সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমাদের স্বাধীনতা: আমাদের প্রেরণা


আমাদের স্বাধীনতা: আমাদের প্রেরণা

লিখেছেন বাবুয়া, সকাল ১০: ০৫, ২৬ মার্চ, ২০১২

আমাদের স্বাধীনতা: আমাদের প্রেরণা

স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪১ বছরে পদার্পণ করল। অর্থাৎ ৪০ বছর অতিক্রম-কম সময় না! অনেক ত্যাগ ও তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতায গত চল্লিশ বছরে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা কতটুকু পূরন হয়েছে-সেই প্রশ্ন এখন যেকেউ করতেই পারে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাবধান-কতটা সহনীয় সে প্রশ্নের জবাব দেয়া এখন শাসকবর্গের সময় হয়েছে। সময় হয়েছে-এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের আদালতে জবাব্দিহি করার। যে প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতা একটি স্বর্ণদুয়ার খুলে দিয়েছিলো। যে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলাম, গড়তে চেয়েছিলাম সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ-সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরন হয়েছে? সোজাভাবে বলা যায়- স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার সুফল এখনো সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেনি। দেশের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো স্বপ্ন। এখনও নেই সাধারন মানুষের নূণ্যতম বাক স্বাধীনতা। সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা যে আন্তরিক এমনটিও বলার সুযোগ নেই। স্বাধীনতা জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসটির সুরক্ষার দায়িত্ব শ্রেণী-পেশা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার। জনগোষ্ঠীর মানস গঠনে স্বাধীনতাই যেন আমাদের আরাধ্য হয়। এটি করতে না পারলে জাতির অমঙ্গলের কারণ হবে।

পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে-যারা স্বাধীনতা প্রাপ্তির চল্লিশ বছরেও আমাদের মত পিছিয়ে রয়েছে। এতদিনেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত এবং বস্তুগত-এই দু'টি উদ্দেশ্যের কোনোটারই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্য আসলেও তা প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি জাতির জন্য এখনও স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলেও জাতির ভাগ্য নির্ধারণে এখনও পরাশক্তি অন্যায় হস্তক্ষেপ করে বিভিন্নভাবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক শক্তি এবং দাতাগোষ্ঠী অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। আমরা বিনা প্রতিবাদে তা মেনেও নেই। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত করতে পারিনি আমরা। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় আমরা কবে উত্তীর্ণ হতে পারবো, কে জানে?
আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি নীতিহীন। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে দেশ-জাতির স্বার্থকে আমরা এখনও বড় করে দেখতে অভ্যস্ত নই। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী-সুবিধাভোগী শ্রেণী এখনও সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্থরূপ নেই, পরমত সহিষ্ণুতার বড়ই অভাব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সদিচ্ছার অভাবে যে প্রশ্নটিকে সামনে আনে, সেটি হচ্ছে আমরা কী সত্যিই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবাসি? মাতৃভূমির জন্য আমাদের দেশপ্রেম কী যথেষ্ট!

আমাদের রাজনীতি যদি স্বাধীনতার পথে অগ্রসর নাহয়, রাজনীতি যদি স্বাধীনতাকে আত্মীকরণ করতে না পারে, তবে সে রাজনীতি জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং এক্ষেত্রে জাতীয় সংকট তৈরি হয়, জাতিসত্তার সংকট তৈরি হয়। স্বাধীনতার অন্তর্গত শক্তি ও আবেদন যেন আমাদের সব সময় উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে এবং আমরা যেন জাতিগঠনে উদ্বুদ্ধ হই। মুক্তিযুদ্ধ যেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রতীক হিসাবে কাজ করে। রাজনীতির নানা মত ও পথ, বিরোধ ও ঐক্য যেন স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী না হয়। স্বাধীনতার চেতনা, ত্যাগ, আগুন ও অশ্রুপাত, ইস্পাতদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যেন আমাদের দেশ গড়ার কাজে এক এবং একাকার হয়ে যায়। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব যেন কোনোভাবেই বিপন্ন না হয়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, স্বাধীনতা বিরোধীদের অপতৎপরতা যেন আমাদের রাজনীতি , অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। জাতীয় প্রেরণার অবিনাশী উৎস স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনা থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই।

যে জাতি মৃত্যুর তুহিনস্তব্ধতা থেকে জেগে উঠতে পারে, সে জাতি কেন পথভ্রষ্ট হবে? স্বাধীনতার অবিনাশী প্রেরণা আর স্বাধীনতা অর্জনের রক্তাক্ত অধ্যায় যেন আমরা বিস্মৃত না হই। জাতীয় জীবনে সমস্যা ও সংকটের শেষ নেই। এক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনতার স্মরণীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি।

বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী শাসন আমলে লক্ষ্য করলো- ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত, এই জাতি অংশগ্রহণ করলো ভাষা আন্দোলনে। রক্তের আখরে লেখা মাতৃভাষা বাংলাকে পেলো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে। রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম রক্ত দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করলো। আমাদের চেতনার স্মারক হলো একুশের চেতনা। একুশে ফেব্রুয়ারি শুরুতে ভাষার অধিকারকেন্দ্রিক থাকলেও আস্তে আস্তে তা নিপীড়িত মানুষের সকল ধরনের অধিকার-আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়। একুশের চেতনা অব্যাহতভাবে সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের ভিন্ন ভিন্ন ধাপে। একুশের পথ ধরেই বাঙালি অগ্রসর হয়েছে ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানে, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালির পালাবদলের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে একুশের চেতনা অম্লান, অম্লান স্বাধীনতার চেতনা। কিন্তু অত্যন্ত দূর্ভাগ্যের বিশয়-মহান ভাষা আন্দোলনের যাট বছর পর এবং লক্ষ প্রান আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময় অর্জিত স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর আমাদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির ধংশ লীলা চলছে প্রতিবেশী একটি দেশের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে এবং এদেশীয় কতিপয় সুবিধাবাদী পদলেহী বুদ্ধিজিবীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে!

বাংলার মাটি ও মানুষ পরাজিত হতে জানে না। বিশ্বায়নের এ যুগেও রক্তের পলিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ- এমন প্রত্যাশা জাতির। স্বাধীনতা এক সময় ছিলো স্বপ্ন, পরে হলো লক্ষ্যবস্তু - এক পর্যায়ে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিলো। এখন আমাদের লক্ষ্য নব্য সাম্রাজ্যবাদীরদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে অর্থনৈতিক মুক্তি। এই মুক্তিকে অর্জন করতে হলে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর নিরন্তর প্রয়াস থাকলেই দেশগড়ার প্রত্যয়টি প্রবাহিত হবে ইতিবাচক খাতে। স্বাধীনতার শপথে, শক্তিতে একদিন আমরা জেগে উঠেছিলাম। এখন আমরা জেগে উঠবো অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। কৃষিভিত্তিক আমাদের দেশে কৃষি অর্থনীতির বুনিয়াদকে শক্তিশালী করতে হবে।

মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে হবে, সচল করতে হবে অর্থনীতির চাকা, কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বেকার সমস্যার সমাধান, দারিদ্র্য বিমোচন করতে না পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে যা খুবই জরুরি। যে জাতি পাকিস্তানীদের নির্বিচারে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, রাজাকার-আলবদরদের তাণ্ডব সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে, ঘুরে দাঁড়াতে পারে- সে জাতি কেন চল্লিশ বছরেও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারলো না, তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে আমাদের। আমরা যেহেতু পাকিস্তানীদের বর্বরোচিত হামলা, গণহত্যার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছি; সেহেতু আমরা এখনও নিকট অতীতের বেনিয়াচক্রের রক্ত চক্ষু আর আগ্রাসী মনোভাবকে তাচ্ছিল্ল করে যার যার অবস্থানে থেকে দেশ ও জাতির জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও সম্ভব হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন