সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমাদের নৈতিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষা


আমাদের নৈতিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠনিক শিক্ষা

ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরবো-দফায় দফায় জানাচ্ছে, ট্রেন ৪০ মিঃ, আবার ৩০ মিঃ, আবার এক ঘন্টা(আসলে অনির্দিস্ট সময়) জন্য লেট। বসে আছি ওয়েটিং রুমে-ইতোমধ্যেই ৩/৪টা খবরের কাগজ মুখস্ত করে ফেলেছি। ফেরিওয়ালা বিভিন্ন রকমের শিশুতোষ বই বিক্রি করছিল।আমি কৌতুহলী হয়ে কয়েকটি বই হাতে নিয়ে দেখলাম- বইগুলো দামী কাগজে উন্নত লেমিনেশন করা, উন্নত বাঁধাই। ফেরিওয়ালাকে অপেক্ষা নাকরিয়ে আমি বিভিন্ন রকমের ৫টি বই কিনি এবং ২০/২৫ মিনিটের মধ্যেই ৫ টি বই পড়া শেষ করি।

ঐ বইগুলো কেনো শিশুতোষ বই কিম্বা ঐ বইগুলো পড়ে শিশুরা কি শিক্ষা লাভকরবে-সে বিষয় কিছু লিখতে চাইনা। শুধু আমাদের ছেলেবেলার আর বর্তমান শিশুদের বইয়ের গুণগত ফারাকটাই আলোচনা করতে চাই। এখনকার বইগুলোর সাথে আমাদের সময়য়ের প্রাথমিক নৈতিক শিক্ষার কোনো মিল নেই! ছেলে বেলায় আমরা শ্রদ্ধেয় পন্ডিত রামেন্দ্র সুন্দর বসাক(স্মৃতি বিভ্রাট হলে- নামটা রাম সুন্দর বসাকও হতে পারে) লিখিত "বাল্যশিক্ষা" নামক একটি বই পড়েছিলাম-যে বইয়ে অনেক নীতিকথা ছিল। যখন আমাদের অক্ষর জ্ঞানও শিখা হতোনা-তখনই সেই বাল্য শিক্ষা বইটি আমাদের বড় ভাই-বোন, অবিভাব্কগন অনেক যত্ন নিয়ে আমাদের মুখস্ত করাতেন-সেই নীতিকথা আমাদের ঠোঠস্থ্য-কন্ঠস্থ্য মুখস্ত করা বাধ্যতামুলকই ছিলনা, সেই নীতিকথা আমরা পারিবারিক জীবনে পরিবারের সদস্যদের সাথে কতটা প্রয়োগ করছি-তারও পরীক্ষা দিতে হতো! 

জীবন ও জগত সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষের নৈতিক উত্কর্ষ সাধনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শিক্ষার সাথে নৈতিক জ্ঞান ও মূল্যবোধের যোগসূত্র যে রয়েছে সেটা কোনো নূতন কথা নয়। কথাটা পুরানো হলেও এই আধুনিককালেও তা উচ্চারিত হয় নানান উপলক্ষে।যেমন, আমি শিশু বয়সে মিশনারী স্কুলে পড়েছি। সেখানে ক্লাশ শুরুর পূর্বে বাইবেল থেকে কিছু নীতিকথা, খৃস্টীয় রিতীতে শপথ পাঠ সকল ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। “"ধর্মের বানী সর্বত্রই শান্তির"”-নীতিতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের ছাত্ররা সেই নীতি বাক্য নিজ নিজ ধর্মীয় অনূশাসনে পালন করতে সচেস্ট ছিলাম।

নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধের বিষয়টা আপেক্ষিক। আবার নৈতিকতা ও মূল্যবোধ-এই দুইয়ের মধ্যেও ব্যবধান রয়েছে। ইংরেজি 'ভেল্যুজ' এবং 'মরালিটি'- এক নয়। নৈতিকতার বিষয়টি শাশ্বত হলেও মূল্যবোধ একেক জাতির একেক রকম। মহান ভাষা আন্দোলন কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মধ্যে যে মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছে,অন্য কোনো জাতির মূল্যবোধের সাথে তা তুলনীয় নয়। পক্ষান্তরে,মিথ্যা বর্জনীয়,সদা সত্য কথা বলিবে,সকল মানুষকে ভালোবাসিবে,কেহ কাহারও উপর জুলুম করিবে না,অপরের সম্পদ হরণ করিবে না,নির্দয় হইবে না,কর্তব্য-কর্মে অবহেলা করিবে না-এইগুলো নৈতিক শিক্ষা। এই নৈতিক শিক্ষা চিরন্তন,দেশ-কালভেদে এসবের প্রভেদ দেখা যায় না। মিথ্যা বলা দুনিয়ার কোথাও কোনো ধর্মেই নৈতিকতাসম্মত নয়।

তবে দেশ ও কালভেদে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রভেদ রয়েছে। এক দেশে যা গর্হিত আরেক দেশে তা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হওয়া বিচিত্র নয়।প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নীতি-মূল্যবোধে বিরাট ব্যবধান। বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে গুরুজনের সম্মুখে কেউ সিগারেট ফুঁকলে তাকে বে-আদব বলতে খুব কম লোকই দ্বিধা করেন। আবার চল্লিশ-পঞ্চাশ বত্সর আগে এদেশের পল্লী সমাজে নিরক্ষর-হতদরিদ্র শ্রেণীর অনেক পরিবারে পিতা-পুত্রকে একসঙ্গে,এক বৈঠকে বসে হুঁকায় দম দিয়ে ধূম্র কুন্ডলী পাকাতে দেখা যেতো-তাতে কেউ কিছু মনে করতনা।

আধুনিককালের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যই হল-ব্যক্তিকে কোনো না কোনো কাজের জন্য বিশেষভাবে যোগ্য করে তোলা। সে বিবেচনায় নৈতিক শিক্ষার বিষয়টিকে অনেকেই শিক্ষা হতে আলাদা করে দেখতে চান। তারা এমনও বলেন যে,বিশ্বায়নের এই যুগে-এই বিশ্ব পল্লীতে এক দেশ হতে অন্য দেশে লোকের যাতায়াত বাড়ছে, প্রতিনিয়ত পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সাথে অন্য প্রান্তের মানুষের যোগাযোগ ও ইন্টারেকশান হচ্ছে।এ বাস্তবতায় প্রায়োগিক শিক্ষার সাথে নৈতিক শিক্ষার শর্ত পূরণ সহজ নয়। তার মানে এই নয় যে,তারা নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন। 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি-মানুষের নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান পাঠশালা হল পরিবার। পরিবারে যেমন নীতি-নৈতিকতার চর্চা হয়,পরিবারের ছেলে-মেয়েরা তেমনই নিজের জীবন অনুসরণ করে। 
তাই বলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নৈতিক বিষয়গুলি বর্জিত হবে-তেমনটি কাম্য হতে পারে না। শিক্ষা বলতে ব্যক্তির কর্মদক্ষতাই কেবল নয়,তার মানসিক উত্কর্ষ সাধনও বুঝায়। বিশেষ করে প্রাথমিক হতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত এবং বাস্তবেও তার প্রতিফলন বাঞ্ছনীয়। মানবিক গুণাবলীর যথার্থ বিকাশ না ঘটলে ব্যক্তির অর্জিত প্রায়োগিক শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে না। তার মেধা ও দক্ষতার সদ্ব্যবহারও তাতে বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই পরিবারে এবং শিক্ষাঙ্গনে ছেলে-মেয়েদের নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন অপরিহার্য। যার জন্য প্রয়োজন শিশুতোষ বইগুলোতে নৈতিক শিক্ষার জন্য শিক্ষনীয় কিছু সংযোজন করা। নৈতিকতা দৃঢ় নাহলে কোনো শিক্ষায়ই সুশিক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন