মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।


মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ০১: ০২, ১২ মার্চ, ২০১১

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরঃ ইতিহাসের আলোয় সত্যের সন্ধান।

"এই জাদুঘর বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ এবং ধর্ম-জাতিসত্তা ও সার্বভৌমত্বের নামে নৃশংসতার শিকার সকল মানুষের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আদর্শিক ভিত্তিসমূহ অর্জনের জন্য দেশবাসীর ত্যাগ ও বীরত্বের ঘটনাবলি হৃদয়ঙ্গম করতে উৎসাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই ইতিহাসের আলোকে চলমান সামাজিক সমস্যা ও মানবাধিকারের বিষয় বিবেচনায় সচেষ্ট রয়েছে।"

দ্বাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও স্বাধীনতা উৎসবের ব্রুসিয়ারে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের লক্ষ্যসমূহ সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। রাজধানীর ৫ সেগুনবাগিচায় ছিমছাম ছোট্ট একটি তিনতলা বাড়ি। কিন্তু আকর্ষণ চুম্বকের চেয়েও শক্তিশালী। বাঙালির ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম আর ত্যাগের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত চেতনায়। বাড়ির একটি কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে মুছে যাবে বর্তমানের গ্লানি। মন চলে যাবে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রাচীন বাংলায়। এরপর মনের মধ্যে ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে বাঙালির এগিয়ে চলার ইতিহাস। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের ছবি ও ইতিহাস মনকে আন্দোলিত করবে। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস মনকে সাময়িক ব্যথিত করলেও, গর্বে ভরে উঠবে মন। এই জাদুঘরটি ভালো করে দেখলে জীবন পাল্টে যাবে। ঠিক ওয়াশিংটনের হলোকাস্ট মিউজিয়ামের প্রবেশ দ্বারে লেখা "গভীর বিষাদের স্থানে এ যেন উজ্জ্বল আশাবাদের আশ্রয়" বাণীটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। এখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, বই, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, তথ্য, স্মৃতি সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন। বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত বিভেদের নামে নৃশংসতার শিকার সকল মানুষের উদ্দেশে উৎসর্গিত হয়েছে এ জাদুঘর। মুক্তি ও স্বাধীনতার স্পৃহায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মানুষই যে পারে সকল বাধা বিপত্তি দূর করে এগিয়ে যেতে তারই প্রমাণ মেলে ধরেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও দলিলপত্রাদি সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যা দেশে নতুন প্রজন্ম পূর্ব পুরুষদের সংগ্রাম এবং দেশের জন্য তাদের মহৎ আত্মত্যাগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে। দেশ ও জাতি সম্পর্কে তাদের চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াস পাবে। জাদুঘরের প্রবেশ পথেই রয়েছে শিখা চিরন্তন। এ শিখা জ্বলছে পৃথিবীর সেই সব মানবদের উদ্দেশে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার জন্য। এ শিখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পৌঁছে দেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাঙালির অতীত, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে ছয়টি গ্যালারিতে উপস্থাপন করেছে।

প্রথম ও ২য় গ্যালারিতে বাংলার অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা থেকে স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের সংগ্রামের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আছে মহৎ বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের একটি মূর্তি। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে রাজা কল্যাণ শ্রী ও রাণী প্রভাবতীর মধ্যমপুত্র চন্দ্রগর্ভ জন্মগ্রহণ করেন। ভিক্ষু হওয়ার পর তার নাম হয় অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ভারতবর্ষে বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও দন্তপুরী, সামপুরী ও বিক্রমশীল বিহারে অধ্যাপনা ও পরিচালনা করার সময় তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে অতীশ দীপঙ্কর দেহভস্ম ও রচিত গ্রন্থের পান্ডুলিপি চীন থেকে ঢাকায় ধর্মরাজিক বিহারে আনা হয়। সেই পান্ডুলিপির একটি সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে।

তৃতীয় গ্যালারিটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ, ১৯৭১ এর উদাত্ত আহ্বানের উদ্দেশে। এ আহ্বান ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামের ডাক। এর মাধ্যমে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জনতার অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাসনে "এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম" অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ২৬/২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার উপস্থাপন, ২৫ মার্চ কালরাত্রির ভয়াল চিত্রের অপুর্ব উপস্থাপন রয়েছে। ছবি, পেপার কাটিং এবং অন্যান্য তথ্যাদির মাধ্যমে লাখ লাখ শরণার্থীর দুর্গতির চিত্রও রয়েছে। তাদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেরও কয়েকটি ছবি আছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায় উঠার সময় দর্শকরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালীন কিছু ছবি দেখতে পারবেন। এর মধ্যে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সদস্যভুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক প্রতিরোধ। পাকবাহিনীর সংগঠিত নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞের প্রমাণাদি বারান্দায় বিভিন্ন পেপার কাটিং এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। রয়েছে অসংখ্য গলিত বিকৃত লাশের ছবি। এ গ্যালারিতে প্রদর্শিত ভাগ্যক্রমে পাকসেনাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের আর্তি মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেবে। বালুঘাটের পাকসেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের পাশে দুটি শিশু বসে আছে। তারা জানে না তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কি-না কিংবা কিছুক্ষণ পর তারা নিজেরাও বেঁচে থাকবে কি-না। এ ছবির কথা ভোলার নয়!

চতুর্থ গ্যালারিতে আছে কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির ব্যবহৃত জিনিস। এরা পাকবাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা ও প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও দলিলাদি রয়েছে এতে। রয়েছে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ব্যবহৃত সামগ্রী। ব্যালকনিতে আছে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র। সেক্টর কমান্ডার এবং আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান যোদ্ধাদের ছবি সম্বলিত বিস্তারিত বিতরণ দেয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পতাকা, যা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। ৫নং গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানের সাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার, নৌকমান্ডো, বিমান বাহিনী, নারী সমাজ, বৈদেশিক সমর্থ বিশেষ করে ভারতীয় জনসাধারণের সমর্থনের প্রতিচ্ছবি। ৬নং গ্যালারি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সর্বশেষ কক্ষ। দর্শক এখানে একাত্তরের পরম ত্যাগ ও বেদনার দংশন অনুভব করবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে হারানো দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগের চিত্র এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। আরও রয়েছে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে আমাদের সাথে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের পরিচয়।

সবশেষে রয়েছে আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীসহ পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র এবং তাদের কাপুরুষোচিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন। ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে মিরপুর ১২নং সেকশনের ডি ব্লকে নূরী মসজিদ সংলগ্ন মুসলিম বাজার বধ্যভূমির একটি পরিত্যক্ত কুয়া থেকে মাথার খুলিসহ পাঁচ শতাধিক হাড় উদ্ধার করা হয়। একই বছর মিরপুর ১০নং সেকশনের ডি ব্লকের ১নং এভিনিউতে জল্লাদখানা বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫৩৯২টি ছোট-বড় হাড় পাওয়া যায়। এসব হাড় এ গ্যালারিতে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বেশিরভাগ স্মৃতিচিহ্ন দিয়েছেন শহীদদের স্ত্রী কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। শহীদ ড. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেছেন তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। রোকাইয়া হাসিনা তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শহীদ রাশিদুল হাসানের ব্যবহৃত কলম সীল, স্যুট ও আলোকচিত্র জাদুঘরে জমা দেন। শহীদ ডাক্তার আতিকুর রহমানের মেয়ে মিমি রহমান তার বাবার ব্যবহৃত একটি কোর্ট ও একটি টুপি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সংগৃহীত উপকরণ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

বর্তমানে জাদুঘরে সংগৃহীত স্মারক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪১৭টি। এর মধ্যে ৮০০টি আলোকচিত্র, ৫০৬টি দলিলপত্র, ৫০০টি পত্রিকা কাটিং, ৬৬৫টি অন্যান্য স্মারক। এগুলোর মধ্যে ৩১০ আলোকচিত্র, ৮৪টি দলিলপত্র, ২২৭ পত্রিকার কাটিং এবং ৪৭০টি বিভিন্ন স্মারক গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাকিগুলো সংরক্ষণাগারে সযতেœ রক্ষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই জাদুঘরটি সম্মানজনক আন্তর্জাতিক জাদুঘর সংস্থা আমেরিকান এসোসিয়েশন অব মিউজিয়ামের সদস্য পদ লাভ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি লিফলেটের শিরোনামে লেখা হয়েছে "সত্যের মুখোমুখি হোন ইতিহাসকে জানুন"। হ্যাঁ, বর্তমানের ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময় বের করে বাঙালির বীরত্বগাঁথা দেখে আসুন। জানুন বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তির ইতিহাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন