সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমেরিকার কড়চা-৫


আমেরিকার কড়চা-৫

লিখেছেন বাবুয়া, সন্ধ্যা ০৬: ৩৮, ১৮ অক্টাবর, ২০১১

আমেরিকার কড়চা-৫

নির্দিস্ট যায়গায় গাড়ী পার্ক করে আমরা টিকেট নিয়ে প্রথম স্বপ্নপুরী নায়াগ্রার দর্শক কম্পাঊন্ডে চলে যাই। নায়াগ্রার মুল এরিয়ার অনেক দূর থেকেই জল প্রপাতের পানির ছিটা থেকে শরির এবং কাপড় যাতে না ভিজে-সে জন্য প্রত্যেককে একটা করে ট্রান্সপারেন্ট পলিথিনের রেইন কোট দেয়া হলো। ফেরার পথে রেইন কোট ফেরত দিতে হয়। চোখে না দেখলে নায়াগ্রার কথা বলে কিম্বা লিখে প্রকাশ করা যায়না! জল প্রপাত দেখা ছাড়াও এখানে অনেক প্রকার রাইড আছে। প্রতিটা রাইডে চড়ার জন্য আলাদা আলাদা টিকেট কিনতে হয়-সব রাইডের টিকেটের দাম বেশ চড়া! সব চাইতে বেশী দাম গ্লাইডারে চড়ায়! 

আমরা ক্যবল কারে করে অনেক্ষণ ঘুড়লাম-কানাডা প্রান্ত থেকে আমেরিকা প্রান্তে। ১৮৮৫ সালে আমেরিকা কর্তিক নির্মিত "নায়াগ্রা ফল স্টেট পার্ক" হয়ে আমেরিকার অংশের "মেইড অব দি মিস্ট বোটে" গেলাম। মেইড অব দ্যা মিস্ট ফ্রীজ বোট ১৯৪৬ সালে তৈরী করা হয়েছিলো। পৃথিবীর যত রাস্ট্র/ সরকার প্রধানগন কিম্বা বিশিস্ট জনেরা নায়াগ্রা ভ্রমনে এসেছেন-তাঁরা প্রায় সবাই নাকি এই মেইড অব দ্যা মিস্ট ফ্রীজ বোটে চড়েছেন। আমরা খুব সাধারন লোক হয়েও তার ব্যাতিক্রম করিনি। এখানে ২০ জনের দল নিয়ে বিরাট আকারের প্যারাসুটে করে প্রায় ১০০ ফিট উপর থেকে ১৫ মিনিটের এক একটা ট্রিপ ঘুড়িয়ে আনা হলো। ঐ প্যারাসুট নীচ থেকে একধরনের সুতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ওখানে গ্লাইডারেও চড়া যায়।টিকেট কেটে ১৬ বছরের উপড় বয়স-তেমন সবাই গ্লাইডারে চড়ে আকাশে উড়তে পারে। আমাদের ভিতর অন্য কেঊ ভয়ে গ্লাইডারে চড়তে রাজী না হওয়াতে শেষ পর্যন্ত আমি একাই গ্লাইডারে ২০ মিনিট ঘুড়ে আসি নায়াগ্রার কুয়াশাচ্ছন্ন কুহেলিকার ভিতর। নায়াগ্রা প্রপাতের বিশাল গর্জন করে গড়িয়ে পরা পানিতে ধুম্রাচ্ছন্ন সাদা কুহেলিকার সৃস্টি করে-যা দেখে মানুষ বিমোহিত হয়। সেই পানির স্রোত ভেষে আসে Huron, Erie, Michigan & Superior Lake থেকে। এই পানি এখান থেকেই প্রবল স্রোতধারায় গড়িয়ে নিচে নায়াগ্রা নদী এবং পরবর্তীতে St. Lawrence River এবং সর্ব শেষ আটলান্টিক মহা সাগরে মিশে গিয়েছে।

পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি-মুল নায়াগ্রার জায়গাটি কিন্তু আমেরিকাতে এবং নায়াগ্রা জল প্রপাতের নাম করন করেছে আমেরিকানরাই। নায়াগ্রা এলাকাটি আমেরিকার নিউইয়র্কের বাফালো সিটির শেষ প্রান্তে অবস্থিত। নায়াগ্রা ফল’এ পানির গভীরতা ১৭০ থেকে ১৯০ ফিট।প্রতি সেকেন্ডে ২ লক্ষ ২ হাজার কিউবিক ফিট এবং প্রতি ঘন্টায় 5.5 million gallons পানি প্রবাহিত হয়। বর্তমানে কানাডা এবং আমেরিকার জল বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য এর অর্ধেক পানি পরিবর্তিত ধারায় প্রবাহিত করে নেয়া হয়। নায়াগ্রা প্রপাতের পরিবর্তিত প্রবাহিত পানির ১০ ভাগ আমেরিকা এবং ৯০ ভাগ পানি কানাডার horse shoe ফলসে প্রবাহিত হয়। অনেক ঘোরাঘুরি করে যখন কিছুটা ক্লান্তি চলে আসে তখন হুড খোলা ট্রলী বাসে করে সব এলাকা ঘুরে দেখেছি। মোবাইল ফাস্ট ফুডের গাড়ী থেকে প্যাকেট লাঞ্চ কিনে খেয়ে নেই। সারা দিনে বিভিন্ন সৌন্দর্য উপোভোগ করলাম। সত্যি কথা বলতে কি-আমার ব্যাক্তিগত ভাবে নায়াগ্রা দেখতে ভালো লাগছিলোনা। আমি বরং ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন রকমের মানুষের সৌন্দর্য, তাদের আচরন তাদের অভিব্যাক্তি, বাচ্চাদের ছোটা ছুটি দেখতেই পছন্দ করেছি। 

পৃথিবীর নানান দেশ থেকে প্রতি দিন অগনিত দর্শক আসেন নায়াগ্রার সৌন্দর্য্য দেখতে। তবে এখনো খোদ আমারিকার ৫০ ভাগ এবং কানাডার ৪০ ভাগ মানুষ নাকি নায়াগ্রা দেখতে আসেনি। এ যেনো মক্কার মানুষ হজ্ব করেনা ধরনের বিশয়! আমি আমেরিকাতে শুনেছি-আমেরিকার প্রথম রাজধানী ফিলাডেলফিয়া বা বর্তমান রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি পর্যন্ত চাক্ষুস দেখেছে ভ্রমন পিয়াসী আমেরিকার ৪০ ভাগ মানুষ! নায়াগ্রায় আমাদের সাথে কোন বাংলাদেশীর দেখা হয়নি। তবে বেশ কয়েকটা প্রবাসী ইন্ডিয়ান ফ্যামিলী দেখেছি। অনেক এরাবিয়ানদের দেখেছি ইউরোপীয়ানদের মতো নোংড়ামীতে মত্ত! ওরা বোধ হয় ওই কাজেই সব সময় এবং টাকা পয়সা ব্যয় করতে ব্যাস্ত থাকে।

নায়াগ্রা ফল'র কাছাকাছি একটা বড় শিলালিপি দেখে থমকে দাড়াই। ওটার উপড়ে খোদাই করে লিখা আছে-"দে দ্যাট গো ডাউন টু দি সী ইন শিপ্স এন্ড অকুপাইড দেয়ার বিজনেস অন গ্রেট ওয়াটারস। দিস ম্যান সি দি ওয়ার্ক অব লর্ড এন্ড হিয ওয়ান্ডার্স ইন দ্যা ডিপ"-(১০৭ তম পালম, বাইবেল)। বিকাল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত আমরা ঘুড়ে বেড়াই নায়াগ্রার কাছাকাছি অন্টারিওর অন্যান্য ছোট ছোট শহরে।ওখানে মানুষ জন খুব কম! অনেকটা বিরান ভুমির মতো। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো-কানাডার অংশে নায়াগ্রা জল প্রপাত না থাকলে বিশাল দেশ কানাডার এই অন্টারিও অঞ্চলে "মানুষ নামক প্রানী" মাইক্রস্কোপ দিয়ে খুঁজে দেখতে হতো!

সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকাল আমরা "নায়াগ্রা ইন্ডোড় ফিগার স্কেটিং" সেন্টারে ফিগার স্কেটিং দেখতে যাবো। সেই জন্য আমরা এডভান্স টিকেট কিনে ছিলাম।হোটেলে ফিরে চেঞ্জ করে দেখতে যাই বিখ্যাত "নায়াগ্রা ইন্ডোড় ফিগার স্কেটিং কম্পলেক্স'এ। এই ফিগার স্কেটিং কম্পলেক্স ওয়ার্ল্ড ফেমাস। এখানে পৃথিবীর নাম করা ফিগার স্কেটারগন আসেন-তাদের পার্ফর্মেন্স দেখাতে।প্রতি দিন ৩ টা লাইভ সো হয়। আমরা রাতের (৯-১১ টা) শো উপভোগ করার জন্য যাই। এখানেও টিকেট খুব কস্টলী। সামনের প্রথম তিন সারির টিকেটের দাম ২২০ ডলার! এভাবে পিছনের সারির সীট গুলোর দাম কমে সর্ব নিম্ন দাম হয় ৪০ ডলার। আমরা ২য় সারিতে বসার সুযোগ পাই। আমাদের বসার সীট থেকে স্টেজের দুরত্ব মাত্র ৮ ফিট। প্রতিটি সীটের সাথেই বায়োনোকুলার লাগানো। আবার দূরে বিভিন্ন এঙ্গগেলে বিরাট ফ্লাট স্ক্রীন লাগানো-ঐ সব স্ক্রীনে স্লো মোশনে রিপ্লে দেখানো হয়। আমরা যখন দেখেছিলাম তখন ১২০০ জন ধারন সম্পন্ন হল রুমে একটি সীটও খালি ছিলনা। জেনেছি কখনোই কোন সীট খালী থাকেনা।

ফিগার স্কেটিং স্টেজ(মাঠও বলা যেতে পারে) এরাউন্ড ১১০ বর্গ মিটার। গোলাকার মাঠের চারিদিকে রাউন্ড দর্শক গ্যালারী। পুরো মাঠ/ হলরুম ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপ মাত্রা। স্টেজের উপড় স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঠান্ডা করে মাইনাস ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রা করে সব সময় প্রচন্ড শক্ত এবং মসৃন বরফ জমিয়ে রাখা হয়। দেখতে মনে হয় যেনো সাদা মসৃন কাঁচ! সঙ্গত কারনেই সামনের সারির দর্শকদের কিছুটা বেশী ঠান্ডা সয্য করতে হয়। সামনের তিন সারির দর্শকদের পায়ের কাছে অটমেটিক ইলেক্ট্রিক হিটার বসানো থাকে-যা তাপমাত্রা সহনীয় রাখে। অমন হিটার পিছনের দিকেও আছে কিনা আমার জানা নেই। স্টেজের সেই শক্ত বরফের উপর স্কেটারগন তাদের অপুর্ব সুন্দর এবং মোহনীয় শারিরিক ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করে থাকে। আগে আমার জানা ছিলো- মিউজিকের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে নৃত্য শিল্পীরা নাচে। কিন্তু এখানে ফিগার স্কাটারদের শারিরিক শল্পিক রিদমের সাথে সাথে যেন মিউজিক নিজেকে ধন্য করেছিলো! আমরা যেদিন শো উপভোগ করেছিলাম সেদিন ওয়ার্ল্ড লেডি ফিগার স্কেটিং চ্যাম্পিয়ন এবং ফার্স্ট রানার আপ ন্যান্সী ক্যারিগান এবং টনিয়া হার্ডিংস(দু জনই অভিবাসী আমেরিকান) তাদের একক ক্রীড়া শৈলী প্রদর্শন করেছিলেন এবং তাদের সাথে পুরুষ পার্টনার ছিলেন রাশিয়ার মিসাবভ মেভিভ এবং বৃটিশ ফেড্রিক ওয়াগ্নার। 

পুর্বে টিভিতে অনেক দেখেছি ফিগার স্কেটিং। বাস্তবে দেখার খুব ইচ্ছাছিলো। আমার সেই স্বপ্নও পুরণ হলো! আমার জীবনের আরো একটা স্বপ্নময় অভিজ্ঞতা ছিলো সেই ফিগার স্কেটিং দেখা। পাখির পালকের মত তাদের কোমল শরির। যা নিয়ে বাতাসে উড়ে চলা পেজা পেজা তুলার মতো এবং নানান স্বপ্নীল ভংগীমায় যে ক্রীড়া শৈলী তারা প্রদর্শন করেছিলেন-সেই সৌন্দর্য কোন ভাবেই লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব! পরবর্তীতে আমি ইয়োরোপ আমেরিকার যখোন যে সিটিতে গিয়েছি-প্রথমেই খোঁজ নিয়েছি-ওখানে ফিগার স্কেটিং দেখার কোন সুযোগ আছে কিনা............। 

(পাঠক প্রতিকৃয়ায় মনে এই সিরিজটা পাঠকদের প্রত্যাশা পুরন করতে পারছেনা-কাজেই এই সিরিজের এখানেই সমাপ্তি)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন