সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

একুশের বিউগল বাজছে-রাজা আসছেন!


একুশের বিউগল বাজছে-রাজা আসছেন!
লিখেছেন বাবুয়া, সকাল ১০: ১২, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২



একুশের বিউগল বাজছে-রাজা আসছেন!

সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি বাউল গান আর যাত্রার ভক্ত ছিলাম। ছেলেবেলায় যাত্রা দেখে খুব মজা পেতাম। আমার দেখা স্বল্প সংখ্যক যাত্রা পালার সবগুলোই রাজা-রানী নির্ভরছিল। বেশীর ভাগ যাত্রা পালার শুরুটা হতো “রাজা”র আগমণের দৃশ্বে-যা ভিন্নতর ভাল লাগায় আমার মনে দাঁগ কেটে আছে এখনও। যাত্রা শুরু হবার কিছু বৈশিস্ট আছে। যেমন- যাত্রা শুরু হবার আগে যাত্রার কনসার্ট মানে বিউগল বাজানো হয়।যখনই বিউগল বেজে উঠত- তক্ষুণি দেখতাম গ্রীনরুম থেকে উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে সংলাপ বলতে বলতে রাজা আসছেন। রাজা আসছেন দ্রুত পদক্ষেপে যাত্রার খোলা মঞ্চে। তখন দর্শকরা স্বমস্বরে বলতেন- " রাজা আসছে, রাজা আসছে"।

এখন আর যাত্রা দেখা হয়না। কিন্তু যাত্রার শুরুতে রাজা আসছে, রাজা আসছে-তেমন একটা অনূভুতি উপলব্ধি করি ফেব্রুয়ারী মাসে। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি মাস যখন আসে তখনই সেই যাত্রার বিউগলের শব্দের মত শুনি প্রাণ মন কাঁপানো সেই হৃদয়গ্রাহী গান- "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি"- একই সংগে শুরু হয় বাংগালীর প্রানের স্পন্দন “একুশের বই মেলা”!

ফেব্রুয়ারী মানেই একুশ, একুশ মানেই বাংগালীর প্রানের নতুন এক উদ্দীপণা, এক ভিন্নতর শিহরণ! একুশ এলেই মনে হয় ছেলেবেলায় শোনা যাত্রার সেই স্টার্টিং কনসার্ট বাজছে, বিউগল বাজছে। ফেব্রুয়ারী এলেই সত্যি সত্যি রাজা আসেন- একুশের মুকুট মাথায় পরে। সালাম, বরকত, জব্বার- এরা কি আমাদের রাজা নন? ভাষার রাজা,মাতৃ ভাষা রক্ষার সংগ্রামের রাজা। বাংগালী ও বাংলাদেশীদের প্রকৃত রাজা কি তারা নন? যারা এই দেশকে ভালোবেসে বিদেশী ভাষার আক্রমণ থেকে নিজেদের দেশ ও মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, রাজপথে নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে পবিত্র ইতিহাস রচনা করেছিলেন-তারাইতো আমাদের প্রকৃত রাজা! এই ভাষার রাজাদের মধ্যে অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। কেউ কেউ এখনও আছেন সেই '৫২-এর ভাষা সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে-তাঁদের জানাই সালাম।

এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, একুশে ফেব্রুয়ারিই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সমুজ্জ্বল ও সুদৃঢ় সোপান। স্বাধীনতার স্বর্ণতোরণ। বাঙালীর সত্যিকার মন ও মানসকে, চিন্তা ও চেতনাকে জাগরিত করার তুফানী হাওয়ার মাসই হচ্ছে ফেব্রুয়ারী মাস। এই রক্তচ্ছাটা একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছিল বলেই আমরা ২৬ মার্চ আমাদের রঞ্জিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে পারছি। তাই একুশই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিউগল। এই বিউগল শুনেই দেশের আপামর কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ প্রান আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছিল মহান বিজয়।

আমরা অবশ্যই রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। আজ বৃটিশ বেনিয়া নেই। পাকিস্তানী শোসকরাও নেই। লুণ্ঠনকারীরা সব চলে গেছে। এখনতো সব আমরা আমরাই। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে অবশ্যই আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বিবেকের স্বাধীনতা-আমরা কি পেয়েছি? পৃথিবীতে ভাষার জন্য কোনো জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগের এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল। এ আন্দোলন শিক্ষা দেয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে। এ আন্দোলন প্রেরণা যোগায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিপ্লবের। এ আন্দোলন শিক্ষাদেয় অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করবার।

ধন, সম্পদ, বিদ্যা, বুদ্ধি -কোন কিছুই শুধু অর্জনের জন্য নয়। গচ্ছিত রাখার জন্যও নয়। বিতরণের জন্য। আমাদের মধ্যে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন। আবার অনেক বুদ্ধির পুঁজিপতিও আছেন। পুঁজিবাদ যেমন আমাদের জন্য ক্ষতিকর, বিদ্যা-বুদ্ধির পুঁজিবাদও তেমনি আমাদের জন্য অনিষ্টকর। সব থেকে বেশী ক্ষতিকর দেশ পরিচালনায় স্বৈরাচারী-স্বেচ্চাচারী মানষিকতা। আমাদের মনে রাখা উচিত-রাস্ট্রীয় শাসন ব্যাবস্থা যেধরনেরই হোক-সেই পদ্ধতি ‘শাসন’ ব্যাবস্থা নাহয়ে যদি ‘নাগরিক সেবা’ ধর্মী নাহয়-অর্থাৎ রাস্ট্র পরিচালনা যারা করবেন তারা যদি নাগরিক কল্যাণমূখী নাহন তাহলে আমরা যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থেকে যাব। নেতৃত্ব যদি দেশে ও দেশের মানুষের কল্যাণকামী না হতে পারেন-তাহলে আমরা লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মার সাথে, বেঁচে থাকা ১৬ কোটি মানুষের আশা আকাংখার সাথে বিশ্বাসঘাতকতারই শামিল হবে।

১৯৫২ ভাষা শহীদদের রক্তস্নাত পথ ধরে লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রানের বিনিময় আমরা মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি। কিন্তু আমরা কি এই অর্জনের জন্য আমাদের যা যা বর্জন করার কথা ছিল সে সব বর্জন করতে পেরেছি? সত্যিকার শিক্ষা, উন্নত রুচি ও নান্দনিকতার আলোকে আমরা কি নিজেদের আলোকিত করতে পেরেছি? আমরা একত্রিত হচ্ছি। কিন্তু দেশ গড়ার জন্য একতাবদ্ধ কি হতে পারছি, উদার মন নিয়ে কোন মুক্ত সামিয়ানার নিচে? আমরা কি পারছি-আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য,জাতীয় চেতনাবোধে সমুন্নত রেখে নাগরিক কর্তব্য পালন করতে? স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বিবেকের স্বাধীনতা। তবে আমরা কি সবাই আজ সত্যিকার বিবেকবান হয়ে আমাদের রাজনীতিকে, আমাদের অর্থনীতিকে নিজের-নিজের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে সুবিধাভোগের রাজনীতি, লোভ আর লালসার অর্থনীতি দূরে সরিয়ে রেখে পাবার ও প্রত্যাশার সব উলঙ্গ উল্লাসকে পরিহার করে একুশের মহান চেতনায় ও মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র প্রেরণায় জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারছি?

একুশের আন্দোলন এক গৌরবের উপাখ্যান। এর প্রেরণা সৃষ্টি, ধ্বংসের নয়। এর প্রেরণা নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বিকাশের প্রেরণা। এর প্রেরণা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রেরণা। সর্বোপরি একুশের প্রেরণা অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা। কিন্তু দূর্ভাগ্য! আজও আমাদের প্রেরনা প্রান পায়নি। যার জন্য স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও আমরা স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন