সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমেরিকার কড়চা-১


আমেরিকার কড়চা-১

আমি বিদেশ বেড়াতে পছন্দ করি। সুযোগ পেলেই দেশের বাইরে যাই। আমি আমার দেশকেও খুব ভালো করে দেখেছি। বলতে গেলে আমি আমার দেশের সবগুলো উপজেলায় গিয়েছি। বিদেশের সুশৃংখল জীবন যাত্রা আমার পছন্দের। কিন্তু অনেক নাপাওয়ার মধ্যেও বসবাসের জন্য আমার প্রিয় বাংলাদেশ। এই দেশের সব কিছুতেই মিশে আছে আমার মায়ের শরিরের ঘ্রান!রিকশার টুনটুন আওযাজ,ট্রাফিক জ্যাম,রাস্তা ঘাটের নোংড়ামী,থুথু ফেলা,জনস্মমুখ্যে নাক ঝাড়া,দাঁত খোচানো,উচ্চ কন্ঠে কথা বলা-সবই আমাদের আত্মস্থ্য হয়ে গিয়েছে। এটাই যেনো আমাদের দেশজ সংস্কৃতি!!!আবার আমরাই যখন বিদেশে যাই-তখন হয়ে যাই কুলীনদের চাইতেও বড় কুলীন!বিদেশে ইমিগ্রান্ট বাংগালীদের মতো সুশৃংখল জাতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর কোথাও নেই!

১৯৯২-১৯৯৮ সন পর্যন্ত আমার বৌ থাকতেন মিশিগান স্টেটের সাগিনাও শহরে। ঢাবি’র শিক্ষকতা পেশা থেকে হায়ার স্টাডিজ লীভ নিয়ে তিনি তখোন নর্দান মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে পি এইচডি শেষ করে একই ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছিলেন। আমি ব্যাবসায়ীক কারনে একাই ঢাকায় থাকতাম এবং বছরে ৩/৪ বার ঢাকা-মিশিগান "দৌড়ের উপড়" থাকতাম। যদিও আমাকে ব্যাবসায়ীক কাজে আমেরিকার অন্যান্য স্টেস্টে/ সিটিতে যেতে হতো। ফ্লোরিডায় গিয়েছি অনেকবার। পৃথিবী বিখ্যাত ইন্ট্রা অকুলার লেন্স (আই ও এল, চশমার পরিবর্তে ইউজ করা হয়,তবে ফ্যাশন কন্টাক্ট লেন্স নয়-পাওয়ার লেন্স। আইকন ব্রান্ড)এর বাংলাদেশে আমার কোম্পানী এক্সক্লুসিভ এজেন্ট হিসাবে নিয়োজিত অনেক বছর যাবত।ঐ লেন্স বাংলাদেশ থেকেই ইন্ডিয়া,পাকিস্তান,নেপাল,শ্রীলংকা, থাইল্যান্ডেও আমার ট্রেডিং কোম্পানীই মার্কেটিং করে থাকে ....... ঐ কোম্পানীর হেড অফিস এবং ফ্যাক্টরী ফ্লোরিডায় অবস্থিত এবং প্রধান মার্কেটিং অফিস ইংল্যান্ডে। আমি প্রায়শই ফ্লোরিডায় যাই।তখন সব মিলিয়ে আমার ৪ মাস থাকা হতো ওখানে। এবার ওখানকার কিছু সৃতিচারণ শেয়ার করবো আপনাদের সাথে।

৯৭,৯৯০ স্কয়ার মাইল আয়তনের মিশিগান স্টেস্টস নর্থ আমেরিকান সিটি। আমেরিকার ১১ তম বৃহত্তম স্টেস্টস। জন বসতি মাত্র ১৬৭ জন প্রতি বর্গ মাইলে! প্রচন্ড শীত প্রধান এলাকা। মার্কিন যুক্ত রাস্ট্রের ৩য় শীত প্রধান এলাকা। ১ম শীত প্রধান জন বসতি এলাকার নাম মিনেসোটা-একদম কানাডা লাগোয়া। এছারাও নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটাও খুব শীত প্রধান যায়গা। বাংলাদেশের খুব বেশী শীত কালের সমান হলো মিশিগানের ২ মাস সামার। আর মিশিগানের শীতকাল?মাইনাস ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত আমি দেখেছি। ঢাকা থেকে মিশিগান যাওয়া খুব জটিল। ঢাকা-নিউইয়র্ক/লসএঞ্জেলস-ডেট্রয়েট(ভায়া দুবাই/আর্মস্টার্ডাম/লন্ডন,কুয়েত সিটি)ছাড়াও বেশ কয়েকটি রুট আছে। বাই এয়ার থার্টি সিক্স আওয়ার জার্নী!ডেট্রয়েট থেকে ২ ঘন্টা ড্রাইভিং টাইম সাগিনাও। সাকুল্যে ৪০ ঘন্টার জার্নী!

গাড়ী ছাড়া আমেরিকাতে কোন জীবন কল্পনাই করা যায়না!সেই সঙ্গে আমাদের দেশের মতো মাসে ৭/৮ হাজার টাকা বেতন দিয়ে" কোন ড্রাইভার রাখার কল্পনাও করা পাপ!বলতে গেলে সবারই গাড়ী আছে। এক বাড়ীতে পুর্ণ বয়স্ক ৫ জন মানুষ থাকলে-তাদেরে প্রত্যেকেরই গাড়ী থাকে। যাদের গাড়ী নেই-তারা সাধারনত আমেরিকায় নিউকামার স্টুডেন্ট এবং ভিজিটরস। আমি আমার ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম-আমাকে নতুন করে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য এপ্লাই করতে হবে। নিয়ম মত প্রথমেই আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। আমার ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ওরা এলাউ করছেনা। প্রব্লেম হলো-ড্রাইভিং জানলেই কাউকে লাইসেন্স দিবেনা। আমাকে অনেকগুলো রোডের পজিশন,নাম-পরিচয়,পুলিশ স্টেশনের নাম এবং ওখানকার নিয়ম কানুন জানতেই হবে। লাইসেন্স পাবার প্রস্তুতির জন্য আমি আমার বৌ'র সাথে,আমার ভায়রা ডঃ বদরুল আমিন(বিশেষ কারনে আমি ডাকি মিঃ বদ”),বড় আপা এবং কখোনো তাঁদের ছোট মেয়েটির সাথে(অর্থাত যখন যাকে ফ্রী পাই)দুই ছুটির দিন সহ বেশ কয়েক দিন সাগিনাও শহরের বিভিন্ন রোডে ঘুড়লাম-রোড ঘাট চেনার জন্য। টেন্থ ডে আমি প্রাইভেট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য হাজির হই। আমি ভিজিটরস বলে ৫০ ডলার ফি নিয়ে আমাকে একটা তারিখ দিয়ে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হলো। 

ডঃ বদ আমাকে মজা করে বললেন-"ভায়রা মিয়া,আমার ভোলা-ভালা শালীকে পটিয়ে বিয়ে করা তোমার জন্য খুব সোজা ছিলো,হয়তো এখানেও ২/৪ টা মেয়ে পটিয়ে ফেলতে পারবে-কিন্তু 'ম্যারিকা'তে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া এতো সোজা না!মনে রাইক্কো-এইডা ঢাকা না,যে ২০০ টাকা ধরাইয়া দিয়েই লাইসেন্স পাইবা"!তিনি আরো বলেন-‘ম্যারিকা'তে মানুষ খুব একটা অসুখে মারা যায়না। অসুখ হলে চিকিতসা করে অসুস্থ্যকে ডাক্তার ভালো করবেই। এখানে মানুষ মরে গাড়ী এক্সিডেন্টে!গাড়ী এক্সিডেন্ট হলে সহজে কেউ বাঁচেনা-তাই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয় তাদেরকেই-যারা সত্যিকার ড্রাইভিং জানে"! 

নির্দিস্ট তারিখে আমি হাজির হলাম ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে। একজন কালো মহিলা অফিসার এবং ২ জন পুরুষ অফিসার ঘন্টা খানেক সময়নিয়ে আমাকে থিউরিটিক্যাল প্রশ্ন,প্রাক্টিক্যাল ড্রাইভিং দেখা,ব্লাড রিপোর্ট দেখা,মেডিক্যাল টেস্ট সহ অন্যান্য ওরাল ইন্টারভিউ নিয়ে আমার ইন্টারন্যাশনাল লাইসেন্সের উপড় একটা স্টীকার লাগিয়ে দিলো। যেমনটি ইংল্যান্ড,জার্মানীসহ অন্যান্য দেশেও দিয়েছিলো। 

আমি ভায়রা ভাইকে কল করে জানালাম-"দুলাভাই,লাইসেন্সতো দিলোনা,মনে হয়-কালা বেডীরে ট্যাহা পয়সা খিলাইতে হইবো"!ভায়রা ভাই বল্লেন-"আরে নাহ!টাকা পয়সার খেল এখানে নাই। তোমারেতো আগেই কইছিলাম-২/৩ বারের আগে কেউ লাইসেন্স পায়না। আবার ২ মাস পর ট্রাই করো"। 

এনিওয়ে,আমি একবারেই লাইসেন্স পাওয়ায় আমার বৌ খুব খুশী এবং বললেন-"যাক,তোমার বিজনেস-জব কোন কিছু না থাকলেও দ্যাশে যাইয়া টেম্পু চালাইয়া খাইতে পারবা"! উল্যেখ করা যেতে পারে-আমার বৌ ৮ মাসে ৩ বার পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছিলেন। আমার ভায়রা ২ বতসর পর ৫ বারের বার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন