মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গণতন্ত্রে সাদা-কালোর প্রভেদ নেই


আব্রাহাম লিঙ্কনের জনগণের রাষ্ট্র -২

লিখেছেন বাবুয়া, সন্ধ্যা ০৭: ৫২, ০৮ জুলাই, ২০১১


গণতন্ত্রে সাদা-কালোর প্রভেদ নেই

লক্ষণীয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন জনগণ সমর্থন দিয়েছিল বাংলাদেশকে। অনেক মার্কিন সিনেটর, শিক্ষাবিদ, সিভিল সমাজ, সাধারণ মানুষ আর্থিক, নৈতিক, এমনকি প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন। একইভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অধিকাংশ নাগরিক ছিল যুদ্ধ বিরোধী আর সরকার ছিল যুদ্ধাংদেহী। এগুলো রাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি নয়, বরং রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের চিন্তার হারমনি বা ঐকতানের অভাব। অর্থাৎ রাষ্ট্র এখনো নাগরিকদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি এবং নাগরিকদের মধ্যেও আন্তঃগোষ্ঠি সমঝোতা সংহত হয়নি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দেশের দরিদ্র জনগণের চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে একটি আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সকল নাগরিকের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। ওবামার ঘোষণা রাষ্ট্রীয় সেই মূল দায়িত্বের বাস্তবায়নকল্পে। অন্যভাবে বললে, সকল নাগরিকের (ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে) স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই ওবামার রাষ্ট্রীয় ঘোষণা। সংহত, সমচিন্তক সমাজ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল মহলে ঘোষণাটি সমাদৃত হতো। কিন্তু তা হয়নি। সমাজের শক্তিশালী অংশ থেকে প্রতিবাদ এসেছে এবং প্রতিরোধের প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। 

পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, স্বল্পবিত্তের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আর্থিক প্যাকেজ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝাটি বহন করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র এই অর্থ সংগ্রহ করবে করারোপের মাধ্যমে বিত্তশালী নাগরিকদের কাছ থেকে। এখানেই সামাজিক সংঘাতের সূত্রপাত। বিত্তশালী আরো সম্পদ বাড়াতে চায়। বিত্তবর্ধনের লোভ সীমাহীন। বিত্তশালী সম্পদের ভাগ দিতে চায় না স্বল্পবিত্তের সহ-নাগরিকদের। তাদের যুক্তি, যার যার দক্ষতা অনুযায়ী যে যে সম্পদ অর্জন করে, সে সেই সম্পদসীমার মধ্যেই ভোগ করবে। বিত্তশালীর অর্থের ভাগ পাবার অধিকার তার নেই। এদিকে রাষ্ট্র তো সবার জন্য। রাষ্ট্র সকল নাগরিকের প্রতি সমআচরণে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। এমনকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনগত ভাবেও। বিত্তশালীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে থাকলে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র সফলকাম হয় না। মানবতাবাদী কেউ ক্ষমতারোহণ করতে সমর্থ হলে, রাষ্ট্র দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি সুবিচারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছে ওবামার ক্ষমতারোহণের ফলে। ওবামা অশ্বেতাঙ্গ। বাবা কৃষ্ণাঙ্গ, মা শ্বেতাঙ্গ। মুসলিম সন্তান, শৈশবে নিজেও মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পিতা আফ্রিকান হলেও, ওবামা শৈশব কাটিয়েছেন এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায়। ফলে তিনি কিছুটা হলেও ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে অবস্থান নিতে শিখেছেন। বিচিত্র মাত্রায় অবস্থান এবং বিচিত্র পরিবেশ-প্রতিবেশের ইন্টারযাকশন তাকে অন্যদের তুলনায় কিছুটা মানবতাবাদী করে তুলেছে। তাইতো তিনি বলেন- ‘মহাত্মা গান্ধী আমার অনুপ্রেরণা’। তিনি হয়েছেন ‘জনগণের যুক্তরাষ্ট্রের’ নেতা, কিন্তু জনগণের গোষ্ঠী-স্বার্থ এখনো প্রকট এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী ক্ষুদ্রগোষ্ঠিই ক্ষমতাবান।

ওবামার নাগরিক চিন্তা একদিকে আশার সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। ঐদেশের মানবতাবাদী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন সাদা-কালোর বর্ণবিদ্বেষের (যা অন্য আবরণে দাস প্রথা) সমন্বয় করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রকে সংঘবদ্ধ করলেন। এই মহৎপ্রাণ মনীষিকে হত্যা করা হলো। আমাদের উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রশমনের লক্ষ্যে অহিংস নীতিতে সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলেও দেশ বিভাগের মধ্যদিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অমর অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বধর্মের উগ্রবাদীরাই তাঁকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমাদের এই বাংলাদেশে আপামর জনগণকে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের অজেয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁকেও নির্মম ভাবে প্রান দিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই একই ধারায় প্রান দিতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। 

খোদ যুক্তরাষ্ট্রে শুধু লিঙ্কনই নন, জন এফ কেনেডীর মত মানবিক গুণ সমৃদ্ধ প্রেসিডেন্টকেও হত্যা করা হয়েছিল। যদি ওবামা তার মানবিক মন ও মানসের প্রকাশ ঘটাতে চান বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের হিংসুক, অমানবিক, সম্পদলোভী ও হিংস্র রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে, তাহলে কি ঘটবে তা ভবিষ্যৎই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রকে যেসব বিশ্লেষণে বিশেষায়িত করেছি, তা ভিয়েতনামে, ইরাকে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা পর্যালোচনা করলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন, কেনেডী মহাত্মা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো দুরাত্মা। দুরাত্মা তাই মহাত্মাদের বিসর্জন দিয়ে স্বীয় দুরাত্মা চরিত্র বজায় রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখনো লিঙ্কন কল্পিত ‘জনগণের রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠেনি। কামনা করি, এই সম্পদশালী পরাশক্তির রাষ্ট্রটি তাদের রাস্ট্রীয় আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করে ‘জনগণের রাষ্ট্রে’ পরিণত হোক। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাষ্ট্র হলেই ‘জনগণের রাষ্ট্র’ হয় না। তবে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ হতে হলে রাষ্ট্রটিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির হতেই হবে।
(শেষ)

(৪ জুলাই যুক্তরাস্ট্রের ২৩৫ তম জন্মদিনে ওয়াশিংটন পোস্ট’র ইন্টারনেট ভার্সন থেকে মূল ভাবার্থ বজায় রেখে আমাদের রাজনোইতিক অবস্থান নিজেরমত করে অনুবাদ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন