সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমেরিকার কড়চা-৪


আমেরিকার কড়চা-৪

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৮: ৪৯, ১৬ অক্টাবর, ২০১১

আমেরিকার কড়চা-৪

স্থানীয় সময় সকাল ১১ টায় আমরা হোটেলে পৌছি। হোটেলে পৌছার পর আমাদের জানানো হলো আজ রাতে হোটেল অডিটরিয়ামে/থিয়েটার হলে "একক অভিনয়ের" প্লে হবে-যা শুধুমাত্র এডাল্টরাই দেখতে পারবে। অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সীরা দেখতে পারবেনা।যদি আমরা সেই নাটক উপভোগ করতে চাই-তাহলে আমাদের বুকিং দিতে হবে।নাটকের বিশয়বস্তু জেনে আমরা নাটক দেখতে রাজী হই।আমার ছেলে কিড,ভায়রার মেয়েও এইট গ্রেড স্টুডেন্ট। কাজেই ওরা দুইজন হোটেল রুমে কার্টুন ছবি দেখবে-আমরা যাবো প্লে দেখতে।জন প্রতি টিকেট ১৫০ ডলার!এখানে তখন যদিও সামার তবুও আমাদের মত গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের মানুষের জন্য খুব শীত।একটা জিনিষ আমি লক্ষ করেছি সেই ইংল্যান্ড-জার্মানী থাকাকালীন থেকেই-বৃটিশ,আমেরিকান/কানাডিয়ানরা আমাদের মতো প্রতি দিন শাওয়ার করেনা।মাঝে মাঝে শাওয়ার করে-তাও রাতে ঘুমোতে যাবার পুর্বে।ওরা ওদের শরিরের দুর্গন্ধটা দামী পারফিউম দিয়ে ঢেকে রাখার ব্যার্থ চেস্টা করে!আমি আমার বৌ প্রতি দিন এবং অনেকবার শাওয়ারে অভ্যস্ত।আমরা যথা রিতি শাওয়ার করে হাল্কা কিছু খেয়ে চলে যাই নায়াগ্রা ফলস দেখতে।কিন্তু আজকের ছুটির দিন উপলক্ষে অনেক ভীড়।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি-কাল থেকে আমরা নায়াগ্রার সৌন্দর্য উপভোগ করবো-আজ অন্যান্য যায়গা ঘুড়বো। 

এখানে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ!বলতে গেলে সব সময়ই মেঘাচ্ছন্ন থাকে।মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারন হলো-অনেক অনেক উচু থেকে ঝর্ণার পানি নীচে পড়ে পানির ছিটা বাস্প হয়ে উপড়ে উড়ে চলে যায়-যা দেখতে কুয়াশার মতো লাগে।সেই জলীয় বাস্পে সুর্যের কিরন পড়ে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে অনেকগুলো রঙ ধনুর সৃস্টি হয়!মজার বিশয় হলো-রং ধনু কিন্তু একটা নয়-একাধিক!

আরো মজার ব্যাপার হলো আমি যেখানে শীতে কাপছি-সেখানে ইউরোপ-আমেরিকানরা এই শীতের ভিতরেও খুব হাল্কা কাপড় পরিধান করে হরদম ঘুড়ছে!মহিলারাতো আরো কয়েক ডিগ্রী উপড়ে-তারা পারলে শুধু অন্তর্বাস পড়েই ঘুড়ে বেড়ায়!এই কয়েক বছরে আমার বৌ-বাচ্চাও অনেকটা নিজেদের শীতের সাথে মানিয়ে নিয়েছে!সব টুরিস্ট স্পটেই যেমন অনেক সৌখিন জিনিষ কিনতে পাওয়া যায়-এখানেও তার ব্যাতিক্রম নয়।বাচ্চা পেঙ্গুঈন পাখীর মোলায়েম পালকের তৈরী একটা জ্যাকেট কিনি ৬৫০ ডলারে। যা বাংলাদেশে কোন দিন পরার সুযোগ হয়নি।এমন সুন্দর পালকের তৈরী জ্যাকেট আমি জার্মানীতেও দেখেছিলাম-কিন্তু তখন কেনার সামর্থ আমার ছিলোনা। আমরা ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছি আম টুকটাক জিনিষ কিনছি।নায়াগ্রায় প্রচুর হোটেল রেস্টুরেন্ট।সেই হোটেল রেস্টূরেন্টের নামগূলো বেশ অদ্ভুত!যেমন-Eat & Get Out,Empire Dinner/Lunch,Kings Lunch,Kings Dinner,Couple Dinner,Quinn Dinner,Lesbian Dinner,Gay Dinner,Six Dollar Lunch,Club Lunch ইত্যাদি। ছোট্ট একটা খাবার দোকানের নাম Pick –Pockets!আমেরিকার চাইতে এখানে খাবারের দাম অনেক বেশী।আমেরিকাতে খাবারের উপড় কোন ট্যাক্স পে করতে হয়না-তাই বোধ হয় পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমেরিকাতে খাবার খুব সস্তা।আমেরিকাতে ম্যকডোনালসে ১ ডলারে লাঞ্চ করা যায়!যা কানাডায় কল্পনাও করা যায়না!কিম্বা হতে পারে-এখানেও সস্তা খাবার পাওয়া যায় যা আমার জানা নেই। কিন্তু এখানকার খাবারের উপড় ট্যাক্স দিতে হয়।

সারা দিন আমরা ঘুড়ে বেড়ালাম বিভিন্ন যায়গায়।বলা যায়-আগামীকাল বেড়াবার জন্য একটা রিয়ার্সাল।এখানে বেশ কিছু শ্রীলংকান তামিলদের দেখা পেয়েছি-যারা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত।দিন গড়িয়ে রাত নেমে এলো।আমরা আবার ঘুরে ফিরে নায়াগ্রার কাছে গেলাম-গেলাম মানে কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাদের টেনে নিয়েগেল!না এখনও নায়াগ্রায় ভীড় মোটেই কমছেনা-বরং বেড়েই চলছে।দল বেধে মানুষ ফিরে আসছে-আবার দল বেধে মানুষ নায়াগ্রা দেখতে যাচ্ছে। রাতের আলোতে নায়াগ্রার অন্য রকম সৌন্দর্য!যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না,কিম্বা লিখে সেই সৌন্দর্য প্রকাশ করা যায়না!আমরা সন্ধ্যা সারে ছয়টার ভিতর লাঞ্চ শেষ করে হোটেলে ফিরি। কারন সন্ধ্যা সাতটা থেকে নাটক শুরু হবে।

নাটকের স্টেজটা ঠিক উইম্বল্ডন গ্রাস লন টেনিস কোর্টের মতো। "ডিম্বাকৃতির রাউন্ড" গ্যালারী। চারিদিক থেকেই সব দর্শকদের চোখ স্টেজে না পড়ে কোন উপায় নেই।মোট ২০০ জন দর্শক নাটক দেখছি।নাটকের নাম-'sex symbol'Marilyn: forever blonde' খুব সুন্দরী আমেরিকান একমাত্র অভিনেত্রীর নাম Sunny Thompson.অভিনেত্রী একা হলেও তার সাথে একদল দক্ষ যন্ত্রী আছে।নাটক শুরু হবার পুর্বে অভিনেত্রী তার নিজের পরিচয় দিলেন এভাবে-"আমি সানী। মিঃ থম্পসনকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর হয়ে যাই সানী থম্পসন। আমাদের বিয়েটা টিকেনি।আমি এখনো থম্পসনকে খুব মিস করি।তাই তাঁর নামটা এখনো আমার নামের সাথে রেখে দিয়েছি!বর্তমানে আমার ৩২ বতসর বয়স।বৃটেনের স্টাম্ফোর্ডে জন্ম। লন্ডন স্কুল অব আর্টস এন্ড ড্রামা থেকে গ্রাজুয়েশন করে আমেরিকার প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে নাট্য তত্ব এবং নাট্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং পি এইচডি ডিগ্রী নিয়ে ঐ ইউনিভার্সিটিতেই পার্ট টাইম পড়াই.........সেই সাথে অভিনয়কে পেশা হিসাবে নিয়েছি"।কি যে অপুর্ব সুন্দর উচ্চারন সেই সঙ্গে কথা বলার স্টাইল!

এ এক অপুর্ব,অসাধারন নাটক।আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর পুর্বে অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার “কোকিলারা”নামে একটা নাটকে একক অভিনয় করিয়ে দেখিয়েছিলেন বেলী রোড মহিলা সমিতি নাট্য মঞ্চে-যা আমি আমার বৌকে নিয়ে দেখেছিলাম।ফেরদৌসী মজুমদারও অপুর্ব অভিনয় করেছিলেন সেই একক অভিনীত নাটকে।একাই সব চরিত্রে অভিনয় করেন!এই নাটকে মেরিলিন মনরোর শৈশব বয়স থেকে মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত তাঁর অসাধারন জীবন কাহিনী সংলাপ এবং অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন!কিছু কিছু যায়গায় ভদ্র মহিলা কাহিনী বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন-মেরিলিন মনরোর boobs দুটো এবং butt বেশ বড় ছিলো-কিন্তু অভিনেত্রীর কিছুটা (দুই সাইজ)ছোট ছিলো তাও বলেছিলেন।মেরিলিন যখন ডেট করতেন তখন তিনি ব্রা এবং পেন্টি পরতেননা-যার কারনে পুরুষরা মেরিলিনকে ন্যুড দেখার সাথে সাথে তার উপড় ঝাপিয়ে পরতো। 

মেরিলিন ছিলেন ভালোবাসার কাঙ্গাল-কিন্তু তিনি কখোনোই সত্যিকার ভালোবাসা কোনদিন কারো কাছ থেকে পাননি!মেরেলিন মনরো তিন বার বিয়ে করেছিলেন-কিন্তু তার কোন বিয়েই টিকেনি।জে এফ কেনেডির সাথে তার খুব গভীর সম্পর্ক ছিলো-দুঃখের বিশয় তিনিও শুধু মাত্র তার সৌন্দর্য এবং শরির চাইতেন।তাঁর সাথে সেক্স করার সময় JFK বহুবার মনরোর গলায়, বুকে নাক-মুখ ঘষে-"my honey/my swit baby/my live dol/baby dol...."-ইত্যাদি সম্বোধন করতেন। কিন্তু সেক্স করার পরই প্রথম কথাটাই বলতেন-"durling,now I may go….I’m so busy– see you again”-এই কথা বলেই কাপড় পরতেন এবং চলে যেতেন(আমি এই নাটকটা দেখার পর মেরিলিন মনরো বিশয়ে খুব আগ্রহী হয়ে তার জীবনী কালেকশন করে যখন পড়লাম-তখন এই অভিনেত্রীর সব কথার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম)!এই কথাগুলো যখন অভিনেত্রী বলছিলেন-তখোন সব দর্শকই যেনো মনে করছিলো-তারা বাস্তব মেরিলিনকেই দেখছেন!তার কস্টের অভিব্যাক্তি দেখছেন! JFK আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর তার ছোট ভাই জুনিয়র Jonior JFK মেরলিন মনরোর প্রেমে পরেন। তিনিও মনরোকে ভালোবাসেননি-শুধু শরির চেয়েছিলেন এবং নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাঁকে খেলনা হিসাবে ব্যাবহার করেছিলেন।

নাটকের মঞ্চে কোন ব্লক সেড(পর্দা)ছিলোনা।সম্পুর্ণ ওপেন মঞ্চ। লাইটিংযের মাধ্যমে সেডের ব্যাবহার করা হয়েছিলো।সেই আলো আধারীতেই নাটকের ভিতর মোট ৬ বার নায়িকা তার ড্রেস চেঞ্জ করেছিলেন।ড্রেস চেঞ্জ করার সময় নায়িকার সৌন্দর্য যেনো উপচে পড়ছিলো!তা দেখে কোন দর্শকই সামান্যতম চিতকার,চেচামেচি করেনি!বরং সবাই pin drop silent এ নাটকটি উপভোগ করেছিলেন!দুই ঘন্টার নাটক। প্রথম পর্ব এক ঘন্টায় শেষ হলো।১৫ মিনিট বিরতি দিয়ে আবার শুরু হলো শেষ পর্ব।ঠিক নয়টায় নাটক শেষ হলো।আমরা হিপ্টোনাইজড হয়ে বসে আছি!আমাদের মতো সব দর্শক তখোনো তন্ময় হয়ে বসে আছে-কেউ উঠে যাচ্ছেনা!এমনই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলো ভদ্র মহিলা তার চমতকার অভিনয়,সংলাপ আর ব্যাক্তিত্ব দিয়ে! সেই সঙ্গে ছিলো মঞ্চে অদ্ভুত সুন্দর আলোর খেলা। প্রতিটা দৃশ্যের সাথে আলো যেনো কথা বলছিলো। আমি বলতে পারি-ঐ নাটকটাই ছিলো আমার দেখা জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ মঞ্চ নাটক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন