সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

"ইচড়ে পাঁকা"


"ইচড়ে পাঁকা"
১৬ ই জুলাই, ২০০৮ সকাল ১১:২৭


"মৌচাকে ঢিল" বিশেষ সঙখা "বিযে বাড়ী"-র জন্য এক টা লেখা পাঠাবার ইচ্ছায় আমি আমার মেমরী কারড রিওযাইন্ড করছিলাম- কোনটা রেখে কোনটা লিখবো সেই সিধান্ত নেবার জন্য। অনেক স্মৃতি ভেষে ওঠে-ছোট বেলা থেকে বড় বেলা যাবত। যে কোনএকটা লিখব ভাবছি। তবে তা ছোট বেলার কথা। আমার জীবনের মধ্য বেলায় অপ্রকাশিত গোপন প্রেমিকা-র বিয়েতে ছবি তোলার আমন্ত্রন পেয়ে অনেক কসট বুকে চেপে ছবি তুলতে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম-আমি আমার অনেক শখের মামইয়া ক্যমেরার লেন্স কভার ওপেন না করেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ছবি নষ্ট করেছিলাম-সেকথা লিখবনা। আজ লিখব আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি তখনকার একটি ঘটনা।

আমরা ২ ভাই বোন। আমি ছোট। বুবু আমার থেকে ১২ বছরের বড়। আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যান। তারপর থেকে আমার নামের সাথে "অপয়া" নামটাও জুড়ে যায়! যথারিতী সৎ মায়ের সংসারে আমাদের বড় হওয়া। বুবুই আমার মা, বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু সবই! বুবুর কোলে পিঠেই আমার বড় হওয়া, অক্ষর জ্ঞান, পড়া লেখা শেখা।

আমি যখন ৩য় শ্রেনীতে উঠলাম তখন বুবুর বিয়ে হয়। বুবুকে যখন শশুর বাড়ী নিয়ে যাচ্ছিল-তখন আমার কান্না আর চিতকারে বুবুর শশুর বাড়ীর লোকজন আমাকেও আপাতত বুবুর সংগী করে নিলেন। ছোট বেলায় আমি ছিলাম খুব বেশি ডানপিটে স্বভাবের। আমার মুখে নাকি সব সময় একটার পর একটা প্রশ্ন লেগেই থাকতো। যার কারনে আমাকে নিয়ে সবাই অস্বস্তিতে থাকত।

বুবুর বিয়ের দিন অনুসঠানে হল ভর্তি মেহমানদের মাঝে আমাকে দুলাভাইর কোলে বসিয়ে দেয়া হলো। আমি দুলাভাইর কোলে বসেই জানতে চাইলাম- "তোমার কি মুসলমানী করা হয়েছে"? দুলাভাই আমার প্রশ্ন শুনে থ! দুলাভাই উত্তর দিচ্ছেনা। আমিও নাছর বান্দা, আবার প্রশ্ন করি-"বলনা, তোমার মুসলমানী করা হয়েছে কীনা"? দুলাভাই মৃদু হেসে সম্মতি সুচক মাথা নাড়লেন। আমিও বল্লাম-"আমার মুসলমানী হয়েছে কয়দিন আগে, এখনো ভাল করে শুকায়নি"-বলেই আমার হাপ প্যন্ট খুলে দেখাতে যাচ্ছিছিলাম! সবাই আমাকে নিবৃত করল পরে দেখানো যাবে বলে। তারপরই আমি বায়না ধরলাম-"দুলাভাই, তোমার নুনু আমাকে দেখাও...তোমার নুনু কি শুকিযেছে"? তখন এক ভয়ংকর পরিস্থিতি! আমার জেদ এবং কান্না সম্পরকে বাড়ীর সবাই পরিচিত-তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাকে দুলাভাইর কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

অনেক ধুমধাম করে বুবুর বিয়ে হয়ে গেল। আমি খুব খুশি মনে আমার সব চাইতে আপন জন বুবুর সাথে দুলাভাইর বাড়ী গোপালগঞ্জ চলে যাই। আমি ওই বাড়ীতে গিয়ে মোটামুটি সব বয়সী ছেলে-বুড়ো দের জানাই আমার মুসলমানী হয়েছে...তাদের করা হয়েছে কিনা জান্তে চাই! আমার এই অভিনব প্রশ্ন শুনে বুবুর চাচাতো মামাতো যতো প্রকার ননদ আছে সবাই হই চই শুরু করেদিল! সব ননদরাই বলতে গেলে স্কুল, কলেজের উচু ক্লাশের ছাত্রী। যারা সবাই বিয়ে উপলক্ষে গোপালগঞ্জ এসেছেন। আমি ছিলাম তখন ন্যাড়া বেল মাথা! আমার ন্যাড়া মাথাটা ওদের আরও বেশী আকর্ষন করেছিল। সুযোগ পেলেই এক জন করে আমার মাথায় টোকা দিয়ে ছড়া বলে-"ন্যাড়া মাথায় তব্লার তাল, টাক দিলে যায় বরিশাল"-আর সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেবার উপক্রম! কেউ কেউ টান মেরে আমার হাফ প্যান্ট খুলে দেয় দৌড়! আমি মুখ বুজে ওদের আদরের জ্বালাতন সয্য করে যাচ্ছি। আমিও সুযোগ বুঝে ওদেরকে জানতে চাই-"তোমাদের কি মুসলমানী হয়েছে"? আমার প্রশ্ন শুনে ওরা লজ্জা পায়...হৈচৈ করে ওঠে! আমার কাছ থেকে দৌড়ে পালায়!! এর পর থেকে কেউ আমার মাথায় টোকা দিতে আসলেই আমি আগেই জানতে চাই-"তোমার কি মুসলমানী হয়েছে"? আমার লাগাতর প্রশ্ন শুনে কেউ কেউ আমার থেকে দূরে সরে যায়-আমাকে কম জ্বালায়! আবার কিছুক্ষন পর দল বেধে মেয়েরা এসে আমার মাথায় পিছন থেকে টোকা মেরে ছড়া কাটে...... আমি কয়েকবার বুবুর কাছে দৌড়ে গিয়ে নালিশ করেছি-বুবু বলে, "ওদের কাছে যেওনা, আমার কাছে কাছে থাকো..."। কিন্ত আমার মন চায় ছুটাছুটি করতে...

আমি হঠাৎ করে বললাম-"যে আমাকে মাথায় টোকা দিবে এবং ছড়া বলবে-সে আমার বৌ হবে"! আমার এই ঘোষনায় কিছুটা কাজ হল। কেউ আমাকে ন্যাড়া বলেনা! আমার মত একজন বেল মাথা, তার উপর আমার সামনের পাটির ২ টি দাঁত নেই-এমন  নায়কের বৌ হতে কেউ রাজী ছিলনা! আমি অনেকটা হাপ ছেড়ে বাচলাম-বেজায় খুশী আমি। এখন আমি সুযোগ পেলেই জানতে চাই-কার 'মুসলমানী হয়েছে'?

আমি অনেকটাই নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলাম-কারন সবাই আমার থেকে বয়সে বড়। হঠাৎ দেখি একদল মেহমান এসেছে। তাদের সাথে আমারি বয়সী একটি ফুটফুটে সুন্দর শিশু কণ্যা। তার নাম কুমকুম। মুহুরতেই তার সাথে আমার ভাব হয়ে গেল। আমি তার সাথে করে নিযে যাওযা ক্লাশ থ্রী’র নতুন বই দেখলাম-যে সব বই আমাকে বুবু অনেক আগেই পড়িয়েছে বাসায় বসে। কুমকুম আমার দুলাভাইর বড় বোনের ছোট মেয়ে। কুমকুম এর মাথাটাও আমার মত ন্যাড়া। আমার মত তার দাঁত পড়েছে। আমার ২ টা, ওর ৪ টা দাঁত নেই। কুমকুমকেও সবাই “ন্যাড়া বেল, ফোকলা বুড়ি” বলে মজা করে, খ্যাপায়! কুমকুম আমার মত শক্ত মনের না। সে কান্না করে, রাগ করে গাল ফুলায়! তার প্রতি আমার মায়া হল। আমিও তার মত বলে আমি তার দুঃখ বুঝলাম অন্তর দিয়ে। সেই ছোট বেলাতেই আমার হাতের লেখাছিল খুব সুন্দর। আমি গোটা গোটা অক্ষরে তার খাতায় লিখলাম-"তুমিও ন্যাড়া, আমিও ন্যাড়া, তোমারো দাঁত নেই, আমারো দাঁত নেই, আই লাভ উ" (আমি লাভ'উ বলতে শিখেছিলাম-বুবু'র কাছে, বুবু সব সময় আমকে আদর করে বলতেন-"রাগ করেনা হিমু, আই লাভ'উ")।

আমার হাতের লেখা সুন্দর তাই কুমকুম আমার লেখাটা ওর মা সহ বাড়ীর সবাইকে দেখালো। আমার বেয়াইন-রা আর একটা ইস্যু পেল আমাকে জ্বালানোর জন্য। সবাই বল্লো-"ও মা, এই ন্যাড়া পোলার মনের মদ্ধে এত চালাকী! এই বয়ষেই 'আই লাভ উ'! শালা ইছড়ে পাকা"! আমি বুঝতে পারলাম "ইছড়ে পাকা" কথাটা ভাল নয়। আমি দৌড়ে গিয়ে বুবুর কাছে জানতে চাইলাম-বুবু, "ইছড়ে পাকা" মানে কি"? বুবু শুধু আমাকে বল্লেন-"ওদের কাছে যেওনা ভাইয়া"।
আমি যদি ওই কান্ডটা বর্তমান জামানায় করতাম তাহলে আমার বেয়াইনরা নিশচই বলতেন-"শালা শুধু ইছড়ে পাকাই নয়-একদম ক্যামিকেল দিয়ে পাকানো"!

এখন পরেছি আর এক ঝামেলায়! সব বেয়াইনরা আমাকে দেখে বলে-"ন্যড়া বেল, আই লাভ'উ"! "ফোক্লা দাঁত আই লাভ'উ"-আসো আমরা বিয়ে করি"!! আমি সবাইকে বলি-"আমি তোমাদের কাউকে বিয়ে করবোনা, তোমরা আমার সাথে দুস্টামী কর, আমার মাথায় টোকা দাও"! কুমকুম-এর মা আমাকে ডেকে তাঁর কোলে বসালেন। আমার কপালে চুমু দিয়ে বল্লেন-"হিমু, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে"? আমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জানতে চাইলেন-'কেন বিয়ে করবা না, আমি কি দেখতে পচা'? আমি বল্লাম-"তুমি দেখতে ভাল, বুবুর মতো সুন্দর- কিন্ত 'বয়সে বড়' তাই তোমাকে বিয়ে করবোনা"। আমার একথা শুনে সবাই হাসে! কুমকুম’র মা আমাকে খুব আদর করেন-তাই আমি তার সাথেই বেশী থাকি...।

দেখতে দেখতে দিন চলে যায়। আমি বুবুর সাথে আমাদের বাড়ি চলে আসি। কুমকুম চলে যায় ওদের বাড়ী। কুমকুম-কে আমার আর আই লাভ উ বলা হয়নি। কুমকুম কেও আর আমি দেখিনি। আমার বুবুর বিয়ের ২ বছরের মাথায় সন্তানের মা হতে গিয়ে বুবুও আমার মায়ের পথ অনুসরন করেন....বুবুকে আমি খুব মিস করি...!! আমি মিস করি কুমকুমকেও.........
যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র-তখন পুরনো আত্মীয়তার সূত্র ধরে মূলত কুমকুমকেই দেখতে/খুঁজতে যাই ওদের ঢাকার পল্লবীর বাড়িতে। দেখা হয়, কথা হয় কুমকুমের সাথে। তখন সেই ছোট্ট কুমকুম আর ছোট্টটি নেই, সেই ছোট্ট কুমকুম তখন আর পুতুল নিয়ে খেলা করেনা-সে তখন কোনো এক যুবকের হৃদয় নিয়ে খেলা করে......

(আমার এই লেখাটা “মৌচাকে ঢিল” পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সংশধিত ভাবে) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন