমএর সাথে। আফিম খেয়ে মানুষ যেমন বেহুশ হয়ে থাকতো-তেমনি ধর্ম যাজকগন মানুষদের ধর্মীয় নেশায় কর্ম বিমুখ করে রাখতো। মাও সে তুং এর ঐতিহাসিক লং মার্চের পর থেকে চায়নাতে সকল প্রকার ধর্মীয় প্রথা ব্যান করা হয়। সকল উপশানালয় ধংশ কিম্বা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখনো চায়নাতে অনেক যায়গায় সেই সব টেম্পল আছে। যা এখন দর্শনীর বিনিময় দেশী বিদেশী পর্যটকদের দেখানো হয়। ফুসা হলো তেমন একজন ধর্ম যাযক! ডেনিয়েলের ভাষায়- হি ইজ ভেরী ক্লেভার এন্ড বিগ ফাকার (fucker)! হি ইজ ইল ফেইম ফাকার!!
 নানটং তেমন একটি বিখ্যাত বুদ্ধিস্ট টেম্পল আছে-যা আমি দেখেছি। সেখানে ফুসার স্বর্ন নির্মিত বিশাল মুর্তি আছে। বিদ্গুটে রাক্ষুইস্যা চেহারা! সেই ফুসার মুর্তি দেখে আমি অনেক রাত ভয়ে ঘুমাতে পারিনি! সুযোগ পেলে সেই বিষয় অন্য কোন সময় লিখবো।

আমি আবারো ডেনিয়েল কে বুঝিয়ে বললাম-আমাদের ধর্ম-তোমার সেই ফুসা নয়............ আমার কথা শুনে অনেক্ষন চুপ করে থেকে বল্ল-তোমাদের রোজা খুব অমানবিক!

আমরা ২ ঘন্টায় নানটং পৌছে যাই। আমাদের জন্য নানটং হোটেলে বুকিং ছিল। আমরা কিছুক্ষনের জন্য হোটেলে যাই। চেঞ্জ হয়ে আধা ঘন্টা রেস্ট করে ডেনিয়েলের সাথে চলে যাই ওর ফ্যাক্টরিতে। আমি আমাদের দেশ থেকে পেট বোতল স্ক্রাপ/ফ্লেক্স রপ্তানী করি ডেনিয়েলের কম্পানীতে। পেট বোতল হল-আমরা যেসব প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যাবহার করি সেগুলো। এগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন কোয়ালিটি আছে। যেগুলো আগুনের তাপে পুড়ে যায় সেগুলো তেমন একটা রপ্তানী করা যায়না। যেগুলো আগুনের তাপে গলে যায়-সেগুলো খুব দামী এবং চাহিদা পুর্ন। পানি খেয়ে ফেলে দেয়া সেই বোতলগুলো টোকাইরা নিয়ে ভাঙ্গারী দোকানে বিক্রি করে দেয়। তাদের কাছ থেকে ছোট বড় মহাজনেরা কিনে বড় আড়তদারের নিকট বিক্রি করে। অনেকগুলো হাত হয়ে ইউজড বোতলগুলো চলে যায়  স্ক্রাপ রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরীতে। স্ক্রাপ ফ্যাক্টরী বোতলগূলো বায়ারের অর্ডারমত ফ্লেক্স তৈরী করেআমরা প্রতি টোন পেট ফ্লেক্স কোয়ালিটি ভেদে টন প্রতি ১৪০০/১৫০০ ডলারে রপ্তানী করি ডেনিয়েলের কম্পানীতে।২০০২ সনে বাংলাদেশ থেকে আমিই সর্ব প্রথম অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে পেট ফ্লেক্স বিদেশে রপ্তানী করি। আমার সাথে ডেনিয়েলের এগ্রীমেন্ট আছে মান্থলী মিনিমাম ২০০ টন সাপ্লাই করতেই হবে। আমি আমার টার্গেট পুরন করতে পারি।ওরা এগুলো দিয়ে একধরনের সিন্থেটিক্স ফাইবার/ষ্টাপল ফাইবার তৈরী করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করে। অপর দিকে আমি ডেনিয়েলের অন্য একটা কম্পানী থেকে নিয়মিত ইম্পোর্ট করি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট।

পেট ফ্লেক্স ব্যাবসায় এখোন আমাদের অনেক কম্পিটিশন। আমাদের দেশের ব্যাবসায়ীদের একটা অভ্যাস আছে-যে কেউ, যেকোনো ব্যাবসায় কিছুটা ভাল করবে-তাকে প্রতিদন্দীরা যেকোন হীন চক্রান্তে ক্ষতি করে ব্যাবসার ভরা ডুবি করানো। আমিও সেই চক্রান্তের শিকার! অসুস্থ্যতার জন্য আমি বহু দিন ব্যাবসায়ে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। এই সুযোগে আমার প্রতিদ্বন্দীরা অসাধু লেবার দিয়ে আমার রপ্তানীর জন্য রেডিঙ্কন্সাইন্মেন্টের ভিতর নিম্ন মানের পেট ফ্লেক্স এবং বস্তার ভিতরে মাটি, ইটের টুকরা সহ অন্যান্য বাজে জিনিষ মিশিয়ে দিয়ে শিপমেন্ট করে দেয়! তাছারাও সবগুলো কন্টেইনারেই ওজনে কম ছিল(এগুলো চট্টগ্রাম পোর্টের সেডে খারাপ লোকদের টাকা দিয়ে করানো হয়েছিল)।যার কারনে ইম্পোর্টার আমার ঊপড় নাখোশ হয়।
যেহেতু আমার পারফর্মেন্স বিষয়ে ডেনিয়েল জানে এবং তাদের সাথে আমার অন্য বিজনেস আছে-তাই দয়া পরশ হয়ে আমার সাথে এগ্রীমেন্ট ক্যান্সেল না করে সরেজমিনে ঐ সব দেখে একটা সিদ্ধান্ত দেবার জন্য আমাকে তার ফ্যাক্টরীতে ইনভাইট করে। আল্লাহর অসীম রহমতে আমি ঝামেলাটা খুব সুন্দর ভাবে ওভারকাম করতে সক্ষম হই।

সব চাইতে মজার এবং খুশীর খবর হলো- যারা আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো-ডেনিয়েল তাদের সাথে সব কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল করেছে। আগে আমি মান্থলী ২০০ টন সাপ্লাই করতাম, এখন আমাকে ৪০০ টন (বাংলাদেশ থেকে সর্ব সাকুল্যে ৩০০০ টন ফ্লেক্স এক্সপোর্ট হয়)পেট ফ্লেক্স সাপ্লাই করার অর্ডার দিয়েছে এবং রেট টন প্রতি ১২ ডলার বাড়িয়ে দিয়েছে!

1 টি মন্তব্য: