সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ঈদ বিষাদঃ


ঈদ বিষাদঃ

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৮: ১৩, ৩১ আগস্ট, ২০১১

ঈদ বিষাদঃ

ঈদ আমার কাছে খুব আনন্দের বিষয় নয়। আমি যখন শিশু-কিশোর ছিলাম, তখনকার ঈদটা ছিল একেবারেই তিক্ততা পূর্ণ। আমার মনে আছে, ঈদের কয়েকদিন পুর্বেই যেখানে আমার দুই স্টেপ ব্রাদার এবং অন্যান্য কাজীনেরা ঈদের নতুন কাপড়, জুতার ভালো-মন্দ নিয়ে কম্পেয়ার করতো-তখন পর্যন্ত আমরা দুই ভা ই বোন জানতেই পারতামনা আমাদের দুজনের জন্য আব্বা কি কাপড় চোপড় পাঠিয়েছেন(আমার আব্বা চাকুরী সূত্রে পঃ পাকিস্তানে থাকতেন। আমাদের বাড়ীতে থাকতেন স্টেপ মাদারের স্বপরিবার একবোন এবং আমার স্টেপ মাদারের আগের ঘরের দুই সন্তান-যারা আমার থেকে ১২ এবং ১০ বছরের বড। আমার বুবু আমার থেকে ৭ বছরের বড়। ঐ খালাই মুলত আমাদের স্থানীয় অবিভাবকের নামে আমাদের দুই ভাই বোনের উপর নির্যাতন করত)! ঈদের দিন খুব সকালে স্টেপ ব্রাদার্স-কাজীনেরা মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আচকান পরে সেজেগুজে ঈদগাহে চলে যেত-তারপর আমার আর বুবুর জন্য আব্বার পাঠানো নতুন কাপড় দেয়া হতো! সেই শিশু বয়সেই আমি কস্টে-ক্ষোভে ঈদের নতুন কাপড় পড়তামনা। আমি ছেলে বেলা থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি কিন্তু আমি ঈদের নামাজ পড়তামনা কিম্বা কদাচীত ঈদগাহে যেতাম একা- এবং পুরনো কাপড় পরেই। ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে ফিরতাম অনেক দেরি করে-কারন আমার বাড়ি ফেরার কোনোই তাগিদ ছিলনা। বাড়িতে ফিরলেই দেখতাম স্টেপ ব্রাদার্সদের খাওয়ার জন্য জোরাজুরি। এটা খাও, ওটা খাও বলে জোর করে খাওয়ানো হতো।তখন আমি আর বুবু ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতাম-কখন আমাদের খাবার দেয়া হবে। আমার সামান্য জ্ঞান হওয়া অবধি আমি কোনোদিন ঈদ/কোরবানীর কোনো খাবার খাইনি!

এমনি করতে করতেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো। ২৫ মার্চের কালো রাতেই ঢাবির ইংরেজী অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আমার ছোট মামা (সেজান) ততকালীণ ইকবাল হলে আরো অনেকের সাথে শহীদ হন। পরের দিন আমার বড় মামা ঢাকা জেলা মুখ্য হাকিম(দায়রা জজ) ইকবাল হলে সেজান মামাকে খুঁজতেগিয়ে শহিদ হন! স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগেই আমার দুই স্টেপ ব্রাদার তারা ৭ মার্চ বংগবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পর অন্য সব ছাত্র যুবকদেরমত আমাদের এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে পাক বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে দল গঠন করে এবং ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিল। ২৬ মার্চ আমাদের ঢাকার বাড়ি পাক বাহিনী আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এমন এক পরিস্থিতিতে আমার বুবু বড় মামার ঝিগাতলার বাডিতে, আমি তখন ঝিনেদাহ ক্যাডেট কলেজে, আমাদের পরিবার(সদ্য পাকিস্তান ফেরত স্টেপ মাদার, ব্রাদার্স,তাদের খালাসহ আরো অনেকে) প্রথমে কেরানীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর হয়ে বরিশাল,সেখান থেকে মঠবাড়িয়া-বামনা এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়।নিরাপত্তার জন্য ক্যাডেট কলেজ থেকে সকল ক্যাডেটদের ছুটি দেয়াহলে-আমি প্রথমে বাগেরহাট, চিতলমারী হয়ে ঢাকা ফিরে নিজ পরিবার কিম্বা আত্মীয় স্বজন কাউকে নাপেয়ে কুমিল্লা,চাঁদপুর,বরিশাল হয়ে মঠবাড়িয়া-বামনা পৌঁছি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ঐ এলাকা আমার দাদা বাড়ি-যেখানে আমাদের বেশ কিছু ল্যান্ড প্রপার্টিসহ অন্য সম্পত্তি আছে। যা দেখাশোনা করতেন মূলত দুরসম্পর্কের আত্মীয় এবং পেশাদার কেয়ার টেকার।

মুক্তি যুদ্ধের শুরুতেই ততকালীন পটুয়াখালী জেলার বামনা থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর(বীর উত্তম, যিনি আমার ছোট চাচার সহকর্মী এবং আমি তাঁকে চাচা ডাকি), ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম(বীর বিক্রম) এর নেতৃত্বে স্থাপিত হয় মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্প। মালিকানা সূত্রে এলাকায় আমাদের প্রতিপত্তি ভালই! ইতোমধ্যেই আমার এক স্টেপ ব্রাদার যিনি মাত্র কিছুদিন পূর্বেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে সেনা অফিসার হিসেবে রিক্রুট হয়ে পাকিস্তানের মিলিটারী একাডেমী কাকুল যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন-তিনি এবং তার ছোট ভাই যিনি ক্যাডেট কলেজ থেকে সবে এসএসসি পাশ করেছেন-তিনিও মুক্তিযুদ্ধে যোগদিয়েছেন। ১২ বছরের আমিও ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমরের খুব স্নেহভাজন হিসেবে বিভিন্ন জনের কাছে তথ্য পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত হয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও পরিচিত হয়েযাই। 

আমাদের প্রপার্টির অন্যতম কেয়ারটেকার চাচার একপুত্র আবদুস সালাম তখন স্থানীয় স্কুলের অস্টম শ্রেনীর ছাত্র। আবদুস সালাম নিজেকে কেয়ার টেকার পুত্র মনে নাকরে-আমাদের সকল প্রপার্টি ওর আব্বার মনে করতো এবং আমাদের সাথে প্রভূ সুলভ আচরণ করতো! স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে আমাদের গ্রামের বাড়ির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বাবা/চাচারা শুধুই জমি বর্গা দেয়া এবং কিছু ওয়াকফ সম্পত্তির বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। বিপদেপরে আমরা স্বপরিবারে গ্রামে গিয়েছি-তা কেয়ার টেকার এবং অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্টরা মনেমনে ভালোচোখে দেখেনি।

গ্রামে গিয়ে কেয়ার টেকার পূত্র আবদুস সালাম আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়। সে আমার স্বার্বক্ষণিক বন্ধু। সালামের একটা সুপিরিয়র কমপ্লেক্স ছিল-সে ক্লাস এইটে পড়ে! উপরন্তু দ্রুত গাছে চড়তে পারে, খরস্রোতা নদি সাতরে পার হতে পারে, নদিতে ডুব দিয়ে বড়বড় মাছ ধরতে পারে, নৌকা চালাতে পারে, দুর্দান্ত হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা খেলতে পারে,এমনকি পাঞ্জায় আমাকে হারিয়ে দেয়! প্রসংগ-অপ্রসংগে সালাম আমাকে অবজ্ঞাও করে এবং কিছু জিজ্ঞেস করলেই আমাকে বলবে-“তুমি বুঝবানা-ক্লাশ এইটে উঠলে বুঝবা”! আমি যখন তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র তখন একবার গ্রামের বাড়িতে আমার নির্বাসন হয়েছিল। সেই সময়ও সালাম আমাকে অবিভাবক সুলভ সুরে বলতো-“তুমি বুঝবানা-ক্লাশ ফোরে পড়লে বুঝবা। তখন সালাম ক্লাশ ফোরে পড়ত। সালাম নিজ এলাকার বাইরেই ২/৩ থানা এলাকার পথঘাট চিনে। ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর, ক্যাপ্টেন মেহেদী ইমাম এর বিভিন্ন ইনফর্মেশন বাহক আমি এবং আমার পথ প্রদর্শক আবদুস সালাম।

ইতোমধ্যে আমার এক চাচা এবং চাচাত ভাইও পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে শহীদ হন। আমাদের পরিবারের মামা, চাচা এবং কাজীনেরা যাদের যুদ্ধে যাবারমত বয়স-তারা সবাই মুক্তি যুদ্ধে যোগ দেন। জুন মাসে মেজর জলিল(বীর উত্তম) বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের মুক্তি যুদ্ধের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন-যা পরবর্তীতে ৯ নম্বর সেক্টর হয় এবং বামনা থানাধীন বুকাবুনিয়া নামক প্রত্যন্ত অঞ্চলকে মুক্তি যুদ্ধের সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার হিসেবে সমস্ত কার্য্যক্রম পরিচালনা করতেন। আমার স্টেপ ব্রাদারসহ আমাদের পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান। তখন আমাদের কেয়ার টেকার, আমার বন্ধু আবদুস সালামের আব্বা পাকিস্তানী সেনাদের কাছে আমাদের পরিবারের অবস্থান জানিয়ে দেয়! হঠাত করেই পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোশর রাজাকার আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় একই সাথে বরিশাল শহরের বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়। বাড়িতে অবস্থানরত ৪ জন তরুন মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমাদের পরিবার আবার নতুন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি যোদ্ধারা সালামের আব্বা অর্থাৎ আমাদের কেয়ার টেকারকে হত্যাকরে ওদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমর আমার বন্ধু আব্দুস সালামকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দেন! কিন্তু সালামের পিতা খারাপ হলেও সালাম কোনো দোষ করেনি বলেই আমি ক্যাপ্টেন শাজাহান ওমরকে অনুরোধ করি-সালামকে হত্যা নাকরার জন্য। ওমর চাচা আমার কথা রেখেছিলেন। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাকীটা সময় “রাজাকার পুত্র” সালামকে অনেক শারিরিক নির্যাতন এবং অবহেলায় মুক্তি যোদ্ধাদের ফুট ফরমাশ করেই কাটাতে হয়েছিল।

নভেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। উঠি পুরনো ঢাকায় আমাদের আর এক মামা(শিল্পী হায়দার হোসেনের আব্বা)র বাসায়। বুবু তখনও বড় মামীদের সাথে।

স্বাধীনতার পর ২/৩ বারের বেশী আমার গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে আমাদের গ্রামের সেই হলতা নদি, মঠবাড়িয়া-বামনা, বিষখালী, বরিশাল-কীর্তনখোলা নদির আমুল পরিবর্তন হয়েছে।আমার স্ত্রী এবং ছেলেরা প্রায়ই আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি দেখার বায়না করত। আমার বড় ছেলে যখন এইসএসসি পাশ করে-তখন ওদের নিয়ে স্বপরিবারে গ্রামের বাড়ি যাই ঈদ করতে। মঠবাড়িয়া-বামনাতে আমার দাদার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও সেই ট্রাস্টির একজন মোতওয়াল্লী। 

ছেলেদের নিয়ে মঠবাড়িয়া থানা শহরের ঈদ্গাহ থেকে ঈদের নামাজ পরে ফিরছি। গ্রামেও ঈদগায়ের পাশে সারিবদ্ধ ভিক্ষুক। আমরা সাধ্যমত সকল ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দিচ্ছি। হঠাত চলত শক্তিহীন পংগু বৃদ্ধ এক ভিক্ষুকের হাতে টাকা দিতেই চমকে উঠলাম-কেমন যেনো মুখটা চেনা চেনা লাগছে! আমি থমকে দাড়াই। কে এই ভিক্ষুক? আমাদের বর্তমান কেয়ার টেকার বললেন-“স্যার, এই লোক আপনাদের একসময়ের কেয়ার টেকার মকবুল হোসেনের ছেলে আব্দুস সালাম, ওর বাপে রাজাকার আছিল, আপনাদের বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিছিল.........”! 

কস্টে আমার বুক ভেংগে যাচ্ছে-আমার কিশোর বয়সের বন্ধু আবদুস সালাম। যাকে নিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর্মস এম্যুনেশন পৌঁছে দিয়েছিলাম-রাজাপুর, বেতাগী ও বাখেরগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে......! যার কাছে আমি পাঞ্জায় হেরে যেতাম! আমি সালামের কাছে জানতে চাইলাম-"সালাম, আমাকে চিনতে পারছো? কি করে তোমার এমন অবস্থা হলো?" 
সালাম আমার চোখের দিকে একবারও তাকালোনা!

জানলাম-মুক্তি যুদ্ধেরপর সংসারের বড় ছেলে হিসেবে ওদের সংসারের হাল ধরতে বেছে নেয়-দিন মজুরের কাজ। তারমধ্যে অন্যতম কাজছিল-অন্যের নারিকেল-সুপারী গাছ থেকে নারিকেল-সুপারী পেরেদিয়ে মজুরী নেয়া। তেমনই একটি গাছ থেকে সুপারী পারতেগিয়ে গাছ থেকে পরে মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। টাকার অভাবে চিকিতসা হয়নি। তখন থেকে সালাম পংগু-ভিক্ষাই একমাত্র পেশা!

আমার জীবনের ঈদ আবারও বিষাদ হয়ে গেলো! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন