মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য যে সংগ্রাম সূচিত হয় তার সাথে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সুগভীর সম্পর্ক। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

প্রকৃত পক্ষে ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের রয়েছে অনন্য সাধারণ অবদান। যা জাতি চিরদিন গর্বভরে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের অন্যান্য আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরের পরিপূরক। কারণ ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগ থেকেই ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয় তা পরিপূর্ণরূপ লাভ করে ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র একমাস আগে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ বলেন,

“ভারতে যেমন হিন্দী রাষ্ট্র ভাষা হতে চলেছে
পাকিস্তানে তেমনি রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হওয়া উচিত।”

এ কথার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসাবেই বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাস পরে করাচীতে এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ খবর ঢাকায় পৌঁছালে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আর এটিই ছিল রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে প্রথম সভা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল হক ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ২ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন’। এ পরিষদ ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলা ভাষার দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘটের সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেক ছাত্র আহত হন এবং অনেকে গ্রেফতার হন। 

প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।’ এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ধর্মঘট পালন করে। এ দিন ‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করতেই হবে’ এ দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গণপরিষদের সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় ‘যতদিন বাংলা ভাষা পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন থেকে বিরত থাকবে না।’ এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট, সভা ও মিছিলের কর্মসূচী ঘোষণা করে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের ডাক দেয়ায় সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। 

কিন্তু ২১শে ফেব্রয়ারি সকাল থেকেই ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজের জরুরী বিভাগের অধীনে) ছাত্র জমায়েতে উপস্থিত হয়। এ ছাত্র জমায়েতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানে পরিকল্পনা করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের দশজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ জন করে ছাত্ররা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে ২/৩টি দল এগিয়ে গেলে তাদের উপর পুলিশ হামলা চালায়। ফলে কৌশল পরিবর্তন করে শুধু ছাত্রীদের মিছিলে পাঠান হয়। এ মিছিলেও পুলিশ হামলা করে এবং অনেককে গ্রেফতার করে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এরপর পুলিশ কোন প্রকার হুঁশিয়ারি না করে মিছিলে গুলি চালায়। এ গুলিতে শহীদ হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত। অন্য এক সূত্রে জানা যায় এদিন ৮ জন ছাত্র নিহত হন এবং আহত হন ২০০ জন। এ ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়। এত আন্দোলন সংগ্রাম আর রক্তঝরার পর কোন উপায় না পেয়ে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে প্রতি বছর পালন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। সময়ের আবর্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে পালন করছে সারা বিশ্ব। যার গৌরব শুধুই আমাদের।

তথ্য সূত্রঃ- 
১) বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-রঙ্গলাল সেন। 
২) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-এম,এ বার্ণিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন