সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সাঁওতালদের বৈচিত্রময় জীবনঃ


সাঁওতালদের বৈচিত্রময় জীবনঃ

লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ১২: ১৯, ২১ জুলাই, ২০১১

http://amarbornomala.com/uploadedimage/7516CaptureWiz010.jpg
সাঁওতালদের বৈচিত্রময় জীবনঃ
একসময় দিনাজপুরের বনাঞ্চলের মাঝে যে দু চারটি মাটির দেয়াল ঘেরা বিশেষ বৈশিস্টের ঘর দেখা যেতো-সেখানেই বাস করত সাঁওতাল সম্প্রদায়। সেই ঘরের কিশোরেরা সেই শিশু বয়স থেকে তীর ধনুক হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরতো পাখি, কাঠবিড়ালী, গুঁই সাপ খরগোশ, বন্য শুকর শিকারে।এরা মুলত পেশায় কৃষক হলেও নেশা শিকার। আমাদের দেশে এখন হাতেগোনা কিছু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ খুঁজে পেতে হয়। তাদের শারিরিক গঠন, কাজের ধরন, ভাষা ও শিকারপ্রিয়তা দেখেই সহজে আলাদা করা যায়। এদের বর্তমান বাস স্থান রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুরা অঞ্চলে।এদের প্রধান নিবাস রাঢ়বংগ,সংলগ্ন বিহার ও উরিষ্যার অরণ্যাঞ্চলে সরকার কর্তিক নির্ধারিত সাঁওতাল পরগনায়। ১৯৮১ সালের আদমশুমারীতে পাবনা, যশোর, খুলনা এবং চট্টগ্রাম এলাকায় কিছু কিছু সাঁওতাল পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়।১৯৪১ সালের জরিপে বাংলাদেশে বাংলাদেশে সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল আট লাখ। আশি সালে খৃস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিত আগ্রাসী মনোভাবের জন্য সেই সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে এক লাখের কিছু বেশী।সর্বশেষ ১৯৯১ সনের আদমশুমারীতে বাংলাদেশে সাঁওতালদের সংখ্যা দুই লাখের কিছু বেশী। সদ্য প্রকাশিত পঞ্চম আদমশুমারীতে সাঁওতালদের আলাদা ভাবে পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়নি।

সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়(প্রোটো অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীভুক্ত। এদের গায়ের রঙ কাল, উচ্চতা মাঝারি, চুল কালো ও কোকড়ানো, ঠোঁট পুরু। এই দীর্ঘমূন্ডু প্রশস্তনাসা সাঁওতালদের সংগে মুন্ডা, ওরাঁও,মালপাহাড়িদের দেহবৈশিস্ট্য, ভাষা ও সংস্কৃতিগত যথেস্ট মিল আছে। আরো মিল রয়েছে-তাদের গ্রামীণ পঞ্চায়েতি শাসন ব্যবস্থা ও সামাজিক মুল্যবোধের ক্ষেত্রে। সেই সংগে তাদের নৃত্যগীতবাদ্য-অনুরাগের ক্ষেত্রেও। সাঁওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা। এরা কৃষি উতপাদন ব্যবস্থা ও কৃষি সংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত। 
http://amarbornomala.com/uploadedimage/6564bbbb.jpg
সাঁওতালরা মিশ্র ধর্মে বিশ্বাসী। তাদের প্রধান উপাস্য সুর্য-ওদের ভাষায় সিং বোংগা, কিন্তু পর্বত দেবতা(মারং বুরু)ও খুব গুরুত্বপুর্ণ একজন দেবতা। 

সাঁওতালদের বিশ্বাস-আত্মা অবিনশ্বর। সেই অনৈসর্গীক আত্মাই জীবনের সকল ভালোমন্দ নির্ধারন করে।তাই ওদের প্রত্যাহিক প্রার্থনা পর্বত(বোংগা) গুরুত্ব পুর্ণ। এছাড়া হিন্দু দেব দেবীদের প্রভাবও অনেক অনুসরনীয়। প্রকৃতপক্ষে সাঁওতালরা ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে সর্ব প্রানবাদী ও প্রাকৃতিক উপাসক। সাঁওতালরা খুবই উতসবপ্রিয় জাতি। তাদের বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। প্রতি মাসেই আছে নানান উতসব পরব-যা নৃত্যগীতবাদ্য সহযোগে উজ্জাপণ করে থাকে। নববর্ষ ফালগুনে পালন করে স্যালমেই উতসব, চৈত্রে বোংগাবোংগী উতসব, বৈশাখে হোম, আশ্বিনে দিবি, পৌষে সোহরাই উতসব পালন করে। এর মধ্যে সোহরাই উতসব অনেকটা ওদের জাতীয় উতসব-যা পৌষ সংক্রান্তির দিন পালন করে অনেক ঘটা করে। ফসলের দেবতাকে তুস্ট করাই এই উতসবের অন্যতম কারন। এই অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষন সাঁওতাল তরুন-তরুনীদের দলবদ্ধ নৃত্য। সাঁওতালদের আর একটি গুরুত্বপুর্ণ উতসবের নাম ‘বাহা’ অর্থাৎ বসন্ত উতসব।
http://media.somewhereinblog.net/images/monihar_mm_1302790111_1-pd2848725.jpg
সাঁওতাল সমাজে বিবাহ পুর্ব স্বাধীন মেলামেশায় কোনো সামাজিক বাধা নেই।কিন্তু তাদের বিবাহিত জীবনে বিশ্বস্ততার অভাব কমই দেখা যায়। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ, বিধবা, তালাক প্রাপ্তদের পুঃণবিবাহের প্রচলন আছে।আছে পণ প্রথা। সাঁওতালরা পিতৃ প্রধান পরিবার হলেও জীবিকা অর্জনে নারীর ভুমিকা সমান। সাঁওতালদের ঘর ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন ও মাটির দেয়াল কারুকার্যময়-যা নারীদের শৈল্পীক সৌন্দর্য্যস্পৃহা প্রকাশ করে।ওদের সমাজ ব্যববস্থা ঐতিহ্যবাহি পঞ্চায়েত প্রথায় নিয়ন্ত্রিত। আর্থ সামাজিক কারনে দারিদ্র ওদের নিত্য সংগী। তাই বাধ্য হয়ে অতি অল্প মজুরীতে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। শত দারিদ্রতার মধ্যেও ওদের মনে প্রান প্রাচুর্যের অভাব নেই। কর্মপটু সাঁওতাল তরুনী-রমণী খুবই সৌন্দর্য সচেতণ,বিশেষ করে তরুণীরা।

সাঁওতালরা বলতেগেলে সর্বভূক। এরা নেশা করতে ভালোবাসে। নিজ নিজ ঘরে তৈরী হাড়িয়া নামক একধরনের চোলাইমদ ওদের অত্যন্ত প্রিয় নেশা পানীয়। যা ভাত পঁচিয়ে তৈরী করা হয়। মহুয়া বা তালরস থেকে একধরনের শক্তিশালী মদ তৈরী করে ওরা নেশা করে। সাঁওতালদের ভাষা অস্ট্রিক হলেও এরা এখন ভালো বাংলা বলতে পারে। এদের মধ্যে শিক্ষিতের হারও এখন উল্যেখ করারমত।বাংলাদেশের স্বনাম ধন্য দুইজন চিকিতসক এই সম্প্রদায়ভুক্ত। এছারাও অনেক শিক্ষিত ব্যাক্তি সমাজের উচুস্থানে অবস্থান করে এদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সনের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে সাঁওতালদের আছে গৌরবময় লড়াকু ইতিহাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন