সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নিঞ্জা বৌ!


নিঞ্জা বৌ!

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ০২: ০৪, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

নিঞ্জা বৌ!

ইদানীং আমাকে ‘মুরব্বী’ হিসেবে কিছু পারিবারিক-সামাজিক দ্বায়িত্ব পালন করতে হয়। সম্প্রতি একজন নিকট আত্মীয়ের ছেলের জন্য ‘কণে’ দেখতে যেতে হয়েছিল-আজ সেই অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। পাত্রের বাবা আগের দিন নিজ শহর থেকে ফোন করে কনফার্ম হয়েছিলেন-আমি কাল বাড়িতেই থাকবো-কোথাও যাবোনা। তিনি কাল বিকেল চারটার মধ্যে আমার বাসায় আসবেন-নির্ধারন করা হয়।

বাসায় এসে আমার আত্মীয়টি ইনিয়ে বিনিয়ে জানালেন-‘হঠাত করেই তাঁর বড় ছেলের জন্য একটা মেয়ে দেখার প্রোগ্রাম করে ফেলেছি.........সেখানে আমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে, সাথে আমার স্ত্রী ও ছেলেদেরও যেতে হবে। অনেক কথারপর আমরা নিমরাজী হয়ে সংগী হই। যদিও আমাদেরকে বাড়ি থেকে নেয়া হয়েছিল ‘কণে’ দেখার কথা বলে-কিন্তু যেতে যেতে বলেছিল-“আমরা বিয়ের করানোর সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছি-তুমি মনে কিছু করোনা”। আমি সম্পর্কে পাত্রের মামা হই। আমি যা বোঝার-তা বুঝেফেলি! আমাদের ছোট ছেলেও বুঝে নেয় ঘটনা। ছোট ছেলেটির স্পস্টবাদীতার কুখ্যাতি আছে। ছোট ছেলেটি বলে-“"ফুফা, এখানে বিয়ে করবে যারা-তারাই ফ্যাক্টর-আব্বুর মনে করার বা নাকরার কি আছে। আমরা খেয়ে চলে আসব"। আমার ছেলের এমন বিরক্তির কারন-এই পরিবারের প্রতি বিভিন্নভাবে আমার অনেক বড় অবদান(পাত্রটি কলেক-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বি সি এস উত্তীর্ণ হয়ে সারদা পুলিশ একাডেমীতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকতো)......অথচ আজ বিয়ের সব কিছুই চুড়ান্ত করে আমাকে জানাচ্ছে......! যাই হোক-আমি সবকিছুই খুব সহজে গ্রহন করতে পারি-এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

পাত্র পক্ষের পরিবার যেমন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত-তেমনি সামাজিক মর্যাদায়ও অনেক এগিয়ে। কিন্তু আর্থীক বিবেচনায় বাড়তি কোনো বাহুল্য নেই। পাত্রটি ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের অফিসার অর্থাৎ সহকারী পুলিশ সুপার(প্রভিশন প্রিয়ড চলছে)।ঢাকা শহরের যানজটের মতই পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেসন জটের কারনে মাস্টার্স শেষ করতেই সরকারী চাকুরী এবং বিয়ের বয়স যায়যায় অবস্থা হয়েছিল। পাত্র পক্ষের পিতা-মাতা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও ‘লিবারেল কনজার্ভেটিভ’ ধ্যান ধারনায় অভ্যস্থ্য। পরিবারের সব সন্তানেরাও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ইসলামী ধ্যান ধারানায় জীবন যাপনে অভ্যস্থ্য।

কণে সহ কনে পরিবারও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, কনে পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীতে মাস্টার্স শেষ পর্বের ছাত্রী।কনে পারিবারিক, আর্থীক, সামাজিক সবদিকেই সুনাম ও স্বনাম খ্যাত। কিন্তু জীবন যাপনে ‘কনজার্ভেটিভ’/’রেস্ট্রিক্টেড’ বলাই সংগত। দুই পরিবারের মধ্যে ‘ধর্মীয় অনুশাসনগত’ মিলটাই বিয়ে বন্ধনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে-বললে ভুল বলা হবেনা। এরা ধর্মীয় ভাবে রক্ষণশীল হলেও আধুনিক প্রযুক্তিতে মোটেও পিছিয়ে নেই। পাত্র-কনে নির্বাচন হয়েছে ইন্টারনেটেই। আমি ও আমরা মানে অবিভাবকেরা শুধু সামাজিকতা পালন করতে যাই! এখানে আগে কণে-দেখার প্রয়োজন ছিলনা। কারন-“মিয়া-বিবি রাজীতো কীয়া করে কাজী”! যদিও পাত্রটি নিজেকে গুছিয়েনিতে আরো কিছু পরে বিয়ের জন্য সময় নিতে চেয়েছিল।

অভিজ্ঞতা বলে-এসবক্ষেত্রে মেয়েপক্ষের তাড়াহুড়ো করার অনেক যুক্তি দাড়করায়। যেমন-‘মেয়ের বাবা-মা হজ্বে যাবার আগেই পবিত্র কাজটি সম্পন্ন করে যেতে চান। কিম্বা কণের নানা/নানী/ দাদা/দাদী স্থানীয় কেউ মরনাপন্ন অবস্থা-মরার আগে নাতনীর বিয়ে দেখে মরতে চান। অথবা-পাত্রীর বড় ভাই আগামী -- তারিখেই আমেরিকা/ইংল্যান্ড ফিরে যাবেন। তিনি এবার গিয়ে ফিরবনে-তিন বছর পর-কাজেই এখন বিয়ে নাহলে বোনটির বিয়েতে বড় ভাইর আর থাকা হবেনা’! এই বিয়েতে শেষোক্ত অযুহাতটি প্রয়োগ করা হয়েছিল। পাত্রটি কিছুটা কাঁই কুঁই করলেও “আব্বা জান”এর কথার উপর আর নাবলতে পারেনি(যদিও পাত্রটি এমনটিই চেয়েছিল বলে আমার মনস্তাত্বিক ধারনা)।

উভয় পক্ষ আগে থেকেই সবকিছু চুড়ান্ত করে রেখেছিল-যার কারনে ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সুপারসনিক গতিতেই সম্পন্ন হয়ে যায়। বিয়েরপরেই ফ্ল্যাট ভবনের কমুনিটি সেন্টারে ম্যারেজ ডিনার সম্পন্ন হয়। যথা রিতী কনের বাবা, মামা অতিশয় বিনয়ের সাথে হাত কচলিয়ে বলেন-“আপনারা অনেক জ্ঞানী গুণীজন আমার এখানে মেহেরবানী করে এসেছেন-সে জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আল্লাহ পাকের ইচ্ছা নাহলে আপনাদেরমতো সম্মানীত মানুষ কোনোদিন আমার এখানে আসতেননা। আমি অধম গরীব মানুষ স্বল্প পরিসরে সম্মানীত মেহমানদের জন্য তেমন কিছুই আয়োজন করতে পারিনাই –সেজন্য সকলের কাছে আল্লারওয়াস্তে ক্ষমা গুজার করিতেছি”(এই কথাগুলো কিন্তু স্রেফ ভনিতা)!

বিদায়ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। এবার ‘কণে’ নয়, ‘বৌ’ দেখানোর পালা। আমি কণের মামা শশুর হলেও আমার ছেলের মত ওদের অন্যান্য অনেক তরুন কাজীনদের “ভাবী” দেখার পালা।কিন্তু কণে পক্ষ এমন কোনো আত্মীয়দের সামনে বৌ দেখাবেনা-যার সাথে সাক্ষাত “শরিয়ত অনূমোদন করেনা”! রাত যখন সাড়েএগারোটা তখন শশুর-মামা-খালু শশুর শ্রেনীর কয়েকজন এবং “দেবর” সম্পর্কীয় কয়েকজন “বৌ” দর্শনের অনুমোদন লাভ করে। উল্লেখ্য যে “দেবর’ শ্রেনীর দর্শকরা বৌ দেখার জন্য ছোটখাট আন্দোলন করেই ঐ অধিকার আদায় করেছিল।পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান এবং ডিনার শেষ হতে যতনা সময় লেগেছে-তার কাছাকাছি সময় লেগেছে “বৌ”দেখানোর আনুষ্ঠানিকতায়।

অবশেষে বৌ দেখলাম। আপাদমস্তক আবৃত শুধু চোখ দুটো আধা ইঞ্চির কমমত একটু ফাঁকা! সবাইকে “আচ্ছালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ” জানালো। আমাদেরমধ্য থেকে সকলের মুরুব্বী উত্তর দিলেন-“ওয়ালাইকুমাচ্ছালাম ওয়া রহমাতুল্লীল আমীন-ওয়া বারকাতাহু”। 

আমার ছেলে বললো-"-“----(পাত্রের নামটি গোপণ থাক) ভাই, তোমার বৌতো পুরা “নিঞ্জা”! এই কথাশুনে সবাই হেসে ফেলে এবং সেই হাসিতে বৌ’ও স্বশব্দে হাসিদিয়ে নিস্প্রান বিয়ের অনূষ্ঠানে একটুখানি আনন্দময় করেছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন