সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

প্লিজ, একটু হাঁটুনঃ


প্লিজ, একটু হাঁটুনঃ

প্রতিদিন আমাদের প্রয়োজনেই আমরা হাঁটিএই হাঁটাহাঁটির গল্পে যাকে নিয়ে মূল অনুপ্রেরণা সেই দুটি পা কিংবা শরীরের যত্নের জন্যেও একটুখানি হাঁটা উচিতআধুনিক শরীরচর্চায় যেমন হাঁটার বিকল্প নেই তেমনি অতীত ইতিহাসেও হাঁটা কখনোই অবহেলিত ছিল নাএই নাগরিক ব্যস্ততায় নতুন করে হাঁটার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতেই আমার আজকরে লখো

একই ফ্লাটের নতুন ভাড়াটিয়াকে সাত সকালে হাঁটতে দেখেই পুরোনো ভাড়াটিয়া ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন-"কি ভাই, আপনারও কি ডায়াবেটিস নাকি?"  ভাবখানা এমন যে ডায়াবেটিস না হলে বুঝি বাঙালির হাঁটতে বারণতা সে যাই হোক, পুরো বিশ্বে আমরা যে সবচেয়ে কম হেঁটে বেঁচে থাকা জাতিগুলোর অন্যতম সেটা কিন্তু ছোট্ট একটা হিসেব মিলিয়েই দিব্যি বলে দেয়া যায়এই ধরুন, আপনি যাবেন বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরের কোনো বাসস্টপেপা চালিয়ে পৌঁছাবেনউহুঁ, অমন পরিশ্রমী ক'জনই বা আছেনআর তাই পকেট যদি একান্তই গড়ের মাঠ না হয় তাহলে দূরত্ব যাই হোক না কেন রিকশায় জুড়ে বসতে আমাদের কোনো জুড়ি নেইঅথচ ইউরোপ,আমেরিকার যাদের দিকে তাকিয়ে আপনি সারাদিন ধন্যি, ধন্যি করে নাভিশ্বাস তোলেন তাদের কথা একটিবার ভাবুনআধ কিলোমিটার তো নস্যি, ঝাড়া দু-তিন কিলোমিটার রোজ হাঁটেন এমন লোকও সেখানে ঢের পাওয়া যাবেআপনি হয়তো বলবেন ওদের তো আর রিকশার মতো বাহন নেইএকটি বার ভেবে দেখেছেন কি, রোজ অতোটা হেঁটেও সাদা চামড়ার সাহেবরা কিন্তু দিব্যি সুইস্থ্য স্বামর্থে বেঁচে বর্তে আছেনআর নিয়ম মাফিক একটু হাঁটাচলা যে ওদের আরো কর্মঠ হতেও সাহায্য করছে সেই স্বীকৃতিও মিলছে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের কাছ থেকেই

আপনি কষ্ট করে হাঁটবেন? কিন্তু এর পরিবর্তে কেষ্টটা মিলবে কি? যদিও হাঁটনের গুন বর্ণনার শুরুটা কোথা থেকে করা যায় সেটাও ভাববার বিষয়লক্ষ্য করলে দেখবেন, আশপাশের সাত তল্লাটে যতো লোক নিজে থেকে হাঁটে, তাদের বারোআনাই হাঁটে নানান বিমারে পড়েকারো হয়তো ডায়বেটিস, আবার কারো স্রেফ মুটিয়ে যাবার ভয়কেউ হাঁটছেন ডাক্তারের চাপে পড়ে, আর কেউবা বিউটি এক্সপার্ট এর পরামর্শেতবু ভালকারণ হাঁটাহাঁটির রাস্তায় তাদের অনেকটা হাঁটাতো হলোকিন্তু আপনারা যারা সকালে উঠে বিছানায় ফুল বাবুটি সেজে বেড-টি খাচ্ছেন আর গাড়ি চেপে অফিস যাচ্ছেন তাদের কি হবে! হবে এটাই যে, তারাও দু'দিন পরে বিমারীর খাতায় নাম ওঠাবেনঅতঃপর সুবোধ বালকের মতো বাধ্য হয়ে হাঁটবেন

 ইউরোপ আর মার্কিন মুলুকের খ্যাতনামা সব বিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের গবেষণা বলছে, দৈনিক যারা হাঁটেন, তাদের আয়ু না হাঁটিয়েদের চাইতে বেশিএমনকি যুবক কিংবা বুড়ো, যে বয়সেই হাঁটা শুরু করুঠ না কেন, আপনার আয়ু বাড়বার প্রক্রিয়াটা কাজ করবে একই ভাবেঅন্যদিকে হাড়গোরের যে শক্তি, সেটাও বহুগুনে বাড়বে নিয়মিত হাঁটাচলা করবার অভ্যাস থাকলেএছাড়া চলশক্তি বাড়ানো, দুশ্চিন্তা কমানো, সুনিদ্রা প্রাপ্তি আর ওজন নিয়ন্ত্রনের মতো বহু মহার্ঘ প্রাপ্তিরও অন্যতম নিদান এই হাঁটা

 আপনি হয়তো এরই মাঝে না হেঁটেই দিব্যি সুস্থ্য-স্বাভাবিক আছেনশরীর কমজোড় নয়, ওজনটাও নায়ক হবার অনুকূলেতাহলে আপনি কেন হাঁটবেনভাববার বিষয় বটে ? তবে এই ভাবনারও একটা যুতসই জবাব আছে। "মন" নিয়ে যাদের কায় কারবার সেই মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা প্রতিদিন কিছুটা হলেও হাঁটতে পারেন তাদের মেজাজটা থাকে ফুরফুরেকাজে কর্মে মনও দেয়া যায় ষোলআনাএমন কি যাদের হুট করে রেগে যাবার অভ্যাস আছে তাদের ক্রোধ দমনেও নাকি দারুণ কাজে আসে কিঞ্চিত হাঁটাহাঁটিবিশ্বাস না হলে, রাগের মুহূর্তে কিছুটা পায়চারি করে আপনিও ফলটা হাতে নাতে যাচাই করে দেখতে পারেনআর যাদের বাড়িতে ঝগড়াটে স্বামী বা স্ত্রী আছে তারা এখুনি রুটিন করে হাঁটতে নামুনকে জানে, সকালের নির্মল হাওয়ায় হাঁটাহাঁটি হয়তো আপনাদের কথা কাটাকাটিকে চিরতরে বিদায় করেও দিতে পারে

অনেকেই মনে মনে বলছেন, হাঁটতে তো চাই-ইকিন্তু হাঁটলেই যে বেজায় ক্লান্তি লাগেকথা মিথ্যে নয়প্রতিদিন কমপক্ষে ১ কিলোমিটার হাঁটলেও যে পরিমাণ ক্যালরী পোড়ে তার ধকল সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়কিন্তু তাই বলে একটু বেশি হেঁটে বেশি বাঁচবার সুযোগটা হেলায় হারাবেন! ডাক্তারবাড়ির ডাক্তারেরা কিন্তু তা মানছেন নাতাদের পরামর্শ - রোজ একশো কদম হলেও হাঁটুনএভাবে একমাস হাঁটবার পর যখন শরীরটা দিব্যি মানিয়ে যাবে তখন ধীরে ধীরে হাঁটার পরিমাণ দিন বাড়িয়েদেখবেন আজ যেখানে আধ কিলোমিটার হাঁটতেই দম ফুরিয়ে যাচ্ছে কাল সেখানে দিব্যি এক কিলো হেঁটেও দম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেনআর এতেও যদি কাজ না হয়, তবে সঙ্গী সাথী নিয়ে একেবারে সমভিব্যহারে হাঁটুনদেখবেন হাঁটার হাঁটাও হবে, আবার হাঁটিয়ে বন্ধুদের সাথে জম্পেশ একটা দোস্তিও হয়ে যাবে

একবিংশ শতকে এসে মেট্রোপলিটন শহরের মানুষকে একটু হাঁটানোও সোজা কথা নয়তারা সবই শোনেন, সবই বোঝেনতারপর পত্রিকার পাতা উল্টাবার মতো, কথাগুলোকেও বেমালুম উল্টেপাল্টে ফেলেনকিন্তু তবু আপনাদের কিঞ্চি বোধোদয়ের আশায় বলছি - বিলেতি বিদ্যানের দল কিন্তু আজতক হাঁটাহাঁটি নিয়ে কম মাতামাতি করেন নিআর তাদের সেই সব ভ্রু-কুঁচকানো জটিল গবেষণার সরলার্থ কিন্তু একটাইহাঁটলে লাভ ষোলআনা, লোকসান নেই কিছুইহাঁটাহাঁটির এইসব উপকারের সামান্য কিছু নমুনা এখানে নিবেদন করা হলো ধৈর্য্যশীল পাঠকদের জন্যঃ-

০ দৈনিক হাঁটলে হৃদযন্ত্রের ব্যামো হবার সম্ভাবনা কমে

০ উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ওষুধের প্রতি নির্ভরশীলতা কমে

০ কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে

০ মানসিক হতাশা কমে, বাড়ে চিন্তা করবার শক্তি

০ মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে

০ কমে যায় ক্ষুধামন্দের প্রবণতা

প্রতিদিন নিয়ম করে যারা হাঁটতে চান তাদের জন্য আরেক বিপত্তি হলো হাঁটার সময় আর স্থানএমনিতে যতোই বলি না কেন, নির্মল পরিবেশে সবুজের সান্নিধ্যে হেঁটে বেড়ানো তো আর মুখের কথা নয়বিশেষ করে ইট আর কংক্রিটের স্তুপের মাঝে যারা থাকেন তাদের জন্য সবুজের কল্পনাটাই ধূসরএক্ষেত্রে দুন'টো বুদ্ধি বাতলে দিতে পারিপ্রথমত যাদের পক্ষে অন্তত বাড়ির ছাদে হাঁটা সম্ভব তারা আপাতত তাই দিয়ে শুরু করুনআর সপ্তাহে কমপক্ষে দু'দিন চেষ্টা করুন খোলা কোনো মাঠে হাঁটতেকিংবা যদি খুব সকালে উঠতে পারেন তাহলে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে হাঁটলেও মন্দ লাগবে নাঅন্যদিকে যাদের বাসার সামনে সুন্দর খোলা জায়গা বা পার্ক আছে তাদের তো কথাই নেইতবে যেখানেই হাঁটুন না কেন, ব্যস্ততা আর পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সকালে হাঁটাই কিন্তু উত্তমআর যাদের পক্ষে এগুলোও সম্ভব নয় তারা অফিসে যাবার পথে কিংবা ফিরবার সময় কিছুটা হেঁটে তারপর রিকশা বা বাসে চড়ুনবাড়ির যেসব গৃহিনী ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসতে যান তারাও সন্তানকে দিয়ে আসা কিংবা নিয়ে আসবার সময়টায় কিছুটা হাঁটতে পারেনএতে আপনার যেমন উপকার হবে তেমনি আপনার সন্তানের মাঝেও হাঁটবার অভ্যাস গড়ে উঠবেঅন্যদিকে বাড়তি এই হাঁটাহাঁটির ফলে শরীরের উপকার  ছাড়াও বাঁচবে যকিঞ্চিত ভাড়ার টাকা

ফি বছর বহু লোকই হেঁটে হেঁটে দেশ ভ্রমণে বের হয়হাঁটতে হাঁটতে কিংবা চড়তে চড়তে জয় করে ফেলে এভারেস্টওতবু যারা হাঁটতে চান না তাদের অজুহাতের কমতি নেইপাঠক হিসেবে আপনি কোন দলে যোগ দেবেন সেটা আপনার বিষয়তবে এতোটুকু গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে যারা নিদেন পক্ষে একটি সপ্তাহও হেঁটেছেন তারা এই মহৌষধকে ভালো না বেসে পারেন না

[sb]হাঁটাহাটির ফর্দঃ[/sb]

১. অনেকেই শরীরের ঘাম ঝড়াতে জিমে কিংবা বাসায় ট্রেডমিল নামক একটি যন্ত্রের ওপর হাঁটেনতবু এর সাথে মুক্ত বায়ুতে হেঁটে বেড়াবার তুলনা হয় নাতাই সপ্তাহে একদিন হলেও খোলা আকাশের নীচে হাঁটুন

২. একা একা হাঁটতে কষ্ট হলে দলবেধে হাঁটুন

৩. বিশৃঙ্খল ভাবে না হেঁটে কোন রাস্তা দিয়ে কতোদূর হাঁটবেন তা ঠিক করে হাঁটা শুরু করুন

৪. প্রথমে অল্প পথ হেঁটে নিজেকে প্রস্তুত করুনতারপর ধীরে ধীরে হাঁটার পরিমাণ বাড়ানতবে অহেতুক বেশি হেঁটে নিজেকে কান্ত করবেন না

৫. একটানা না হেঁটে প্রতি দশ মিনিট হাঁটার পর দু' মিনিট বিশ্রাম নিন

৬. হাঁটা অবস্থায় হাঁপিয়ে গেলে সাথে সাথে ভুলেও পানি খাবেন না

৭. নিজে হাঁটুন, অন্যকেও হাঁটতে বলুন


(লেখার মুল সূত্রঃ-মান্থলী হেলথ রিভিউঃ মাউন্ট এলিজাবেথ হস্পিটাল, সিংগাপুরমুল লেখকঃ-ডাঃ টিমথী লী, সিনিয়ার কন্সাল্টেন্ট)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন