সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

তবু বন্ধু ভালোবেসো একবার


তবু বন্ধু ভালোবেসো একবার


জীবনে, যাপনে ব্যস্ততা যাদের অফুরান, বন্ধুত্ব তাদের কাছে প্রাণখুলে শ্বাস নেবার এক স্থান। অন্যদিকে বন্ধুত্বের অসংখ্য আড্ডা আর ভাললাগা নিয়ে যাদের দিনমান কেটে যায়, তাদের কাছে জীবনের বাস্তবতাটাই যেন এক শঙ্খনীল কারাগার। তবু বন্ধুত্ব আসে আমাদের কংক্রিটের স্তুপে ভরা শহরে। বন্ধুত্ব তার গান শুনিয়ে যায় গ্রামের মেঠোপথে। বন্ধুর পথে আলোকিত দিনের স্বপ্ন দেখায় বন্ধুরা। আবার হাসি-কান্নার ভাগাভাগিতে বন্ধুরাই শুনিয়ে যায় আশা জাগানিয়া সময়ের গান। বন্ধু দিবসকে সামনে রেখে চিরচেনা এই বন্ধুত্ব নিয়েই  আজ আমার এই লেখা।

‘ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখো আমার এ হাড়
ছুঁয়ে ছুঁয়ে শেখো একি
চোখ দিয়েছি প্রিয় বন্ধু
সে চোখে দেখো পৃথিবীর রূপ একি
তবু বন্ধু ভালোবেসো একবার
যা ছিল সব দিয়েছি দেবার’- সিডি প্লেয়ারে ধীর লয়ে বেজে চলেছে কৃষ্ণকলির গান। আর অনুভূতির প্রতিটি কোণে যেন অন্য একটা শিহরণের ডাক শুনতে পাচ্ছে হিমু। আজ তার ছুটির দিন। আজ সারা দিনমান বাসায় থাকার দিন। আজ অলস মেঘের দিন। আজ রকিং চেয়ারে আয়েশ করে গান শোনার দিন। তবু হিমুর চিন্তার মাঝে কোথায় যেন একটা অস্থিরতা। তার কেবলই মনে হয়, আচ্ছা আজ সারাটা দিন কি বন্ধুত্বেরও দিন হতে পারতো না। হয়তো পারতো। কিন্তু হয় না। সময় তার হ্যামিলনের বাঁশি দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে গেছে চেনা বন্ধুদের চেনা আড্ডাগুলোকে। এখন তাই ব্যস্ত সময় কাটে অফিসে, সংসারে। ছুটির দিনে বাইরে বেরুতে আলসেমী লাগে। বন্ধুর বাড়ির নেমন্তন্নে যাবার জন্য সময় বের করতেও হিসেবের ছক কষতে হয়। আর যান্ত্রিক জীবনে বন্ধুত্ব, আড্ডা বাঁধা পড়ে রয় ব্লগিং, ফেসবুক আর চ্যাটিং এর মাঝে।

বন্ধু কী খবর বল!

বন্ধুত্বের সমস্ত রং আর রূপ গায়ে মেখে যারা এখনো তুমুল আড্ডায় মেতে আছেন তাদের কাছে বন্ধুত্বের সকল উপমাই অর্থহীন। তাই বন্ধু দিবসে এরা কখনো দলছুট হয়ে ছুটে যান না হলমার্ক কিংবা আর্চিস এ। ই-কার্ড আর গ্রিটিংস এর ভিড়ে তাদের কখনো মনে করিয়ে দিতে হয় না বন্ধু দিবস নামে আপাত অর্থহীন একটা দিনের কথা। তবু এই পৃথিবীর অসংখ্য দিবস আর অর্থহীন আচার-উৎসবের মাঝে যদি বন্ধু দিবস নামে একটা দিবস এসেই যায়, ক্ষতি কী! যদি হাজারো ব্যস্ততার ভিড়ে একটি দিন এসে মনে করিয়ে যায় ফেলে আসা কোনো বন্ধুদিনের কথা তাহলে সেটিই বা দোষের কী। তাই আমরা গুটিকয় আধুনিক মানুষ, আধুনিকতার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া কিছু মানুষ এখনো ভালোবাসি এই দিবসের মাঝে আটকে যাওয়া বন্ধুত্বকে। ভালোবাসি বহুদিন আগের কোনো ফেলে আসা বন্ধুকে শুধাতে ‘বন্ধু, কী খবর বল?’

বন্ধুত্বের মাঝেও আছে অনেক "কিন্তু"!

আসলে বন্ধু আর বন্ধুতা যাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী তারা একমুহূর্তেও জন্যও মন থেকে আড়াল করতে পারেন না বন্ধুদের। জীবনের সংকটে এরা ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবনযাপনের ভিন্ন রস। অন্যদিকে যন্ত্রনগরে অবাক প্রহর কাটানো যে যন্ত্রমানুষেরা এরই মাঝে ভুলতে বসেছেন তাদের স্বর্ণালী বন্ধুত্বের প্রহরগুলোকে, তারাও কিন্তু ঠিকই মিস করেন তাদের বন্ধুদের। কিন্তু ‘যতদিন এই দেহে আছে প্রাণ’ ততদিন শুধু ‘মিস’ করার মাঝেই কেন আটকে থাকবে আপনার গর্ব করার মতো বন্ধুতাগুলো? কেন স্রেফ ফেসবুক এর স্ট্যাটাস পড়েই জানবেন বন্ধুর খবর! অচেনা ব্যস্ততার গন্ডি থেকে কেন আরেকটিবার এসে দাঁড়াবেন না চেনা বন্ধু সড়কে? হয়তো বলবেন, বন্ধুদের খবর তো নিতেই চাই কিন্তু সময় যে হয়ে ওঠে না। অথবা ঈর্ষাকাতর কেউ তার অভিমানের ঝাপি খুলে বলতে পারেন, ‘আমার খবর তো ওরা কেউ নেয় না। তাহলে আমি-ই বা কেনঃ'! এ নিছকই অভিমানের কথা।  আসছে দিনের বন্ধু দিবসে এই অভিমানগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিন। বন্ধুর জন্য চমকদার কোনো গিফট না হোক, অন্তত একটিবার তার কথা মনে করে ফিরে যান বন্ধুবৎসল কোনো আড্ডায়। যেখানে বন্ধুত্বের রঙ ব্যস্ততার আঁচরে দিনের পর দিন ধূসর হয়ে পড়ছে, সেখানে নতুন এক পড়ত রঙ চড়ানোর দায়িত্বটাও না হয় তুলে নিন নিজের কাঁধে। আর যারা গ্রামের টি-স্টল কিংবা কলেজ ক্যাম্পাস কিংবা করিডোরগুলোকে প্রতিদিনই মুখরিত করে রাখছেন নানা রঙের বন্ধুতায়, তারাও সকল স্বার্থ আর সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ভালোবাসতে শিখুন বন্ধুকে।

গল্পের শেষেঃ

রকিং চেয়ারটা ছেড়ে যেন অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতোই উঠে দাঁড়ায় হিমু। চিন্তার চারদেয়ালে হঠাৎ করেই কড়া নাড়ে ফেলে আসা দিনের কিছু বন্ধুর মুখ। মনে পড়ে দেবনাথ, ফ্রান্সিস, গুলজার, জুবেরী আর তুতন এর মতো অসংখ্য বন্ধুর কথা। কোথা থেকে যেন রাজ্যের স্মৃতি আর প্রশ্ন এসে ভর করে মনের অচীন কোণে। আচ্ছা গুয়লজারটা কি আগের নাফেরার দেশ থেকে আমাকে মনে করে? দেবনাথটা কি আগের মতোই শুকনো আছে? জুবেরী, ফরিদ আমেরিকাতে এখন কি করে? আর তপংকরই বা কেমন আছে ওর ভালোবাসা আর লেখালেখি নিয়ে। কিরনদের সাভারের বাসা, বাসার সামনের গাছ-গাছালি, ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া আর ওর মায়ের হাতের রান্নার কথা এখনো জীবন্ত মনে হয়  হিমুর কাছে। নাজিয়া আর তুতনকেও ফোন করা হয় না কতদিন! এসবকিছু ভাবতে ভাবতেই একসময় হিমুর প্রিয় একটি মুখ, প্রিয় একটি নাম, তারচেয়েও বেশী প্রিয় একটি কস্টের নাম খুঁজে মুঠোফোনে'র নম্বরে ফোন দেয় হিমু। জানা হয় অনেক কিছু। জানা হয়, একদিন যার জন্য ঘন্টারপর ঘন্টা বসে থাকতো ফুলার রোডে বৃটিশ কাউন্সিলের পাশে কিম্বা টি এস সি'র সামনে, যার পছন্দের প্রিয় ফুল লাল পদ্ম এনেদিতে সাইকেল চেপে বৃস্টি ভিজে সেই বলিয়াদীর জমিদার বাড়ির পদ্ম পুকুর অবদি ছুটে যেতে কার্পণ্য করতো না সেই তুতন আমার কন্ঠস্বরও ভুলে গিয়েছে! জুবেরীর বৌটা মারা যাবারপর জুবেরীটাও কেমন যেন অভিমানী হয়ে গেছে! এসব কথা ভাবতে, এসব কথা শুনতে ভাল লাগে না হিমুর। তার চোখের কোণে একফোঁটা পানি চিকচিক করে ওঠে। আর স্মৃতিতে ভাসতে থাকে ফেলে আসা বন্ধুদিনের কথা।
ভালো থেকো বন্ধুরা.........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন