মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ


শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৯: ২৫, ০৪ মার্চ, ২০১১

শিশুশ্রম, শিশু অধিকার এবং বিবৃতিবাজ মানবাধিকারঃ

“শিশুশ্রম অবসানকল্পে দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু বিষয়ক রাওয়ালপিণ্ডি ঘোষণার অন্যতম সমর্থক ও স্বাক্ষরকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সমর্থন আর স্বাক্ষর শুধু কাগজেই রয়েছে। বাস্তব চিত্র তার উল্টো। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় গত ২৮ আগস্ট ছাপা হয়েছিল ১২/১৩ বছরের একটা শিশু টেক্সটাইল মিলে কাজ করছে, তার ছবি এবং সেই টেক্সটাইল মিলস কর্তিপক্ষের সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য। আবার ২০ সেপ্টেম্বর তেরো পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিলÑ আট বছরের একটা শিশু স্কুল বাদ দিয়ে রিকশা চালাচ্ছে, সেই খবর। ২০ সেপ্টেম্বর বারো পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ- “লেহাপড়া হরতে মন চায়। মাছ ধরতে ইচ্ছা হরে না। কিন্তু কী হরমু! মাছ না ধরলে না খাইয়া থাহা লাগে”-এই কথাগুলো ১০ বছরের একটা শিশুর। এইসব শিশুর জন্যই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার না নিয়ে- এরা বড় হচ্ছে দারিদ্র্যের চার দেয়ালের মধ্যে। যেখানে জ্ঞানের আলো দূরে থাক, সূর্যের আলোই পৌঁছে না”-ইহা একটি মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট।

আমি পেশাগতভাবে শিল্প ব্যাবস্থাপনা, শ্রম আইন ইত্যাদি বিষয়ে মোটামুটি ধারনা রাখি। সত্যিকথা বলতে কী-তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুশ্রমিকের আধিক্য থাকলেও উন্নত দেশে শিশুশ্রম দূর হয়েছে এমন ধারণা করা ঠিক না। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬%-এর বয়স ১৫ বছরের নিচে।বর্তমানে সরকারী নিয়মে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হলে আমরা ৫০%কেই শিশু হিসেবে ধরতে পারি। এই শিশুদের মধ্য থেকে সর্বাধিক সংখ্যকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কল-কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। অথচ এই শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের গড়ে তোলার ওপরই নির্ভর করবে দেশের উন্নতি অবনতি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার কাজটি কষ্টসাধ্য। কিন্তু কাজটি যতোই কঠিন হোক, ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের কথা চিন্তা করেই শিশুদের অধিকার সংরক্ষণে সবার উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। 

শিশুশ্রম আইনত নিষিদ্ধ হলেও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অধিকাংশ শিশুকে বিভিন্ন কায়িক শ্রমের কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। এ কারণে কেবল শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নয়, কর্মক্ষেত্রে শিশুদের নানা রকম অত্যাচার নির্যাতন সহিংসতা ও প্রবঞ্চনার শিকার হতে হয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত শিশুরা প্রায়ই গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর দ্বারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়। অনেক সময় এ নির্যাতনের ফল হাসপাতাল পর্যন্ত গড়ায়। আবার কখনো মৃত্যুও ঘটে। অনেক ঘটনাই সংবাদপত্রে আসে না। 

যৌন কাজে এবং উটের জকি হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এদেশের শিশুদের যখন বিভিন্নভাবে পাচার করা হয়, তখন কিন্তু মানবাধিকারের ধারক ও বাহক বলে দাবিদার উন্নত বিশ্বকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। শিশুর অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাসমূহ কর্তৃক সমন্বিত কার্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা অবশ্যক। বাসাবাড়ি, হোটেল, গ্যারেজ ও দোকানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের নির্যাতনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ থাকা উচিত। শিশুদের মৌলিকাধিকার রক্ষার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা জরুরি।সেই সংগে যেদেশের বড় একটি অংশ দারিদ্রসীমার নীচেও মানবেতর জীবন যাপন করছে-সেই দেশে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে ভাবনার সুযোগ রয়েছে।বেঁচে থাকার জন্য ক্ষুণ্ণীবৃত্তির মাধ্যমেও “মানব জীবন” রক্ষা পেলেইনা “মানবাধিকার”এর প্রশ্ন!মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি-তাঁরা মানবাধিকারের পুঁথিগত বিষয়টাকেই শুধু গুরুত্ব দেন-কিন্তু “বাস্তবতা” উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়েছেন।তাঁরা অনেক সময়ই বাস্তবতা নাজেনেই পত্রিকায় নিবন্ধন, সেমিনারে গালভরা বক্তৃতা দিয়েই ‘নিজের অধিকার’ ফলিয়ে কৃতিত্ব জাহির করেন।

আমার লেখার শুরুতেই ১২/১৩ বছরের যে শিশুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে (শিশুটির নাম বাবুল মিয়া)-সেই প্রসংগে আমার কিছু বলার আছে। আলোচ্য শিশুটির বয়স ১২/১৩ বছর নয়-শিশুটির বয়স ১৭ বছর। শিশুটির পিতা মোঃ মাসুদ মিয়া সেই টেক্সটাইল মিলেরই মাস্টাররোলে কর্মরত একজন অদক্ষ অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে মাত্র ৪ মাস কাজ করেছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিক মাসুদ মিয়া মৃত্যু বরন করলে লেবার ‘ল অনুযায়ী মালিক পক্ষ কর্তিক ঐ শ্রমিক কোনো প্রকার আর্থীক সুবিধা প্রাপ্তির অধিকারী নন।তারপরেও সম্পুর্ণ মানবিক কারনে মাসুদ মিয়ার বিধবা স্ত্রীর হাতে টেক্সটাইল মিলের তিনজন মালিকের ব্যাক্তিগত সহায়তায় ১ লক্ষ টাকা দান করেন।মাসুদ মিয়ার পরিবারের উপযুক্ত কাউকে চাকুরী দেবারও আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।পরে মাসুদ মিয়ার বেকার, শুধু মাত্র নাম দস্তখত করতে জানা বড় সন্তান বাবুল মিয়া চাকুরীর জন্য যোগাযোগ করলে শুধুমাত্র মানবিক কারনে তাকে “মেশিন ক্লিনার হেল্পার” হিসেবে চাকুরী দেয়া হয়।সেই সংগে মাসুদ মিয়ার নিরক্ষর বিধবা স্ত্রীকে টেক্সটাইল মিলস’র একজন পরিচালকের মায়ের নামে পরিচালিত সম্পুর্ণ ব্যাক্তিগত ব্যায়ে পরিচালিত ইয়াতীমখানায় “আয়া” পদে চাকুরী এবং বাসস্থানের ব্যাবস্থা করাহয়।বর্তমানে বাবুল মিয়া এবং তার মায়ের উপার্জনেই ওদের ৫ সদস্যের পরিবার বেশ ভালোভাবেই চলছে।এই খবরটি উপড়ে বর্ণিত প্রথম প্যারায় যে মানবাধিকার নেতা লিখেছিলেন-তিনি সব যেনেও ভালোটুকু এড়িয়ে গিয়েছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন