সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আমেরিকার কড়চা-৩


আমেরিকার কড়চা-৩

লিখেছেন বাবুয়া, রাত ০৯: ৩৭, ১৪ অক্টাবর, ২০১১

আমেরিকার কড়চা-৩

মিশিগান থেকে কানাডা খুব কাছেই। সাগিনাও থেকে দুই ঘন্টা ত্রিশ মিনিট ড্রাইভ করে কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সে যাওয়া যায়। সেখানেই পৃথিবী বিখ্যাত নায়গ্রা ফল। আমি আগেও একবার নায়াগ্রা গিয়েছিলাম-সেবারেও আমেরিকার ভিতর থেকে।তখন আমাদের জার্নী রুট ছিলো নিউ জার্সী থেকে ১০০০ মাইল দুরত্বে-মিনেসোটা এবং বাফালো স্টেস্টের সীমান্ত থেকে নায়াগ্রা।আমেরিকাতে নর্মালী দুরত্ব বোঝানো হয় ড্রাইভিং টাইমের উপর ভিত্তি করে। যদিও মাইল পোস্ট আছে।কিন্তু সকলেই পথের দুরত্ব বোঝাতে বলে-"...... সিটি থার্টি/ফোর্টি মিনিটস ড্রাইভিং টাইম"!সিদ্ধান্ত হয়েছে-আমরা সবাই মিলে নায়গ্রা ফল দেখতে যাবো। আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো। দিন ক্ষণ ঠিক করে ডঃ আমিন ওখানে Hilton Garden Inn Niagara-তে ৩ টি সুইট ৩ দিনের জন্য বুকিং দিলেন।

আগেই বলেছি-প্রতিটা আমেরিকান পরিবারে একাধিক গাড়ী থাকে। কাছে দূরে যাবার জন্য,এমনকি ভিন্ন ভিন্ন ওয়েদারে ভিন্ন রকমের গাড়ী ব্যাবহার করে এরা। যেমন বরফ ঢাকা পথে জীপ গাড়ী বেশী ব্যাবহার করে। তাইতো যে সব অঞ্চলে বেশী বরফ পরে-সেই সব এলাকায় জীপ গাড়ীর প্রচলন বেশী। আমার ভায়রারও বেশ ক'টা কার/জীপ ছারাও বাড়ীর সকলের জন্য একটা ভ্যান আছে। আমার বৌ'রও গাড়ী আছে। তাই বলেতো সবাই একটা করে গাড়ী নিয়ে বেড়ানোর নামে গাড়ীর মিছিল নিয়ে যেতে পারিনা!আমরা যেটাকে মাইক্রোবাস বলি-ওরা সেটাকে বলে ভ্যান। ভ্যানে করে ওরা হলিডেতে লং'-এ যায়।ওদের প্রায় সব গাড়ীতেই নেভিকেশান সিস্টেম আছে।নেভিকেশান সিস্টেম হলো-গাড়ীতেই মনিটরে দেখা যায়/জানা যায় আমি কোন রোড ধরে কোথায় যেতে পারবো সহজে।কোথায় ট্রাফিক জ্যাম নেই, কোথায় বরফ জমে রোড ব্লক হয়ে নেই-ইত্যাদি!আমি প্রথম নেভিকেশনাল ল্যান্ড রোভার জীপ চালাই ইংল্যান্ডে।

পুরো আমেরিকা জুড়ে ট্রাফিক আইন খুব কঠোর।একবার কোন রোড ভুল করে নির্দিস্ট এলাকা পাস করে(ওভার টেক)সামান্য কিছু দূরে চলে গেলে, কিম্বা অন্য রোডে ঢুকে গেলে ব্যাক গিয়ারে কিম্বা যেখানে সেখানে ইউ টার্ণ করে ফিরে আসার কোনই সুযোগ নেই।হয়তোবা ২০/২৫ মাইল ড্রাইভ করে কোন "Exit" দিয়ে ঘুরে আবার সেই রোডে ফিরতে হয়!এদেশে গাড়ী left hand drive,তাই প্রয়োজনে বাম দিক দিয়ে ওভার টেক করতে হয়।সকল ধীর গতির গাড়ী রোডের ডান পাশে চলে।কোন রোডে কতো মাইল স্পীডে ড্রাইভ করতে হবে-তাও কিছুক্ষণ পর পর সাইনবোর্ডে ও ডিজিটাল নিয়ন সাইনে নির্দেশনা দেয়া আছে। এখানে ওভার স্পীডে ড্রাইভ করলে পুলিশ টিকেট ধরিয়ে দিবে,আবার আস্তে ড্রাইভ করলে এক্সিডেন্ট হবে!রোডে নর্মালী কোন পুলিশ দেখা যায়না-কিন্তু ভুল করলেই মুহুর্তের মধ্যে আলাদীনের দৈত্য রুপি পুলিশ এসে হাজির হয়!ভুল করলেই ট্রাফিক পুলিশের হাতে টিকেট খেতে হবে-নো আর্গুমেন্টে!নো কন্সিডার!

আমার ভায়রা খুব "ঘাগু মাল"-কিন্তু তাকে আমি তেমন একটা পাত্তা দেইনা কখনোই!কারন,আমার সাথে আমার বৌ'য়ের বিয়ে নিয়ে ওদের পক্ষের যত জন সব চাইতে বেশী ঝামেলা কাম বিরোধিতা করেছিলেন-তার মধ্যে অন্যতম এই ভায়রা(সেই কারনেই আমি তাঁকে মিঃ বদরুল আমিন থেকে ‘মিঃ বদ’ডাকি) এবং তাঁর বৌ,-এখন আমাদের সকলের প্রিয় "বড় আপু"!সেই বড় আপু এখন আমার খুব ভক্ত!আমাদের বিয়ের পর থেকেই জনাব ভায়রা ভাই আমার দোষ/অযোগ্যতা ধরতে ওত পেতে থাকেন!আমি যেহেতু আগে ঐ পথে কখোনো ড্রাইভ করিনি/যাইনি-তাই আমি কয়েক দিন পুর্বেই একাকী একদিন মিশিগান পার হয়ে কানাডার অন্টিরিও সীমান্ত ঘুড়ে এসেছি-শুধু ভায়রা ভাই যাতে আমার অযোগ্যতা ধরতে না পারেন। তাছারা আমেরিকার সর্বত্রই ম্যাপ নিয়ে যেতে হয়। তাহলে পথ ভুল করার সুযোগ কম থাকে। আমি যখনই যেখানে যাই-তখনই সেখানকার ম্যাপ কালেকশান করি সবার আগে।

আমরা যখন কানাডায় নায়াগ্রা ফল দেখতে যাই তখন ছিলো অগাস্ট মাস। সামার সিজন। আমি ড্রাইভ করছি.........। রোডের দুই দিক বেশ সাজানো এবং পরিকল্পিত গাছপালা লাগানো। মজার বিশয় হলো-কিছু কিছু গাছ ছাড়া বেশীর ভাগ গাছপালাই ন্যাচারালী জন্ম নেয়া! দুরে ঘন জংগল আর চমতকার লেক বেস্টিত উচু নীচু পাহাড়। বেশীর ভাগ গাছের পাতার রঙ হলুদ। ওগুলো জন্মগত ভাবেই হলুদ রঙ্গের। এইপথে যেতে বেশ বড় একটা সংরক্ষিত বন এরিয়া পার হয়ে যেতে হয়।কানাডা সীমান্তের কাছে এই বনের নাম-"লেক-রজার্স রেইন ফরেস্ট"। রোডের দুই পাশে ঘন বন। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক। হেড লাইট জ্বালিয়ে ড্রাইভ করার সিগনাল দেয়া আছে। গাদাগাদি করে গাছ আর লতাগুল্ম নিথর দাঁড়িয়ে আছে। বৃস্টির মত কুয়াশা পড়ছে। এই এলাকায় এখনো বেশ কিছু রেড ইন্ডিয়ানদের বসবাস। রেড ইন্ডিয়ানদের অস্তিত্ব এবং ঐতিয্য ধরে রাখার জন্য সরকার অনেক বেশী সুযোগ দিয়ে এদেরকে এখনো পোষন করে!এবার "ড্রাইভ স্লোলী"লেখা সিগনাল দেখে স্লোলী ড্রাইভ করছি। পুলিশ চেক পোস্ট এবং টোল পোস্ট। টোল পোস্টে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নিলো!বন বিভাগকে জন প্রতি ২ ডলার এবং গাড়ীর জন্য আরো দশ ডলার টোল দিতে হলো। চেক পুলিশ কর্তিক আমাদের জানিয়ে দেয়া হলো-সামনেই ডেঞ্জার জোন!

এখানে দু ধরনের ডেঞ্জার আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে।একটা হলো বন দস্যু এবং অন্যটা হলো রোডের উপড় জমে থাকা একধরনের কাদামাখা পিচ্ছিল বরফের মতো পদার্থ!এখানে অনেক বন ডাকাত আছে(অফিসিয়ালী,বাস্তবে নয় মনে হয়)।যারা পর্যটকদের গাড়ী থামিয়ে সব কিছু লুটে নিয়ে গভীর জংগলে হারিয়ে যায়!যদিও অমন ঘটনা কালে-ভাদ্রেও ঘটেনা,তবুও আগে পিছে/ঘন ঘন পুলিশের গাড়ী আছে ইমার্জেন্সী ডিউটিতে। দ্বিতীয় ডেঞ্জারঃ এই পিচ্ছিল পথে খুব বেশী রোড এক্সিডেন্ট হয়। তাই কিছু দূর পর পরই রেস্কিউ টীম আছে রেকারনিয়ে.........দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ী সরিয়ে নেবার জন্য। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন গরিব দেশ থেকে অনেকেই আমেরিকায় পাড়ি দেয় অবৈধ ভাবে। যারা স্থল পথে কানাডা হয়ে আমেরিকায় আসার চেস্টা করে-তারা কানাডা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হয় এই বনাঞ্চল দিয়ে মিশিগান কিম্বা বাফালো-মিনেসোটায় ঢুকে পরে! 

বিশাল জংগলের বুক চিড়ে এই রোড চলে গিয়েছে একদম কানাডা সীমান্তে। আগেই বলেছি-এটা একটা সংরক্ষিত বন। এই বনে প্রচুর বন্য প্রানী- সব সময় রোডের এপাশ থেকে অন্য পাশে চলে যায়। কোথাও সাইন বোর্ডে ব্যাংয়ের ছবি আঁকা এবং শতর্ক বানী লেখা-"ড্রাইভ স্লোলী, ফ্রগ ক্রসিং"। আবার হরিন কিম্বা চীতা বাঘের ছবি দিয়ে লেখা "ড্রাইভ স্লোলী, ডিয়ার/ লেপার্ড/ এলিফেন্ট ক্রসিং"-এমন কি পাইথন ক্রসিং! কিন্তু অবাক কান্ড, কোথাও মানুষ ক্রসিংর জন্য "ড্রাইভ স্লোলী-ম্যান ক্রসিং" লেখা নেই! এই ডেঞ্জার জোনটুকু প্রায় ৪০ মিনিটে আমরা ঠিক ভাবেই পার হয়ে গেলাম। পথে আমরা একটা হাইওয়ে ইন'এ ওয়াশ এন্ড ক্লিন হয়ে হালকা কিছু খেয়ে এবং একটু সময় রেস্ট নিয়ে আবার চলেছি আমাদের গন্তব্যে। দুই ঘন্টা পচিশ মিনিটে আমরা চলে আসি মিশিগান-কানাডা ইমিগ্রেশনে। 

নদী/খাল বিহিন এলাকায় খুব সুন্দর মাইল খানেক লম্বা একটা ব্রীজ বানিয়ে দুই দেশের সীমান্ত পারাপাড়ের সীমান্ত চৌকি বানানো হয়েছে! আমার আগেই কানাডার টাইম এক্সপায়ারড ভিসা ছিল। আমাদের তিন জনের(আমি, আমার বৌ-বাচ্চার) ট্রাঞ্জিট ভিসা নিতে হয়েছে ৩৫ ডলার ফি দিয়ে। আমাদের তিনজনের সবুজ পাসপোর্ট দেখে ইমিগ্রেশন কর্ম কর্তাদের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। যদিও আমাদের তিন জনের পাসপোর্টেই ইউরোপ আমেরিকা সহ অনেক দেশ ভিজিট করার প্রমান ছিলো!

মিঃ আমিন Hilton Garden Inn Niagara হোটেলে সিট বুকিং এবং অনলাইন পেমেন্ট দিয়েছিলেন। এই হোটেলের একটা বিশেষ আভিজাত্য আছে। এই হোটেলের বেশ কিছু রুম থেকেই নায়াগ্রা ফল দেখার সুবিধা আছে। ঐ রুমগুলো "রয়েল সুইট"! খুব এয়রিস্টোক্রাটিক এন্ড কস্টলী-তবে কতোটা কস্টলী তা বলা নিস্প্রয়োজন, কারন কোন কোন সুশীল পাঠকের মনে হতে পারে-আমি "ফুটানী" করছি!আমাদের বিয়ের ১২/১৩ বছরপর "ছোট ভায়রা এবং শালীর সৌজন্যে হানিমুন ট্রিপ" নামে-আমার ভায়রা ঐ সুইটের এরেঞ্জ করেন। ঐ সুইটগুলো্র জানালায় খুব উন্নত টেলিস্কোপ যন্ত্র(দুরবীন) বসানো আছে। হোটেল বোর্ডার ইচ্ছা করলেই, গ্রহ-তারকারাজীর পরিচিতি সহ অন্টারিওর বেশ কিছু ছোট শহর এবং ন্যাশনাল পার্ক, অন্টারিও জু ছারাও পার্কে বেড়ানো বেপরোয়া জুটিদের বেপরোয়া ভালোবাসাবাসি সহ ...... অনেক কিছুই দেখতে পারেন ঐ দুরবীন দিয়ে। প্রতিটা রুমেই Treadmill, Jugging machine, Physiotherapy machine, হোটেলের ভিতরেই অত্যাধুনিক থিয়েটার হল, ক্যসিনো সহ অনেক কিছু আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন