পাথরে স্বাধীনতা
সংগ্রামঃ-১
কোন জাতির গৌরবগাথা
ধরে রাখে তার শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস। সাহিত্যিক তার অনুভূতি প্রকাশ করেন কথার মালায়। ঐতিহাসিকেরও কলম
আছে। শিল্পীর আছে অন্তরদৃষ্টি। তার আবেগ মূর্ত
হয়ে ওঠে রঙে-রেখায়, পাথর খোদাইয়ে আর
সুর-শিল্পীর সুরের মূর্ছনায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের
শিল্পকর্মও আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের কথা বলে। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা আন্দোলন থেকে
শুরু করে স্বাধীকার আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে উল্লেখযোগ্য
অবদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের
সে অবদান ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত ভাস্কর্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
কলাভবনের সামনে ত্রিকোন বেদীর উপর স্থাপিত তিন মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য "অপরাজেয়
বাংলা"র বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত গৌরবময় ঐতিহ্যের বাণী বহন করে। সে বাণী যেন ৭১-এর
সীমা ছাড়িয়ে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। অপরাজেয় বাংলা
যেন সকল শোষনের বিরুদ্ধে শানিত সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ভাস্কর্য স্মরণ
করিয়ে দেয় প্রতিবাদী অমিততেজ যোদ্ধাদের কথা।
১৯৭৩ সালে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ "ডাকসু" মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার
উদ্যোগ নেয়। সে সময়ে ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম হামিদ শিল্পী
আব্দুল্লাহ খালিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেন। প্রয়োজনীয় আলোচনার
পর শিল্পী তিন ফুটের একটি মডেল তৈরি করেন। তিনটি ফিগারের
জন্য তিনজনকে মডেল হিসেবে নেয়া হয়। এরা হলেন বদরুল আলম বেনু, সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে ও হাসিনা আহমেদ।
ভাস্কর্যটির নির্মাণ
কাজের ব্যবস্থাপনা ও তদারকির জন্য তৎকালীন সমাজ বিজ্ঞান
বিভাগের সহকারি অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দিন, পদার্থ বিজ্ঞান
বিভাগের ড. বেলায়েত হোসেন এবং ম হামিদকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে সময়ে একটি বেদীর
উপর ভাস্কর্যটি নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেলেন স্থপতি কবি রবিউল হুসাইন। পরে তিন ফুটের
মডেল চারগুণ বৃদ্ধি করে তৈরীর সিদ্ধান্ত হয়। মডেলটির আনুপাতিক
সম্প্রসারণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহর ফার্ম-শহিদুল্লাহ এসোশিয়েট। লোহা ও পাথরের
সমন্বয়ে এই মনুমেন্টাল ভাস্কর্যটির ফিগার হচ্ছে লাইভ সাইজের দ্বিগুণ (১২ ফুট), প্রস্থ ৮ এবং ব্যাস ৬ ফুট। মাটি থেকে উচ্চতা
১৮ ফুট।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯
সাল পর্যন্ত ৭ বছর পরিশ্রম করে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এ ভাস্কর্যকে
মূর্ত করে তুলেন শিল্পী আব্দুল্লাহ খালিদ। একাত্তরের স্বাধীনতা
যুদ্ধের প্রতিরোধ, মুক্তি ও সাফল্যকে
ধারণ করেছে এ ভাস্কর্য। অপরাজেয় বাংলার মাত্র কয়েকগজ দূরে ঐতিহাসিক বটতলায়
১৯৭১ সালে ২ মার্চ বাঙালী জাতির অজেয় ইতিহাস স্বাধীনতার পতাকা প্রথম ওড়ানো হয়।
কলা ভবনের সামনে
আইল্যান্ডের উপর মাটি থেকে ১৮ ফুট উঁচু বেদীর ওপর ১২ ফুট উঁচু তিনটি ফিগার দীপ্ত ভঙ্গিতে
দাঁড়ানো। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতীক দুই পুরুষ যোদ্ধা এবং
সেবার প্রতীক এক নারী। ১৯৭৭ সালের ২৮ আগষ্ট এ ভাস্কর্য নির্মূলের পায়তারা
করা হয়। তখন সাধারণ ছাত্ররা এগিয়ে এসে তা প্রতিহত করেন। তখন সংঘর্ষে ৩
ছাত্র আহত এবং ৪ জন গ্রেফতার হন। এ ঘটনায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ছাত্ররা। তারা দ্রুত এ ভাস্কর্যের
নির্মাণ কাজ শেষ করার দাবি জানান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে
নারীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা পুরুষদের সাহস যোগিয়েছেন, যুদ্ধে আহতদের সেবাশুশ্রুষা করেছেন এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এর প্রতীক হিসেবে
ভাস্কর্য তৈরিতে নারী মডেল ছিলেন হাসনা আহমেদ। এরপরের ফিগার ডান
হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে ধরে রেখেছে রাইফেলের বেল্ট। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির
প্রতিনিধি এই মুক্তিযোদ্ধার চোখমুখ স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত ও আপোষহীন। মডেল ছিলেন বদরুল
আলম বেনু। তিনি আর্ট কলেজের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র অবস্থায়ই
এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। প্রথমে মডেল থাকলেও পরে বৃহত্তর ভূমিকায় শিল্পীর
সহকারি হয়ে কাজ করেন। তারপরের ফিগারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের। থ্রিনট থ্রি রাইফেল
হাতে দাঁড়ানো সাবলিল কিন্তু তেজদৃপ্ত ভঙ্গি। মডেল ছিলেন সৈয়দ
হামিদ মকসুদ ফজলে।
নির্মাণ কাজ ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি কাজ শুরু হয়। ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুরর রহমান নিহত হওয়ার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভাস্কর্যের কাজ
তখন শেষ পর্যায়ে। এরপর আবার শুরুর চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু নানা কারণে
হয়নি। এ সময় আব্দুল্লাহ
খালিদ পড়াশুনার জন্য লন্ডন চলে যান। কিন্তু লন্ডনে তার বেশি দিন থাকা হয়নি। দেশে ফিরে আসেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়
সিনেট ভাস্কর্যটি নির্মাণ কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেয় এবং ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে কর্তৃপক্ষ
কাজটি শেষ করা অনুমতি দেয়। অধ্যাপক এ কিউ এম বি করিমকে সভাপতি এবং কে এম সাদউদ্দিনকে
সম্পাদক করে নতুন করে ১১ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা
হলেন তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ এ এ এস বাকের, ড. বি এম মাহমুদ সৈয়দ, ড. সিরাজুল ইসলাম
চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. আখতারুজ্জামান, শরিফ উল্লাহ ভুঁইয়া, সামসুল আলম, ম হামিদ। ১৯৭৯ সালে ডাকসু
নির্বাচনের পর সহ-সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান ভাস্কর্য
কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৯ সালের ১৯ জানুয়ারী পুর্ণোদ্যোমে নির্মাণ কাজ
শুরু হয়। ভাস্কর্যের মূল মডেলটি রাখা হয় ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের
একটি কক্ষে। কিন্তু যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা নষ্ট
হয়ে যায়। পরবর্তিতে শিল্পী স্মৃতির উপর নির্ভর করে অপরাজেয়
বাংলার কাজ শেষ করেন।
শিল্পী আব্দুল্লাহ
খালিদ আর্ট কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার
অব ফাইন আর্টস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ফাইন আর্টসের ছাত্র
হলেও বরাবরই তার আগ্রহ ছিল ভাস্কযের উপর। এই ভাস্কর্য সম্পর্কে
তিনি বলেন, এই ভাস্কর্য নির্মাণের দীর্ঘ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তাদের আগ্রহ এ
কাজে প্রেরণা যুগিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন