মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ভিক্ষুকের হাতকে কমর্ীর হাতে রূপান্তর করতে হবে


ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে হবে

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ১২: ১৮, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ভিক্ষুকের হাতকে কমর্ীর হাতে রূপান্তর করতে হবে

সবাই প্রকৃত ভিক্ষুক নয়। কেউ সামান্য শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে, কেউ আবার প্রতিবন্ধী সেজে, কেউ নেশা বা পেশা হিসেবে বিনা পুঁজিতে বাড়তি আয়ের মাধ্যম হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছে। আবার কেউ কেউ কোনো কোনো প্রতিবন্ধীকে দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে নিজে ভোগ করছে। বাসা-বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে যারা কাজ করে তাদের কোলের শিশুকে অনেক সময় কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা থাকে। আবার দেখাশোনার লোকের অভাবে বাসায় রেখে যাওয়াও সম্ভব নয়। তখন তারা কোনো ভিক্ষুকের কাছে তাদের বাচ্চাকে ভাড়া দিয়ে যায়। প্রকৃত ভিক্ষুক যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে কে যে প্রকৃত ভিক্ষুক আর কে ভিক্ষুক সেজেছে_ এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সাজানো ভিক্ষুক ভিক্ষার বাড়তি আয় দিয়ে আরাম-আয়েশ করছে আর প্রকৃত ভিক্ষুক ভিক্ষা না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এদেশের দানশীল, সংবেদনশীল মানুষ কিন্তু ভিক্ষাখাতে কম দান করছেন না। তবে প্রকৃত ভিক্ষুকদের হাতে সেই দান না গিয়ে ভিক্ষুক ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত ভিক্ষুকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অর্থনীতির ভাষায়, ভিক্ষুকদের কাজ হচ্ছে অনুৎপাদনশীল। এতে ভিক্ষুক নামের শ্রমিকের শ্রম অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে ভিক্ষুক সারাজীবনই ভিক্ষুক থাকবে, তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। একটি সংস্কৃত শেস্নাক হচ্ছে_ 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, তদর্ধং কৃষি কর্মণি তদর্ধং রাজ সেবায়ং, ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ।' এর সরল বাংলা হচ্ছে_ ব্যবসা-বাণিজ্য করলে সহজেই সম্পদশালী হওয়া যায়, কারণ হিন্দুমতে লক্ষ্মী হচ্ছেন ধন-সম্পদের অধিষ্ঠাথর্ী দেবী; এর অর্ধেক সম্ভাবনা রয়েছে কৃষিকাজে ও একচতুর্থাংশ সম্ভাবনা রয়েছে সরকারি চাকরিতে; তবে ভিক্ষাবৃত্তিতে কিছুই নেই। ভিক্ষুকের সংসারে কোনোদিনই সচ্ছলতা আসে না।

কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে জনগণের কল্যাণে, রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করা। বাংলাদেশ সরকারও কল্যাণ রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে বয়স্কভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাভাতা, শিক্ষাভাতা, ভিজিএফ কার্ড, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা, কৃষিতে ভতর্ুকি ইত্যাদি নানা কর্মসূচি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে আর্থিক ব্যয় হচ্ছে সে সব ব্যয় সরকার জনগণের কাছ থেকে যে ট্যাক্স-ভ্যাট পান তা দিয়ে এবং বিদেশি সাহায্য ও ঋণ বাস্তবায়ন করে থাকেন। সরাসরি জনগণের কাছ থেকে সংশিস্নষ্ট খাতে কোনো ট্যাক্স নেন না। কিন্তু ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকার উদ্যোগ নিলে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ট্যাক্স আদায় করতে পারবেন।

ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনে দাতা সংস্থা এবং সরকার যা করতে পারেনেঃ

১) সংসদে ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ ও ভিক্ষুক পুনবার্সন আইন পাস করে ব্যক্তিগতভাবে ভিক্ষা গ্রহণ ও ভিক্ষা প্রদান আইনত নিষিদ্ধ করে ভিক্ষা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদান এবং প্রকৃত ভিক্ষুকের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। শুধু এই আইনের ফলে বিনা পুঁজির এ ব্যবসা থেকে ৬০/৭০ ভাগ ভিক্ষুক আপনাআপনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাবে। বাকি প্রকৃত ৩০/৪০ ভাগকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, ভিক্ষুকভাতা দিয়ে, যারা একেবারে অক্ষম তাদেরকে আজীবন রাষ্ট্র কর্তিক রাষ্ট্রের দায়িত্বে রেখে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। একেবারে অক্ষমদের রাষ্ট্রের দায়িত্বে না রাখলে এদের ভাতা অন্যরা খেয়ে ফেলবে।

২) ভিক্ষুকদের একটি জরিপ করতে হবে। জরিপকালে ভিক্ষুকদের লিঙ্গ, বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, পোষ্য আছে কি না, থাকলে তাদের তথ্য, শারীরিক, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কি না, থাকলে কী রকম প্রতিবন্ধী, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, ভিটেবাড়ি আছে কি না ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যাতে সহজেই শনাক্ত করা যায় কাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, কাকে ভাতা দিয়ে কাকে আজীবন ভরণপোষণ দিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। এই জরিপ কাজ চালানোর জন্য মহানগর, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মাইকিংসহ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডে এক বা একাধিক কেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে, স্থানে ও সময়ে জরিপ কাজ চালাতে হবে।

৩) সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের তালিকা তৈরি করে প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট নম্বর দিতে হবে এবং ক্যাটাগরিভিত্তিক মাসিক/বার্ষিক সর্বনিম্ন ভিক্ষুক কর ধার্য করে দিতে হবে। কোনো দানশীল ব্যক্তি ইচ্ছে করলে যত ইচ্ছে এই তহবিলে দান করার সুযোগ রাখতে হবে। এই কর যাতে মোবাইল ম্যাসেজ, স্থানীয় ডাকঘর, ব্যাংকের শাখায় সহজেই জমা দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকেন না তাঁদের জন্য আলাদা নম্বর দেয়া যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় যাঁতে কেউ বাদ না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর ফলে ভিক্ষা দেবার সঙ্গতিসম্পন্ন সবাই ভিক্ষা দেবার সঙ্গে জড়িত হবেন। অন্যদিকে রাস্তাঘাট, বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যস্ততম সময় ও স্থানে ভিক্ষুক বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

৪) যে সব ভিক্ষুকের নিজস্ব ভিটাবাড়ি আছে তাদেরকে তার ভিটাবাড়িতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের ভিটাবাড়ি নেই তাদেরকে গুচ্ছগ্রাম বা অনুরূপ কর্মসূচির মাধ্যমে পুনর্বাসন করতে হবে। যারা একেবারে পঙ্গু তাদেরকে হোস্টেলের মতো বহুতল ভবন নির্মাণ করে আজীবন ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিভাগে এক হাজার ও অন্যান্য বিভাগে পাঁচশো জনের থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ আইন সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনুৎপাদনশীল শ্রম উৎপাদনশীল শ্রমে পরিণত হবে। ভিক্ষুকের হাত কর্মীর হাতে রূপান্তরিত হবে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কোমলমতি ভিক্ষুক শিশুরা বাধ্য হয়ে বিদ্যালয়ে যাবে। ফলে নিরক্ষরতা দূর হবে। ভিক্ষুকরা গ্রামে-গঞ্জে পুনর্বাসিত হলে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন