মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

জনসেবা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা


জনসেবা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ১২: ৪৯, ১১ জুলাই, ২০১১

জনসেবা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা

গতকাল ১০ জুলাই সরকারী ভাবে পালন করা হয়েছে “জাতীয় মুসক দিবস”। মুসক মানে হলো-মুল্য সংযোজন কর। ইংরেজীতে বলা হয় VAT(Value added tax). জাতীয়ভাবে এই দিবস উদ্বযাপনের কারন-ব্যবসায়ী/ভোক্তারা বেশী বেশী ভ্যাট প্রদান করে দেশের রাজস্বখাত স্ফীত করবেন। ব্যাবসায়ীদের এই ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামুলক। ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন/নিবন্ধনের জন্য কোনো সরকারী ফিস নেই-এটা বিনে পয়শায় শুল্ক-আবগারী বিভাগ থেকে প্রদানের নিয়ম। সম্প্রতি একটি জেলা শহরে ১০০ ভাগ রপ্তানীমুখী একটি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করা হয়। রপ্তানীর জন্য ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সনদ নিতে গিয়ে মহা বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয়। ফ্যাক্টরীর কর্মকর্তা জানালেন ১০ হাজার টাকা নাদিলে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দেয়া হবেনা। প্রথমে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি-সত্যিই একজন শুল্ক কর্মকর্তা বিনে পয়শার সনদের জন্য ১০ হাজার টাকা দাবী করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই যোগাযোগ করে সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই! অথচ, এই সনদ আমরা ঢাকা থেকে খুব সহজেই বিনে পয়শায় পেয়েছি। 

আসলে প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাবে জনগণ ভুক্তভোগী হচ্ছে। সেবা গ্রহীতাগণ কর্তাব্যক্তিদের তাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইজন্য আমাদের প্রয়োজন জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে দীর্ঘ ৪০টি বছর অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার “প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো”র পদক্ষেপ নিয়েছেন। জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন- প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের। জন-প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো ছিল প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মূল উদ্দেশ্য। জনগণ যেভাবে সার্বিক সুযোগ-সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন তার প্রতি সহনশীল ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ করবে এটাই ছিল সকলের প্রত্যাশা। 

কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ বৃটিশ বেনিয়াদের মতোই প্রভুত্ব দেখাচ্ছেন। ফলস্বরূপ কোন কর্মকর্তার কাছে জনগণ সাধারণ নিয়মে পৌঁছাতে পারেন না। স্থানীয় কিছু টাউট পন্ডিত যারা অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে থাকেন তাদের নিয়ে বা তাদের সহযোগিতা ছাড়া কোন সাধারণ মানুষ কোন স্থানীয় প্রশাসকের কাছে যেতে সাহস পান না বা যেতে চাইলেও পাইকপেয়াদাদের প্রতিরোধের মুখে বাধাগ্রস্ত হন। 

আমাদের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে কোন মূল কাগজের নকল অথবা ফটোকপি/ সার্টিফিকেট কপি, ছাত্র-ছাত্রীদের মার্কসীট, বোর্ডের সনদপত্র, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট আকারের ছবি, সত্যায়িতকরণ: চারিত্র্যিক সনদপত্র বা প্রত্যয়নপত্র, দলিল-দস্তাবেজের ফটোকপি ইত্যাদি নিয়ম মাফিক ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত করতে হয়। অহেতুক সত্যায়িত প্রথায় নির্যাতিত হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বেশীরভাগ ভূক্তভোগীরা নিজেদের কাগজপত্র নিজেরাই সত্যায়িত করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। 

বিশেষ করে ভার্সিটি বা কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা এ কাজটি অহরহ করে আসছে। তারা বিভিন্ন নামে-বেনামে রাবার স্ট্যাম্প বা সীল তৈরী করে একটি স্বাক্ষর করে তাদের টেস্টিমোনিয়াল, মার্কসীট, সনদপত্র, ছবি ইত্যাদি সত্যায়িত করে প্রাতিষ্ঠানিক বা দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে বাধ্য হচ্ছে। কোন কর্তৃপক্ষ এগুলো কোনদিন নিরীক্ষা করে দেখেন না। শুধুমাত্র সত্যায়িত সীল সমেত কাগজপত্র হলেই হলো।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু হালে ঝামেলা এড়াতে ভুক্তভোগীরা নির্বাক হয়ে শুধু ঘরেই ফিরে যান। প্রতিবাদের ভাষা তাদের নেই। 

অতি-দরিদ্র জনসাধারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের ভাগবাটোয়ারা দিয়ে কৃষিঋণ উত্তোলন করতে দেখা যায়। সার, শস্যের বীজ, কীটনাশক সংগ্রহের ক্ষেত্রেও দরিদ্র কৃষককুল হিমশিম খেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারস্থ হয়। বিশেষ করে জমি রেজিষ্ট্রি করার ক্ষেত্রে সাব-রেজিষ্ট্রারদের সম্মুখে যেতে অনেক ফর্মালিটিস্ করতে হয়। বড় সাব/ বড় বাবু/ সরাসরি কোন দাতা বা গ্রহীতার কথা বুঝেন না বা দলিলে স্বাক্ষর দেন না। একশ্রেণীর ভেন্ডার দরিদ্র কৃষককুলকে নয়-ছয় বুঝিয়ে ১০ টাকার স্থলে তার ২০০/৩০০ টাকা খরচা করিয়ে তাদের দলিল দস্তাবেজ স্বাক্ষরে সম্মতি নেন। আইন শৃংঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীরাও দেশে নানাবিধ মাসোহারা আদায় করেন। যার মাশুল নিরীহ-দরিদ্র জনগণের উপরই বর্তায়। 

বর্তমানে চিকিৎসক যারা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চেম্বার করেন তাদেরকে কম্পিউটারাইড্ পদ্ধতিতে ফি দিতে হয়। সেখানে তাদের নির্ধারিত ৫০০-১০০০/= টাকা ফি-এর সাথে অতিরিক্ত ৫% ভ্যাটও জনগণকেই দিতে হয়। যিনি চিকিৎসক তার সরকারি/বেসরকারি চাকরি আছে। তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ট্যাক্সে চিকিৎসা বিদ্যার ডিগ্রী নিয়ে দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়েছেন। রাতে দিনে শত শত রোগী দেখছেন যার ট্যাক্স তিনি নিজে দিবেন। কিন্তু তদস্থলে তার ডায়াগনোস্টিক টেস্টসহ সর্বপ্রকার ফ্রি এর সাথে ভ্যাট নিচ্ছেন এতে ভুক্তভোগীদের অসহায়ত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে।বছর দুই আগে এ বিষয়ে মাননীয় হাইকোর্ট একটি রীট পিটিশনের রায় প্রদান করেছে-কিন্তু সেই রায়ের বাস্তবায়ন নেই। 

দেশের প্রতিটি সেক্টরে এরকম জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।এতদ্বিষয়ে সরকার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিলে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা বিষয়টির স্বচ্ছতা বুঝা যাবে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রায়নের পথ সুগম হবে। দেশ জাতির কল্যাণে জনপ্রতিনিধিগণ নিবেদিত হবেন, দেশ পাবে অর্থনৈতিক মুক্তি ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করবে। সরকারী কর্তাব্যক্তিরা জনগণের সেবক হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জন-প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো নাগেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটা পদেই দূর্ণীতি পৌঁছে দেয়া হয়েছে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন