ব্লগীয় ঈদের শুভেচ্ছাঃ
৬/৭ বছর পুর্বে আমি ঈদ কার্ড পেতাম অন্তত পক্ষে ৭০/৭৫ টা। আস্তে আস্তে ঈদ কার্ডের সংখ্যা কমে যেতে থাকলো। এবছর ঈদ কার্ড পেয়েছি মাত্র ৮ টা। কিন্তু এস এম এস পেয়েছি দুই শতাধিক! সময়াভাবে অনেক এস এম এস পড়া যদিও কস্টকর তবুও চেস্টা করি এস এম এস পড়ে রিপ্লাই করতে। আমার আজকের লেখাটা এস এম এস সংক্রান্ত।
আমার কাছে জীবনভর ঈদের দিনটা খুব বেশী বোরিং! এই বোরিংনেসের কারন অত্যন্ত কস্টের! একান্তই ব্যাক্তিগত কারনে আমি কোন ঈদের দিন, ঈদের কোন রান্না খাইনা। যাই হোক- সামহ্যোয়ারইন ব্লগারদের থেকে আমি এসএমএস পাই ৪৬ টা। আমি সেন্ড করে ছিলাম ১৮ টা। সামহ্যোয়ারইনে আমি যাদের এসএমএস করি তাদের ভিতর শুধু মাত্র কৌশিক এসএমএস'র রিপ্লাই করেনি। কিন্ত আমি রিপ্লাই করি সকলকেই। আমি নামাজ পড়ে এসএমএস নিয়েই সময় কাটাই। আমার ঈদের অশান্তি নিয়ে বাড়ীর সবাই অবগত-তাই কেউ আমাকে এই নিয়ে বিরক্ত করেনা কোন সময়।
সামহ্যোয়ারইন ব্লগারদের ভিতর থেকে আমি প্রথম এসএমএস পাই নিশাচর থেকে। নিশাচর চমতকার এসএমএস লিখেছিলেন। বেশ কবার কল করেছিলেন। একবার অনেক্ষন কথা বলে কথা শেষ করি। তারপর সাথে সাথেই হন্ত দন্ত হয়ে কল করে বলেন-"ভাইয়া, মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে"! আমি এক্টুখানি ভড়কে যেয়ে জানতে চাই-"কি হয়েছে ভাইয়া"? নিশাচর বল্লো-"ভাইয়া, আপনাকে 'পিলাস' দেয়া হয়নি"! আমি হাহাচেথেপযা(এই এভ্রীভারেশন্টা আমার নিজের নয়, একজন ব্লগারের)!
কালপুরুষ ভাই, তানভীর সজিব, আনিসুজ্জামান উজ্জ্বল, শফিকুল,মিল্টন সহ অনেকেই খুব সুন্দর সুন্দর এসএমএস পাঠায়।মেজবাহ যায়াদ ভাই চমতকার একটা এস এম এস সেন্ড করেন। তা হলো-"সব সময় ভালো থাকার দরকার নাই, জীবনের বেশীর ভাগ সময় ভালো থাকলেই হবে"! মেজবাহ যায়াদ ভাইর রশোবোধের প্রসংশা না করে পারা যায়না। আমার কাছে মনে হলো-এটাই ঈদ!
জানা আপু চমতকার একটা এস এম এস পাঠিয়েছিলেন-যা আপনাদের সাথে শেয়ার না করলে 'পাপ' হবে। ঈদের খুশী পুর্ণতা পাবেনা।"বাবুয়া ভাই, আপনাকে "পিলাস"!!! ছোট্ট একটা এসএমএস কিন্তু আন্তরিকতা এবং রশোবোধের প্রান প্রাচুর্য্য!
অনেক জন ব্লগার বন্ধু কল করেছিলেন। অনেক্ষন কথা বলেছি। অন্যতম প্রিয় ব্লগার ফরহাদ উদ্দিন স্বপন ভাই যখন কল করেন-তখন আমি আমার বৌ,বাচ্চাদের এবং বড় ছেলের বন্ধুদেরকে নিয়ে আমার ফুফা-ফুফুর সাথে আমার হাউজিং ঘুরে দেখছিলাম। যার কারনে কথা বলতে পারিনি।আমাদের সকলের অতি প্রিয় "চিকন মিয়া" কল করে জানায়-সে কোন টেকনিক্যাল কারনে এসএমএস সেন্ড করতে পারছেনা!
এই দিন বেশ কয়েক বার আমাকে কেউ একজন মিস কল দিচ্ছিলো। আমার পরিচিত না হলে কোন সময়ই আমি মিস কল এটেন্ড করিনা অর্থাৎ কল ব্যাক করিনা। আবারো ঐ নম্বর থেকে কল আসে। আমি "হ্যালো" বলার পর কোন কথা বলেনা! ...... আমি কেয়ার করিনা।
অনেক্ষন পর ঐ নম্বর থেকে একটা এস এম এস পাই। লেখা-"অনেক কস্টে তোমার সেল ফোন নম্বরটা পেয়েছি। আমি জানি, তুমি আমাকে চিন্তে পেরেও না চেনার চেস্টা করছো- যা স্বাভাবিক! আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই, আমি কেমন আছি বলতে চাই, তুমি কেমন আছ জানতে চাই"!
আমি অবাক হয়ে ভাবছি- কে আমাকে এমন এসএমএস করতে পারে! আমি আমার জীবনের ফেলে আসা নানান বিশয় নিয়ে ভাবছি। ছোট-খাট ভালো লাগা, বুকের ভিতরে পুঞ্জীভুত হারিয়ে যাওয়া কস্টের দরিয়ায় "খানা তল্লাশী" চালাচ্ছি-কে তুমি? মিলাতে পারছিনা কোন কিছুতেই! আমি আমার প্রথম ভালোবাসায় ফিরে যাই। তখন আমার বয়স মাত্র ১৬ তে পড়েছে। এইচ এস সি ২য় বর্ষের ছাত্র। কলেজ ছুটিতে বাড়ি ফিরি। আমার ঝিনেদাহ ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন করিমুদ্দীন (মরহুম)স্যার আমাকে কলেজ ছুটির পুর্বেই জানিয়ে দিলেন কর্নেল ............ চৌধুরীর কণ্যাকে পড়াতে হবে। ব্লগার বৃন্ধ, আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি-আমি আমার বয়স ১০ বছরের পর এমনকি ছাত্রাবস্থায় আমার বাবার কাছ থেকে কোন ফিনান্সিয়াল হেল্প নিয়ে পড়া লেখা করিনি। আমি প্রাইমারি, জুনিয়ার বৃত্তি পরীক্ষায় স্কলারশীপ পাই, এস এস সি, এইচ এস সি'তেও স্কলারশীপ পাই...... ক্লাশ এইট থেকে কলেজ ছুটিতে আমি টিউশনী করি নিজের পকেট মানির জন্য। আমার পারিবারিক অশান্তির কথা কলেজ কর্তিপক্ষ জানতেন। তাই তাঁরা আমাকে অনেক ভাবে হেল্প করতেন, এমনকি কলেজ ছুটিতে টিউশনী পেতেও। ক্যাডেট কলেজে পড়া লেখায় প্রচন্ড চাপ। তাই সব ক্যাডেট'রা ছুটির সময় নামী দামী স্যারদের কাছে পড়ে পড়া লেখায় অনেকটা এগিয়ে যেতো। আমি তখন আমার পড়ার খরচ যোগাতে টিউশনী করতাম।
ক্যন্টনমেন্টের অলি-গলি, প্রতিটা বাড়ী আমার চেনা। আমার বাবাও একজন উচ্চ পদস্থ্য বিমান বাহিনীর অফিসার এবং ক্যান্টনমেন্টের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সকলের পরিচিত-সেই সুবাদে অনেকেই আমাকে চিনেন এবং আমার পারিবারিক অশান্তির বিষয় অনেক সেনা অফিসার পরিবারে জানেন। যথা রিতি আমি পড়াতে যাই শহীদ বাসার রোডে কর্নেল ...... এর বাসায়। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা দুই বোন এক ভাই। আমি ছোট ২ জনকে পড়াই। একজন ক্লাশ সিক্স অন্য জন ক্লাশ সেভেনে পড়ে। বড় বোন মুনিয়া (মনে করা যাক-এটা তার ছদ্দ নাম)আমার ছাত্রী নয়। সে ক্লাশ নাইনের ছাত্রী। কিন্তু অনেকটা কাকতালীয় ভাবে তার সাথে আমার একটা মেন্টাল রিলেশন গ্রো করে। আমার এইচ এস সি পরীক্ষার পর আমাদের সম্পর্কের বিশয়টা তার পরিবারে ওপেন সিক্রেট হয়ে যায়। আমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার চিঠি লিখি তাকে। সেও আমাকে। আমাদের সময় ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েই যারা আর্মী অফিসার হতে ইচ্ছুক তারা ডাইরেক্ট আইএসএসবি (ইন্টার সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড)পরীক্ষা দিতে পারতো। আমিও যথারিতি টেন্থ লং কোর্সে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আর্মী অফিসার হিসাবে দুই বছরের প্রশিক্ষণ নিতে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীতে চলে যাই।
আমি ছেলে বেলা থেকেই কারো সাথে মিশতে পারতামনা। একা থাকতে লাইক করতাম। আমার পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে মুনিয়াই আমার জীবনে প্রথম পরিচিত মেয়ে ছিল-যার সাথে আমি কথা বলেছিলাম। তাকে আমি খুব সাধারন তিনটা চিঠি লিখেছিলাম। সেও আমাকে সাদামাটা আটটা চিঠি লিখেছিলো। আমি তার সাথে দেখা করেছি বেশ কয়েক বার। তাকে অনেক বার ফোন করে কথা বলেছি। তখন সেনা অফিসারদের ফোন ছিলো হাতে গোনা কয়েক জনের বাসায়। তাও আবার পি এ বি এক্স লাইন। কাজেই কথা বলার মাধ্যমেও ভালোবাসার প্রকাশ ছিলো অত্যন্ত সাদামাটা-"ইয়েস-নো-গুড" টাইপের। আমি ছোট বেলা থেকেই রোজা নামাজ করতাম এবং ক্যাডেট কলেজে তা ছিলো বাধ্যতামুলক। আমি তাকে লিখে এবং বলেছিলাম-"তোমার-আমার ভালোবাসা আমার কাছে ইবাদত তুল্য। আমি তোমাকে কখনো কস্ট দেবোনা, কোন দিন ভুলে যাবোনা"! মুনিয়াও আমাকে কথা দিয়েছিলো। কিন্তু সে কথা রাখেনি, কিম্বা রাখতে পারেনি-তা আমি জানিনা।
আমি যেদিন বিএমএ জয়েন করতে যাচ্ছি-সে দিন মুনিয়া তার এক জন খালা এবং ছোট দুই ভাই-বোন'কে সাথে নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে এসেছিলো আমাকে বিদায় জানাতে। আমি যখন আমার সীটে বসেছি-তখন খালার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করেছিলো! সেই প্রথম, সেই শেষ স্পর্শ! সেই শিহরন এখোনো আমি অনুভব করি............
পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর আর্মী অফিসারদের প্রমোশনের একটা হিরিক পরে যায়। তেজগাঁও বিমান বন্দরে জাপানী বিমান ছিন্তাইর ঘটনার সময় একটা ব্যার্থ বিমান সেনা অভ্যুথান হয়েছিলো। ঐ সময় আমার বাবা প্রানে বেঁচে গেলেও অনেক বিমান সেনা-অফিসারদের সাথে তিনিও চাকুরিচ্যুত হন। আমার ট্রেনিং এক বছর শেষে ১০ দিনের ছুটিতে এসে মুনিয়ার সাথে দেখা করি। কিন্তু সেনা অফিসার আইনে আমাদের বিয়ে করতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে-বলে খুব খারাপ লাগতো। কারন, ক্যাপ্টেন হবার পুর্বে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিলো।
আমার ট্রেনিং যখন ১৮ মাস শেষ-তখন হঠাত করে মুনিয়ার বিয়ে ঠিক হয় একজন মেজর পদবীর অফিসারের সাথে। সেই মেজর সাহেবের বাবাও একজন প্রক্ষাত আর্মী অফিসার-যাকে সেনা বাহিনী বিশেষ সম্মানের সাথে স্মরণ করে। এই খবরটা আমি জানতে পারি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজে আমার স্টেপ ব্রাদার মুনিয়ার সহপাঠীর কাছ থেকে।
বিএমএ থেকে কোন প্রকার ছুটি দেয়া হয়না। আমি বিএমএ থেকে নাইট পাশ (কয়েক ঘন্টার জন্য সংক্ষিপ্ত ছুটি)সংগ্রহ করি চট্টগ্রাম শহরে আত্মীয়ের অসুখ দেখতে যাবো বলে। আমি চলে আসি ঢাকায়। চলে যাই মুনিয়াদের বাসায়। আমাকে ওদের বাসায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা। এমপি’রা (মিলিটারী পুলিশ)আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমি জোড়-যবরদস্তি ঢুকতে চাই............ মুনিয়ার সাথে দেখা করতে চাই। মুনিয়ার বাবা তখন অনেক বড় অফিসার। আমাকে এমপি দিয়ে এরেস্ট করায়। সেনা আইনে আমার কোর্ট মার্শাল হয়। ৩ মাসের কোয়ার্টার গার্ড (সেনা জেইল) হয়। আমি চাকুরীচ্যুত হই!
আমার কাছে আবারো সেই এসএমএস’টা রিসেন্ড করে......। আমি তার কথা ভেবে খুব অস্থির হয়ে পরি। আমার বৌ ফুফুর সাথে গল্প করছে। আমার কিছুটা লোভ হচ্ছে মুনিয়ার সাথে কথা বলতে......... কিন্তু কি কথা বলবো আমি! তাকে বলার মতো কোন কথাই যে আমার অবশিস্ট নেই! আমি তাকে কি করে বলবো-তাকে আমি এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি! আমি সব সময় তাকে মনে করি......। আমি মনে করতে না চাইলেও-তাকেই আমার মনে পরে যায়। তার জন্য আমি অনেক কেঁদেছি! কান্না করতে করতে আমার বুক ব্যাথা করতো। এখনো আমি যখোন নামাজের রুকুতে যাই, সেজদায় যাই-তখনো তাকে আমার মনে পড়ে! আমার দুচোখ ভেঙ্গে পানি বেরুচ্ছে! আমার বুকে ব্যাথা অনুভভ করছি!
এতোটা বছর আমি অনেক কস্ট বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। ডিওএইচএস'এ আমি তার বাড়ীর ঠিকানা জানি। ডিওএইচ এস'এ আমার অনেক আত্মীয় স্বজন থাকেন-শুধু তার সাথে দেখা হতে পারে সেই ভয়ে আমি কোন দিন ডিওএইচএস যাইনা। তার সাথে দেখা হতে পারে বলে আমি ক্যান্টনমেন্টস্থ্য সিএসডি যাইনা। আমার বাবার ক্যনটনমেন্টের বাড়ীতে যাইনা-যাতে তার সাথে আমার দেখা নাহয়! আমার বাবা মারা যাবার পরও আমি তার জানাযায় যাইনি-সেখানে তার স্বামী-সন্তান আসবে ভেবে!
আমি তাকে ফোন করি............ "মুনিয়া, কেমন আছো"?
অপর প্রান্ত নিরব। আমি আবারো কথা বলি-মুনিয়া কেমন আছ?
এবার অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন করে-"আপনি কে বলছেন প্লীজ"?
একি! আমি কার কন্ঠস্বর শুনছি! এতো আমার হারিয়ে যাওয়া মুনিয়ার কন্ঠস্বর নয়! আমি জীবনের কোন অবস্থাতেই মুনিয়ার কন্ঠস্বর চিনতে ভুল করবোনা............... তাহলে......
অপর প্রান্ত থেকে হতাশ কন্ঠস্বর ভেষে আসে-"আমি বোধ হয় ভুল করেছি........."
আমিও বুঝতে পারলাম-আমিও ভুল করেছি...............
আমি একাই মুনিয়ার জন্য কস্ট পাচ্ছি-মুনিয়া আমার জন্য কস্ট পাচ্ছেনা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন