সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমরা বেঁচে আছি কীভাবে?


আমরা বেঁচে আছি কীভাবে?

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৩: ৪১, ১৮ আগস্ট, ২০১১

আমরা বেঁচে আছি কীভাবে?

গত কয়েক মাস থেকে প্রচন্ড ব্যাবসায়ীক ব্যাস্ততা। এমনকি রমজান মাসটাও কাটছে প্রচন্ড ব্যাস্ততার মধ্যে। সকাল সাতটায় কর্ম দিবস শুরু আর শেষ হতে কখনও কখনও রাত তিনটা হয়ে যায়-তবুও কাজ শেষ হয়না! এই কয়মাসে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম,কক্সবাজার, কুমিল্লা, খুলনা, ময়মনসিংহ, বগুরা, রাজশাহী, রংপুর কতবার গিয়েছি তার হিসেব নেই। জয়েনভেঞ্চারে ১০০ ভাগ রপ্তানীমুখি একটি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত করতেই এই পরিশ্রম। আমাদের সংগী সব সময়ই আমেরিকান, জার্মানী, তাইওয়ান, কোরিয়া ও চীনা ব্যাবসায়ী ক্রেতা প্রতিনিধি দল তথা আমার বিজনেস পার্টনার(ইন্ডাস্ট্রিয়াল/ফিনান্সিয়াল ফরেন ইনভেস্টর এন্ড বায়ার)।এই লেখায় সারা দেশের বেহাল অবস্থার মাঝেও ‘"বাংলাদেশ অচিরেই সিংগাপু/সুইজারল্যান্ড এর মতো উন্নত হবে"’-সরকারের পদলেহনকারীদের সেই কোরাশ বিষয়ে কিছু লিখছিনা-শুধু বাংলাদেশের সব কিছুতেই ভেজালের মহোতসবের কথাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

আমার এই শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয় একদশমাংশ দেশীয় কাঁচামাল যোগান দেয় মুলত পুরনো ঢাকা এবং বুড়িগংগার অপর তীরের নির্দিস্ট ব্যাবসায়ীরা। যার কারনে বিদেশী বায়ারদের সন্তুস্টি এবং জার্মান কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট টিম’র জন্য প্রায়শই তাদের নিয়ে পুরনো ঢাকা এবং কেরানীগঞ্জ-কামরাংগীরচড় এলাকায় যেতে হয়েছে। সেই সূত্রেই পুরনো ঢাকার ব্যাবসায়ীদের কল্যাণে/ সৌজন্যে কয়েক দিন বিদেশে মেহমানদের নিয়ে ইফতারীও খেতে হয়েছে।

মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহের প্রথমটি হলো খাদ্য। ন্যাচারাল প্রডাক্ট হিসেবে মাছ-মাংস, ডিম, মুরগি, শাক-সবজি, ফল-মূল, যার মান নিয়ে আগে কোনোদিন কারো চিন্তা করতে হতো না,কিন্তু এগুলো নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। বিষাক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করে উৎপাদন, বিষাক্ত পানিতে মাছ চাষ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাঁস-মুরগি-গবাদিপশু ইত্যাদি পালন ও উৎপাদন, তাজা রাখার জন্য ফরমালিন ও রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োগ এবং ওজন বাড়ানো ও ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য এগুলোতে বিভিন্ন ওষুধ ও বিষাক্ত রং রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার রীতিমত ভয়াবহ। সব ধরনের তৈরি খাবারের বেলায়তো অবস্থা আরো শোচনীয়। কারণ, অধিকাংশ হোটেল, রেস্তোরাঁ, বা বেকারি-ফাস্ট ফুডের দোকানেই রয়েছে সস্তা নকল-ভেজাল-দূষণযুক্ত উপকরণের ব্যবহার। এছাড়াও রয়েছে পচা-বাসি এবং অস্বাস্থ্যকর-নোংরা পরিবেশে, অস্বাস্থ্যকর বাসনপত্রে, দূষিত পানিতে, অস্বাস্থ্যকর হাতে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করার ঝুঁকি ও প্রবণতা। জীবন ধারণের জন্য একান্ত বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত আমরা অনেকটা জেনেশুনেই খেয়ে চলেছি এসব খাবার। তৈরি খাবার হোক আর নিজে রান্না করে হোক-কোনোকিছুই এখন আর নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় না।

রোজার মাসে ইফরাতী বানিজ্যে সব সময়ই চকবাজার সবথেকে বেশী মিডিয়া কভারেজ পেয়ে থাকে-এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। মিডিয়ার কিছু উঠতি অর্বাচীন সাংবাদিক চকবাজারের ইফতারীকে এমন ভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে-যা দেখে মনে হতে পারে চকবাজারের ইফতারী নাখেলে রোজাটাই বিফলে কিম্বা জনমটাই বিফলে গেল! কিন্তু যেকোনো সচেতন মানুষ চকবাজারের বড় বাপের পোলায় খায়, আজগুবী নামের বিভিন্ন প্রকার কাবাব, শরবতের নামে নোংরা দুষিত ইফতারী নামের বিষের উতপাদন এবং পরিবেশন প্রকৃয়া দেখে বমি নাকরে স্বাভাবিক থাকতে পারবেনা। আমি ইফতারীর বিষয়টা বিস্তারিত বলে কাউকে আহত করতে চাইনা। আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই-আমার চায়না ভ্রমন পোস্টের একটি পর্বে সর্বভূক চায়নীজদের খাদ্য প্রসংগে লিখেছিলাম-
যাহার দুইটি পাখা আছে-তাহাই চিনারা খায়
কিন্তু তারা উড়োজাহাজ খায়না।
যাহার চারটি পা আছে-তাহাই চিনারা খায়
কিন্তু তাহারা টেবিল খায়না!”

অত্যন্ত লজ্জার কথা, খুব বেশী কস্টের কথা চকবাজারের সেই ঐতিহ্যবাহী "বড় বাপের পোলায় খায়" নামক কুখাদ্য এবং অন্য বেশীরভাগ নোংরা ইফতারী আমিতো দুরের কথা সর্বভূক চায়নীজরাও খেতে পারেনি!

প্রিয় পাঠক, ব্যাক্তিগত ভাবে আমি নিজেই পুরনো ঢাকার অনেক খাবারের ভক্ত। তারপরেও আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ-মিডিয়ার প্রচারনায় বড় বাপের পোলায় খায় নামক ঐ কুখাদ্য কেউ গলঃধারন করবেননা।

সভ্য সমাজে খাদ্যে ভেজাল অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে,কোথায় ভেজাল নেই তা নিয়ে এখন গবেষণা করা দরকার। অনেকে ভেজাল খাদ্যের ভয়ে মানসিকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত। জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও চলছে ভেজাল। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক-দেশে সরকার,পুলিশ প্রশাসন,আইন আদালত থাকা সত্ত্বেও ভেজালের দৌরাত্ম্য কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না? কেন এই রোজার মাসেও চলছে ভেজালকারীদের দাপট?এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, খাদ্যে ভেজালের অপরাধে দেশে কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থাই ভেজালকারীদের উত্সাহিত করছে। 

কী খাবো? নিরাপদ কোনো খাবার আদৌ কি আছে? মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল,সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক,জিলাপি-চানাচুরে মবিল,বিস্কুট,আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংস,জুস,সেমাই,আচার,নুডুলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ,পানিতে আর্সেনিক,ক্যাডমিয়াম,লেড,ইকোলাই। ভেজাল খাবার জাতিকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় শুধু নয়, সারা দেশের মানুষের কাছে এখন একটি বড় প্রশ্ন—কী খাচ্ছি আমরা? শুধু খাদ্যপণ্য নয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ,এমনকি স্যালাইনও বাদ নেই। ভেজাল হচ্ছে শিশুখাদ্য। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। নকলের দাপটে এখন আসল পণ্য চেনাই দায় হয়ে পড়েছে।

কেউ একজনকে খুন করলে প্রচলিত আইনে তার এজন্য ফাঁসি হতে পারে। অথচ যারা নকল-ভেজাল-দূষণযুক্ত পানি, খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ তৈরি করে কোটি কোটি লোকের জীবন ও জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দিচ্ছে, তাদের কি শুধু জরিমানা বা জেলই যথেষ্ট? এক্ষেত্রে বিচার করে ফাঁসি দেবার আইন করতে অসুবিধা কোথায়? কোনো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন দলমত বা ব্যক্তি কি এরকম একটি ভালো কাজের বিরোধিতা করবে? আর করলেইবা বৃহত্তর স্বার্থে তা শুনতে হবে কেন? হয়ত আপনাদের মনে আছে-আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহাথির মোহম্মদ ঢাকায় এসে বলেছিলেন, “দেশকে এগিয়ে নিতে চাইলে অপ্রিয় সঠিক কাজটিই করতে হবে”।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন