মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(শেষ র্পব)


নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(শেষ র্পব)

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৫: ৩৬, ২৫ জুন, ২০১১

নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(শেষ র্পব)

জনস্বাস্থ্যের পক্ষে রিকশা খুবই ক্ষতিকারক। আপনি ঘর থেকে বের হয়েই রিকশায় উঠে কোথাও রওনা দিলেন, একটু পথও পায়ে হাঁটলেন না। একইভাবে রিকশায় চড়ে আবার বাসায় ফিরলেন। নাগরিক জীবনের এ ব্যস্ততার মধ্যে দৈহিক কসরত করার সময়টা কোথা আপনার? এ রিকশা না থাকলে অন্তত বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আপনি পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হতেন এবং দৈনিক এক দুই কিলোমিটার হাঁটার জন্য আপনার স্বাস্থ্যটা সতেজ হবার সুযোগ পেত। স্কুল-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীরা সাইকেলে চড়ে আসা-যাওয়া করার সুযোগ পেত। জনস্বাস্থ্য উন্নত সবল হবার সুযোগ পেত। গণচীনের মানুষের, বিশেষত তরুণ-তরুণীদের, গড় স্বাস্থ্য দুনিয়ার যে কোন দেশের তুলনায় অনেক ভাল। কারণ তারা বেইজিং-বাওচিতে নাগরিক জীবনে শতে শতে হাজারে সাইকেলে চড়ে স্কুল-কলেজ, অফিসে আদালতে যাতায়াতে করছে। আর আলাদা করে স্বাস্থোন্নতির জন্য ভ্রমণের তাদের প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় না। 

পরিবেশ দূষণের দুটো মাত্রা: স্থানিক ও আন্তর্জাতিক। উভয়েই প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট। আমাদের স্থানিক দূষণের মধ্যে রয়েছে নগণ্য শিল্পজাত ও কৃষিজাত কার্বন নিঃসরণ। এ দূষণ সৃষ্টিতে আমাদের মত ঔপনিবেশিক শক্তি শাসিত ও শোষিত অনুন্নত এবং কেবল সেদিন স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের আন্তর্জাতিকমানে দূষণ অবদান নেগেটিভই। বড় মাপের আধুনিক কোন কলকারখানা আমাদের নেই, যা মারাত্মক ও তেজষ্ক্রিয় গ্যাস নি:সরণ করে পরিবেশ দূষণ ঘটাবে। আমরা আরও বর্তমান হারে শত বছর দূষণ ঘটালেও শিল্পোন্নত দেশের একদিনের দূষণের সমান অবদান রাখতে পারব না এবং আমাদের সব দূষণ যোগ করলেও আমাদের কোটা খালি থাকবে। সুতরাং বৈশ্বিক দূষণের ডামাডোলে বিভ্রান্ত হবার অবকাশ আমাদের আছে বলে মনে হয় না। 

দূষণ কখনও ভৌগোলিক সীমান্তে বন্দি থাকতে জানে না, তা গ্যাসীয়, তেজষ্ক্রিয় বা পারমাণবিক যা-ই হোক না কেন। আমরা যে দূষণের অভিঘাতে আক্রান্ত তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক দূষণ, যা সীমান্ত পার হয়ে আমাদের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আঘাত হানছে এবং উপরি বায়ুমন্ডলের কাঠামোর পরিবর্তন ঘটিয়ে সামগ্রিক জলবায়ুকে প্রভাবিত করে আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলছে। পরিবেশবাদী বিজ্ঞানীরা গত এক দশকেরও অধিক সময় ব্যাপী বলে আসছেন ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে মেরু বা পার্বত্য বরফ গলে সমুদ্রতলে উচ্চতা বাড়িয়ে মালদ্বীপের ৮০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে দেবে। আর বন্যা ও নানা প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের কারণে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি হবে ৩০ থেকে ৪৭ লাখ টন প্রতি বছর। এ ছাড়া দেশের মোট আয়তনের ১৪ ভাগ উপকূলীয় এলাকা স্থায়ী বা অস্থায়ী জলমগ্ন হবে। ফলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ছিন্নমূল হবে এবং এদের দুঃখদুর্দশা হবে বর্ণানাতীত। কক্সবাজার থেকে খুলনা পর্যন্ত ১৩টি জেলা সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। এ কারণেই বাংলাদেশ দুনিয়াতে সবচে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে বলা হচ্ছে। এর বাস্তবতা ইতোমধ্যে প্রতিফলিত হতেও শুরু করেছে। এটি রূঢ় বাস্তব হয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কিন্তু এটিই সত্যি যে, আগামী দিনগুলোতে আমরা আমাদের সব কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়ে আমাদের দূষণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনলেও এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারব কি? মোটেই না। কারণ এ সর্বগ্রাসী দূষণের উৎস আমাদের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। 

তা হলে মরার আগে আমরা মরি কেন? সম্ভাব্য আপদ মোকাবিলা করার জন্য আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেব। উন্নয়ন কাজকর্ম ত্বরাণি¦ত করে, জনগণকে সম্ভাব্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করি না কেন? আমরা আমাদের দেশের এক বিরাট যুব শক্তিকে রিকশা চালাবার মত অনুৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করে তাদের সম্ভাবনাকে হত্যা করছি কেন? প্রত্যেকটি জীবন সম্ভাবনাময়ী। তাকে বিকশিত হতে দিতে হবে। আর সমাজ বা সরকারের কাজ হল জনগণের জীবন বিকাশে সহায়কের ভূমিকা পালন করা। আমরা তা না করে কর্মসংস্থানের নামে তাদেরকে উৎসাহিত করছি রিকশা টানার মত অমানবিক কাজে। রিকশা টানতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে একজন লোক তার জীবানু শক্তি ক্ষয় করে চলছে। এ নিবন্ধ লিখতে গিয়ে আজ আমি স্মরণ করছি আমার গ্রামের রিকশাচালক খালেক, মামুদল হক, মালেক ও আবদুল হককে। চারজনই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যায় রিকশা টানতে টানতে। একবিংশ শতাব্দিতে রিকশা টানার মত কাজ এ কারণে মানবাধিকার বিরোধী। 

রিকশার প্রচলন আছে এশিয়ার অনেক দেশে। তবে সেটি অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। ভারতের কলকাতা থেকে বামপন্থী সরকারও অবশেষে রিকশা তুলে দিয়েছে। গণচীনের বেইজিং, বাওচি ইত্যাদি শহরেও রিকশা টানা আমি দেখেছি। সেখানে আধা কিলো কি এক কিলোর মত বাই-লেনের মধ্যে বয়স্ক লোকেরা রিকশা টানে সাবসিডি অর্জনের জন্য। কেউ বাস/ট্রাম থেকে নেমে বাসায় যাবার পথে হাতের ঝুড়িটি নিয়ে রিকশায় চেপে অদূরের বাসার সামনে গিয়ে এক ইয়োয়ান দিয়ে দিল। কখনও প্রধান জীবিকা হিসেবে রিকশা টানে বলে আমার মনে হয়নি। 

এমতাবস্থায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরের রাস্তা, বিশেষত, রাজধানী ঢাকার রাস্তা কি অনির্দিষ্ট কাল যাবৎ এভাবে রিকশাকবলিত থাকবে? আমরা কি কোটি কোটি ডলার ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে এ মুহূর্তেই উড়ন্ত পথ বা পাতাল পথ তৈরি করতে পারব? এ ধরনের একটা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিলেও বাস্তবায়নে যে সময়, শ্রম ও শক্তির প্রয়োজন হবে তা বাংলাদেশকে ভয়ানক চাপের মধ্যে ঠেলে দেবে বলে আমাদের আন্দাজ। আবার সারা শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলোকে যতক্ষণ এ ধরনের উড়ন্ত বা পাতাল পথ-নেটওয়ার্কের আওতায় না আনা হচ্ছে ততক্ষণ একই সমস্যা আমাদের সামনে বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে হাজির হবে বারবার। মহাখালী বা খিলগাঁওয়ের অভিজ্ঞতা তো আমাদের সামনেই আছে। আমাদের প্রাপ্য সম্পদকে সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদেরকেই এ সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। 

এ সকল কারণেই আজ হোক, কাল হোক, ঢাকার রাস্তা থেকে রিকশা তোলার বিষয়টা একটা অনিবার্য বিষয় বলে মনে করি। কাউকে না কাউকে, এ উদ্যোগটি নিতে হবে। যিনিই নেন না কেন, বিশাল অঙ্কের ভোটের ঝুঁকি আছে। তবুও গণতান্ত্রিক সরকারেরই কাজ এটি। বিরাটরকমের সংস্কার করার মত বিপুল প্রাণশক্তিসম্পন্ন গণতান্ত্রিক সরকার এখন ক্ষমতায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক মঙ্গল, যুবশক্তিকে সত্যিকার সম্পদে পরিণত করা এবং সর্বোপরি ঢাকাকে যানজট ও রিক্সামুক্ত করে দুনিয়ার বুকে একটা সুন্দর ও সাবলীল গতির শহরে পরিণত করার মত মেধা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁর আছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর আগামী সাড়ে চার বছরের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে পর্যায়ক্রমিক সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে রিকশাজীবী পুনর্বাসন ও উপযুক্ত যানবাহন প্রতিস্থাপন করে রাস্তা থেকে রিকশা তুলে দেয়া তাঁর পক্ষেই কেবল সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন