সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

পিতা-মাতা ও কুলাংগার সন্তান


পিতা-মাতা ও কুলাংগার সন্তান

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৮: ৪০, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১১

পিতা-মাতা ও কুলাংগার সন্তান

সময়ের পরিক্রমায় বাবা-মা একদিন বৃদ্ধ হয়ে পড়েন, হয়ে পড়েন অক্ষম, চলৎশক্তিহীন। শুধু অগাধ স্নেহ ছাড়া তখন সন্তানদের আর কিছুই দেয়ার থাকে না তাদের। কিন্তু অধিকাংশ সন্তানেরাই ভুলে যায়, কি করে তারা এত বড়টি হয়েছে। এর পেছনে কত নির্ঘুম রাত কেটেছে মায়ের, ছেলে-মেয়েদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে বাবাকে। একদিন তারাও সংসারি হয়, হয় সন্তানের বাবা-মা, কিন্তু বাবা-মা'র যে গভীর আত্মত্যাগ, তার কোন আচড় কাটে না তাদের কঠোর মনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেই ব্যস্ত তারা। অক্ষম, প্রবীণ বাবা-মা'র সেবা-যত্ন করা তো দূরের কথা, উল্টো তাদের বোঝা মনে করে তারা। ভুলে যায়, কী গভীর স্নেহে, অমানুষিক পরিশ্রম করে, নিজেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে তাদের মানুষ করেছে তারা। আজ যে তারা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, এর পেছনে কত রক্ত পানি করা পরিশ্রম তাদের বাবা-মা দিয়েছেন, এমনকি তা মনে রাখতেও চেষ্টা করে না তারা। বরং বৃদ্ধ অক্ষম বাবা-মাকে অপাৎতেয় মনে হয় তাদের, হাই সোসাইটিতে তাদের পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে তারা। যদি বাসায় থাকতেও দেয়, ছোট অপরিসর নোংরা ঘরে ফেলে রাখে পুরানো আসবাবপত্রের মত। আবার এও দেখেছি ২/৩ জন সন্তান থাকলে বাবা-মাকে ভাগাভাগি করে খাবার দেয়। কোন কোন নির্লজ্জ সন্তান গর্ভধারিণী মাকে অথবা বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেয়।

এরকম মর্মান্তিক অবস্থায় বাবা-মা শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে যান, অক্ষম অসহায় সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কোনদিন তাদেরই গর্ভজাত সন্তানেরা তাদের এতটা দুঃখ দিতে পারে।এ রকম যন্ত্রণাকাতর পরিস্থিতিতে কারও কারও জীবন-প্রদীপ নিভে যায়। কেউ বা রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এবং মানবেতর জীবনযাপন করেন, আর মৃতু্যর প্রহর গুণতে থাকেন, কেউ বা আশ্রয় পান বৃদ্ধাশ্রমে।

বৃদ্ধাশ্রম-বয়স্কদের আশ্রয় কেন্দ্র। প্রাণপ্রিয় সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে থেকে চরম অবহেলা আর অবজ্ঞা পেয়ে আশ্রয় পান-এই শেষ ঠিকানায়, আর ভাবতে থাকেন কবে এই গ্লানিকর জীবনের অবসান হবে।

ক্ষুদ্রস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থে আজ সারা বাংলাদেশ জর্জরিত। তাই স্বাধীনতার ৪০ বছরেও দেশে অন্যান্য ক্ষেত্ররমত ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধেরও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। এই ব্যক্তিস্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে একান্নবর্তী পরিবার ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। কোন ছেলের বৌ শ্বশুর-শাশুড়ি, চাচা-চাচী, ভাই-ভাবী, দেবর-ননদ নিয়ে আজ আর সংসার করতে চায় না, অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রায়ই দেখা যায় বিয়ে করার পর প্রাণপ্রিয় সন্তান ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। তারাও যে একদিন বাবা-মা হবে-এ কথাটি পর্যন্ত ভুলে যায়। তাদের সন্তানেরাও এ ধরনের ন্যক্কারজনক ব্যবহার একদিন ভবিষ্যতে করতে পারে-এ কথা একবারও মনে জাগে না তাদের। একটুও বিবেকে তাড়িত না হয়ে অমানুষের পর্যায়ে নেমে আসে তারা। আর ভাবে তারা যা করছে ঠিকই করছে। 

একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ায় স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, তবে তাদের এই অমানবিকতার কদর্য ও নগ্ন বহিঃপ্রকাশ এতটা প্রকটভাবে জানা যেত না, গাজীপুরের মনিপুর বিশিয়া বৃদ্ধাশ্রমে না গেলে। এখনও যে পৃথিবীতে কিছু ভাল মানুষ বেঁচে আছেন, অসহায়, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষদের কাছে টেনে নেয়ার জন্য এই বৃদ্ধাশ্রম তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। তিনি সযত্নে গড়ে তুলেছেন এই বৃদ্ধাশ্রম-যাদের দেখার কেউ নেই, তাদের জন্য। এখানে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার জন্য কোন অর্থই হতভাগ্যদের দিতে হয় না। চাহিদা অনুযায়ী এদের কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ফ্রি দেয়া হয়। এই আশ্রমে ১২০০ বয়স্ক বাসিন্দা রয়েছেন। প্রতিষ্ঠাতা মুকুল তার মিলকারখানার আয়ের বিরাট একটি অংশ এই বৃদ্ধাশ্রমের জন্য ব্যয় করেন। তার এই আশ্রমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রকৃত অসহায়দের ভর্তি করা হয়। নিজ চোখে দেখেছি, এই বৃদ্ধাশ্রমে এমন অনেকেই আছেন, যারা এক সময় অত্যন্ত ধনাঢ্য জীবন-যাপন করেছেন, সন্তানদের পেছনে অকাতরে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছেন, কেউ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। কেউ স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর সম্মানীত শিক্ষক,অধ্যক্ষ,অধ্যাপক এবং সকারের দাপুটে সচিব পর্যন্ত ছিলেন! অথচ ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে, এরা কেউ স্বেচ্ছায় এখানে আসেননি, প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অপমানিত হয়ে, লাঞ্ছিত হয়ে, বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে তাদের থাকা-খাওয়ার কোন অভাব নেই। অভাব শুধু প্রিয় জনের সান্নিধ্যের, যা তাদের প্রতি মুহূর্তে পীড়া দেয়, প্রাণ হাহাকার করে ওঠে স্মৃতির তাড়নায়। 

বৃদ্ধ বয়সে প্রত্যেকেই চায় নাতি-নাতনি নিয়ে আদর-সোহাগে মেতে উঠতে, তাদের কাছে টেনে নিয়ে পুরানো দিনের গল্পে মেতে উঠতে। কিন্তু সন্তানদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে তারা কিনা দুঃসহ নিঃঙ্গতায় দিন যাপন করছে। এমনও দেখা গেছে, ঐ আশ্রমে কেউ ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে দেখতে গেলে, ঐ হতভাগ্যরা ক্ষণিকের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। ওদের কাছে টানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, পরক্ষণেই দু'চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়তে থাকে, হয়ত বা প্রাণপ্রিয় নাতি-নাতনির কথা মনে পড়ে যায়। ধিক্ ঐ কুলাঙ্গার সন্তানদের আর তাদের আত্মীয়-স্বজনদের, যারা আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। হয়ত কেউ কেউ সভা-সমাবেশে মানবাধিকার নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেন। মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় হয়ত বড় অংকের চাঁদা দেয়, বড় বড় আদর্শের বুলি আউড়ায়। কিন্তু বাবা-মা'র মনে আঘাত দিয়ে অন্য যত বড় কাজই করুক না কেন, এমনকি ধর্মস্থানে গিয়ে মাথা ঠুকলেও সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। প্রতিটি ধর্মেই বলা হয়েছে, বাবা-মা'র পায়ের নিচে স্বর্গ বা বেহেসত(সর্বচ্চ সম্মানের রুপকার্থে)। মাকে বলা হয়েছে, মা-স্বর্গাদপী গরীয়সী। এর মর্মার্থ ঐ কুলাঙ্গাররা উপলব্ধি করতে পারেনি। যদি পারত, তবে বাবা-মা'র অন্তরে ওরকম অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারত না; বরং তাদের সযত্নে, শ্রদ্ধাভরে উচ্চ-আসনে বসিয়ে রাখত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন