মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আব্রাহাম লিঙ্কনের জনগণের রাষ্ট্র -১


আব্রাহাম লিঙ্কনের জনগণের রাষ্ট্র -১

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৫: ৪২, ০৭ জুলাই, ২০১১

আব্রাহাম লিঙ্কনের জনগণের রাষ্ট্র -১

গণতন্ত্রে সাদা-কালোর প্রভেদ নেই।
আব্রাহাম লিঙ্কন জনগণের রাষ্ট্র কামনা করেছিলেন। কল্পনা করেছিলেন এমন একটি রাষ্ট্রের, যে রাষ্ট্রটি হবে ‘জনগণের মালিকানায়, জনগণের জন্য এবং জনগণ পরিচালিত’। দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংহত করেছিলেন, টেকসই কাঠামো দিয়েছিলেন, চেক এন্ড ব্যালান্স পদ্ধতিতে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। রাষ্ট্র গঠনের সর্বপ্রক্রিয়াতেই মূল সুর ছিল জনগণের মালিকানা। জনগণের মালিকানাকে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বপর্যায়ে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেটাই ছিল লিঙ্কনের স্বপ্ন সাধনা। তিনি শুরু করেছিলেন। ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আজও কি আব্রাহাম লিঙ্কন কল্পিত ‘জনগণের রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে?

প্রথমে আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘জনগণের রাষ্ট্র’ ধারণা বিষয়ে পর্যালোচনা করা যাক। তাঁর বিখ্যাত ‘বাই দি পিপল, অব দি পিপল, ফর দি পিপল’ উক্তিটি ধারণার সূত্র হিসাবে কাজ করতে পারে। স্পষ্টিকরণে কথাটির সরল অর্থ দাঁড়ায়, ‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্র পরিচালনা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত সকল ব্যক্তি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবে বা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পরিচালিত হলেও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে জনগণের জন্যে। এখানে জনগণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দেশের ‘সকল নাগরিক’ অর্থে। কথাগুলোর মধ্যদিয়ে যে মূলনীতি প্রকাশ পেয়েছে, তা হলো ‘সকল’ নাগরিক অর্থ ‘প্রতিটি’ নাগরিক। সকল নাগরিক অর্থ অধিকাংশ নাগরিক নয়, সচ্ছল শ্রেণীর নাগরিক নয়, ক্ষমতাসীন শ্রেণীর নাগরিক নয়, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নয়, সশস্ত্র বাহিনী নয়, সুশীল সমাজ নয়, খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী নয়, শ্রমিক শ্রেণী নয়। বরং এরা সবাই এবং অন্য আরো অনেক গোষ্ঠী ও ব্যক্তি মিলেই ‘সকল নাগরিক’। ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা বিগ্নীত হবে না। গোষ্ঠীর গোষ্ঠীসত্তা অবহেলিত হবে না। সংখ্যালঘুর অভিপ্রায়-অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠের অন্যায় অভিলাষ পূর্ণ হবে না। শক্তিমান সহায়তার বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে দেবে দুর্বলের দিকে। হীনমন্যতা নয়, অধিকার মনে করে দুর্বল শক্তি অর্জন করবে অশুভ শক্তি প্রতিরোধকল্পে। 

প্রায় দুশো বছর আগে লিঙ্কনের উচ্চারিত ‘জনগণের রাষ্ট্র’-এর এই আদর্শ সংজ্ঞার পরিমাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর কোন দেশেরই এখন পর্যন্ত পূর্ণ উত্তরণ ঘটেনি। কিন্তু সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ ইউরোপীয় কয়েকটি রাষ্ট্র ‘জনগণের রাষ্ট্র’ সংজ্ঞার পরিমাপে সর্বোচ্চ অবস্থান অর্জন করেছে।লিঙ্কনের দেশ যুক্তরাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে, যদিও সম্পদ অর্জনে তাদের অবস্থান ঈর্ষণীয়। অর্জিত সম্পদের ওপর পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর অধিকার নিন্দনীয়ভাবে সীমিত। এমনকি রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকার অর্জন ও চর্চাতেও পশ্চাৎপদ তারা। লিঙ্কনের আলোকিত উচ্চারণ নিজ দেশে না হলেও বিশ্বের অন্যত্র আলোকরশ্মি বিকিরণ করছে এবং ক্রমাগত করে যাচ্ছে। এসব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রজ্যোতিস্ক থেকেই হয়তো একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষা নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর কাটতে দেরি হবে বলেই মনে হচ্ছে।

মার্কিন ভক্তদের মনে উষ্মার সঞ্চার হতে পারে এ বক্তব্যের ফলে। তারা কিছু বিষয় পর্যালোচনা করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এ নিয়ে কোন দ্বিধা পোষণ করা হচ্ছে না। আমার স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, লিঙ্কনের ‘অব দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল’ উচ্চারণে যে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ সংজ্ঞায়িত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেই ‘জনগণের রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এই সেদিনেও আমেরিকার ‘সম্ভ্রান্ত’ রেষ্টুরেন্টে নোটিস লেখা থাকতো, ‘ডগস এন্ড ব্লাকস আর নট য়্যালাউড’ অর্থাৎ ‘কুকুর এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ নিষেধ’। ‘ভদ্রবেশীরা’ লিখতো ‘ফর হোয়াইটস অনলি’ অর্থাৎ ‘শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্য’। অধিকতর ভদ্র মুখোশধারীরা লিখতো(এখনো লেখে)‘এন্ট্রি রেসট্রিকটেড’ অর্থাৎ ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’। শুধু রেষ্টুরেন্ট হোটেলে নয়, শিক্ষালয়েও এই বিভেদাত্মক রীতি ছিল। এখন অপসৃয়মান, তবে অপসৃত বলা যাবে না। এসব কি রাষ্ট্রের ‘সব নাগরিকের সমঅধিকার’ এর পরিচয় বহন করে?

যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করেছে আড়াইশো বছর হল। লিঙ্কনের ‘জনগণের রাষ্ট্র’ ঘোষণা এসেছে, তাও প্রায় দুশো বছর হলো। এই দীর্ঘ সময়ে জনগণের এই রাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। ওবামাই সর্বপ্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, রাষ্ট্রের আইন আর রাষ্ট্রীয় নাগরিক সমাজের চিন্তা এবং কর্ম একরকম নয়। কারণ রাষ্ট্রনায়ক মানবতাবাদী হলে, রাষ্ট্রের সংবিধান বা আইনেও মানবতা প্রতিফলিত হবে; কিন্তু ঐ রাষ্ট্রেই নাগরিক সমাজের সকল ব্যক্তি সমচিন্তক নহেন। স্বতন্ত্র ব্যক্তি সকলের বিশ্বাস, ধারণা, চিন্তাধারণা, কুসংস্কার, শিক্ষা, উপলব্ধি এবং স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন, সেটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রবদ্ধ এবং সমাজবদ্ধ হবার ফলে, ব্যক্তি নাগরিকদের মধ্যে ইন্টারেকশন বা আন্তঃভাববিনিময়, ইন্টারডিপেন্ডেন্স বা পারস্পরিক নির্ভরতা এবং মিউচুয়াল বেনিফিট বা পারস্পরিক সুবিধাদি বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘস্থায়ী এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ‘সামাজিক সমঝোতা’ জন্ম নেয়, সংহত হতে থাকে এবং একসময়ে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসরমান কিন্তু পরিণতিতে পৌঁছেনি। এ কারণেই অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের এত সময় লেগেছে।

(৪ জুলাই যুক্তরাস্ট্রের ২৩৫ তম জন্মদিনে ওয়াশিংটন পোস্ট’র ইন্টারনেট ভার্সন থেকে মূল ভাবার্থ বজায় রেখে আমাদের রাজনোইতিক অবস্থান নিজেরমত করে অনুবাদ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন