সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ভালোবাসার মিথোলজিঃ


ভালোবাসার মিথোলজিঃ

লিখেছেন বাবুয়া, সকাল ১০: ৪৬, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভালোবাসার মিথোলজিঃ

পৃথিবীতে সবচাইতে প্রাচীনতম, সবচাইতে রোমাঞ্চকর,স্বপ্নীল ও ঘোর লাগানো বিষয় হলো ভালোবাসা। ভালোবাসার চাইতে কমন কোনো শব্দ বিশ্ব ইতিহাসে নাই। প্রিয় কবি সুনীল গংগোপধ্যায় বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে ১০৮টি নীল পদ্ম খুজে পেলেও আমি বিশ্ব সংসারে একম কোনো মানুষ খুঁজে পাবোনা-যিনি একবারের জন্য হলেও প্রেমে মজেনি বা ভালোবাসেননি। ভালোবাসাই পৃথিবীর একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যেখানে ধনী-গরীব,ছোট-বড়,ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই একই কাতারে মিশে যায়। ভালোবাসার এমন মহাত্মের রসায়ন বিশ্লেষণ করা যাকঃ-

ভালোবাসা মূলত নর-নারীর একপ্রকার আন্তঃমনো ও আন্তঃযৌনানূভুতির প্রকাশ ও বিকাস। যেসমস্ত গ্রন্থির ক্ষরণ দেহের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ সেই গ্রন্থিগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলায় অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। এই অন্তঃক্ষরা বা নালীবিহীন গ্রন্থিগুলো দেহের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াগুলোকে সুসংঘবদ্ধভাবে কাজ করায় এবং অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করায়। শরিরবিদরা মানবদেহে ছয়টি অন্তঃক্ষরা না নালীবিহীন গ্রন্থি শনাক্ত করেছেন। সেই ছয়টি গ্রন্থি হচ্ছে-
১। পিটিউটারি গ্রন্থি
২। থাইরয়েড গ্রন্থি
৩। প্যারা থাইরয়েড গ্রন্থি
৪। আয়্যাডুনাল গ্রন্থি।
৫। অগ্নাশয় গ্রন্থি
৬। যৌন গ্রন্থি।
শরিরে যে গ্রন্থিটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাকেইবলে পিটুইটারি গ্রন্থি। এই গ্রন্থির অবস্থান মধ্য মস্তিস্ক। এর আয়তন একটি মটর দানার মত। এই পিটুইটারি গ্রন্থিই যৌন গ্রন্থির কার্য নিয়ন্ত্রন করে।অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির মধ্যে এটা সব চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।মানব আচরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলেই এই গ্রন্থিকে প্রভূ গ্রন্থিও বলা হয়। নারী পুরুষের যৌন হরমোন নিঃসৃত হয় পুরুষ দেহের অন্ডকোষ ও নারী দেহের ডিম্বাশয় থেকে।পুরুষ ও নারীর যৌন হরমোনের মধ্যেও পার্থক্য আছে। পুরুষের যৌন হরমোনের নাম ‘টেস্টোস্টেরন’ আর নারীর যৌন হরমোনের নাম ‘ইস্ট্রোজেন’। এই হরমোন গুলোর প্রভাবেই পুরুষদেহে পুরুষ সুলভ ও নারী দেহে নারী সূলভ বৈশিস্ট ফুটে ওঠে। সেই বাহ্যিক বৈশিস্টের কারনেই মূলত নারী পুরুষ পারস্পরিক সান্নিধ্য কামনা করে-যাকে আমরা ভালোবাসা বলি।
পাঠক উপরের অংশটুকু আমি জেনেছিলাম বিশিস্ট মনোবিজ্ঞানী ডা মোহিত কামাল’র একটা লেখায়-কাজেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

ভালোবাসা মুলত কামনা, কামনাকে ব্লগ পরিভাষায় বলা হয় "লুল" -যার ইংরেজী শব্দ হতে পারে-Eros. (প্রিয় পাঠক, "লুল" শব্দটা দেখে কেউ নিজেকে স্বমার্থক ভেবে আমাকে "কইস্যা মাইনাস" দিতে চেষ্টা করবেননা। আর কামনা ও লুলামীর চুড়ান্ত কিম্বা কঠিন শব্দকে বলা যায় যৌনতা। তাইবলে কেউ ভেবে বসবেননা-আমি ব্লগের কোনো লুলের লুলামীর সমর্থক।

আসলে ভালোবাসার রসায়ন বলে কিচ্ছু নেই। ভালোবাসা সম্পূর্ণটাই অনূভুতির ব্যাপার। মনের দূর্বোধ্য কোণে এর বসবাস। নির্দিস্ট কিছু কথা,নির্দিস্ট ছক, ব্যাখ্যা, ব্যাকরণ দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেনা।অল্প অল্প সত্য, বেশী বেশী মিথ্যায় গঠিত হয় বেশী বেশী ভালোবাসার যুগল। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন-"প্রেম কি? এই প্রশ্ন যদি কেউ আমাকে করেন তাহলে আমি সবিনয়ে বলবো-“আমাকে জিজ্ঞেসা করলে আমি জানিনা, জিজ্ঞাসা নাকরলে জানি”"। কবিগুরু তাঁর "মায়ার খেলা" নায়কের মুখে আরো একটু এগিয়ে বলিয়েছেন-"আমি কি যে করেছি পান,কোন মদিরার রসভোর, আমার চোখে শুধু ঘুমঘোর"! অন্যদিকে সেক্সপিয়ার In Mid Summer Night’s Dream কবিতায় লিখেছেন- “The lunatic, the lover and the poet Are of imagination all compail”. 

সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। তাইতো ইংরেজ কবি কিটস বলেছিলেন-”Truth is beauty,beauty is truth.A thing of beauty is joy for ever”. কিন্তু এই মতের বিপরীতেও কিছু কথা আছে। তাইতো মহাত্মা গান্ধী বলেছেন-“অন্তরের বিশুদ্ধতার মধ্যেই প্রকৃত সৌন্দর্য বিদ্যমান”। একই বিষয়ে এব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন-“"ঈশ্বর সাদামাটা চেহারার লোকদেরই বেশী পছন্দ করেন। সেজন্যই তিনি অধিক সংখক লোকদের চেহারা সাদামাটা বানিয়েই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন"।“
কাজেই ভালোবাসার ক্ষেত্রে চেহারা গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনোক্রমেই তা আবশ্যিক নয়। পাঠক,আপনাদের মধ্যে কারো চেহারা যদি আমারমত হয়-তাহলে আপনার স্যাটিস্ফেকশনের জন্য বলছি-ভালোবাসার জন্য আবশ্যিক হলো সুন্দর একটি মন। মনটা সুন্দর হলেই আপনি ভালোবাসতে পারবেন। মনে রাখবেন-ভালোবাসা যেখানে যত গভীর হয়-সেখানে বাহ্যিক চেহারা ততই গৌণ হয়ে যায়।

পৌরাণিক কাহিনীতে পড়েছিলাম-এক সুদর্শন রাজপূত্র প্রেমে পরে কুতসিত চেহারার এক মেয়ের। তা নিয়ে সবাই যখন রাজপূত্রকে হাসি তাচ্ছিল্য করতো তখন প্রেমিক রাজপূত্র বলেছিল-“আমার চোখ দিয়ে ঐ মেয়েকে দেখুন-তখন বুঝবেন ও কতো সুন্দর”! একারনেই বোধ করি ইরানী একটি প্রবাদ আছে-ভালোবাসার মুখখানিকে চন্দ্রালোকিত রাতে দেখতে হয় অর্ধেক মনের দৃস্টি আর অর্ধেক কল্পনার দৃস্টিতে। তাইতো শেক্সপিয়ার বলেছিলেন”Loves looks not with eyes but with the mind”.

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-আমরা কি ধরনের প্রেম প্রত্যাশী? নিষ্কাম প্রেম নাকি কামজ প্রেম? বাস্তবতা জানিনা তবে নিষ্কাম প্রেম মূলত মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বেশী প্রধান্য পেয়েছিল। তাইতো চন্ডিদাস একটি পদ লিখেছিলেন-
“"রজকিনী প্রেম নিকষিত হেন,কাম গন্ধ নাহি তায়"”। 
লালন সাঁইজী তাঁর গানে বলেছেন-"“প্রেম কর আত্মার সনে, দেশের সনে নহে”"-এইধরনের ভালোবাসাকে বলে ‘প্লেটোনিক লাভ”।

প্লেটোনিক লাভের বিপরীতধর্মী জ্ঞানীগুনী ব্যাক্তিরাও কম যাননা। যেমন আমাদের অকাল প্রয়াত কবি/লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন য়াযাদ ‘কামজ প্রেম’র ঘোর সমর্থক। তিনি লিখেছেন-"কোটি বছরের বিশুদ্ধ প্রেমে থেকে একবার একটি পরিপূর্ন সংগম অনেক বেশী সুখকর"”। কবি নির্মলেন্দু গুণ প্লেটোনিক ভালোবাসা বিষয়ে বলেছেন-“"এটি হচ্ছে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান ও চরিত্রবতীদের মানষিক যন্ত্রনার প্রতিফল"”!-কথা কিন্তু একটা মিথ্যা নয়!

প্রেম নিয়ে তর্ক ও বিতর্কের শেষ নেই। পক্ষে বলে যেমন প্রেমিক প্রেমিকার আস্থা ভাজন হওয়ার অনেক সুযোগ আছে-তেমন বিপক্ষে বলেও ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক প্রেমিকার আস্থাভাজন হবারও সুযোগ আছে। আমি কোনো পক্ষে নাইবা বলি। শুধু বলবো-দূনিয়াটা বিশাল একটা প্রেমের ক্ষেত্র। এখানে সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রেমের ফাঁদে বন্দী। প্রেমের বাসভূমে আমরা সবাই প্রেমিক-কেউ জেনে, কেউ নাজেনে।কেউ ভেবে, কেউ নাভেবে। 

প্রেমের প্যাচাল শেষ করার আগে দুনিয়ার তাবত প্রেমিক-প্রেমিকাদের উদ্দেশ্যে আধুনিক কবিদের কবি এজরা পাউন্ড এর The Spirit of Romance গ্রন্থের ল্যাটিন কবিতার দুটি লাইনের ইংরেজী অনুবাদ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি-
Let who ever never loved, love tomorrow,
Let who ever has loved, love tomorrow.

একমাত্র ভালোবাসাই পারে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করতে। ভালোবাসা শুধু একদিনের জন্য নয়।কিন্তু আজকের ভালোবাসা দিবসেই আমাদের অংগীকার হোক-আমাদের প্রিয় ব্লগের সকল ব্লগারগন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসায় এক দৃস্টান্ত স্থাপন করি। ভালোবেসে পৃথিবী থেকে দূরকরি সব অশান্তির জঞ্জাল। 

একদিনের ভালোবাসা দিবস নয়- আসুন আমরা সবাই ভালোবাসি বার মাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন