সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গাঁজা


পথে প্রান্তরে-৪ গাঁজা

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৪: ২৩, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১

গাঁজা 

আমার এক সিনিয়র বন্ধু নন্দ (নামটি সংকলিত)। ওদের ফ্যামিলী ব্যাকগ্রাউন্ড অত্যন্ত রিচ। বাবা সচিব এবং মা-ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবশর নিয়েছেন বিংশ শতাবদীর নব্বই দশকে। নন্দ’র মা সচিব হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিক সাফল্যে/রেকর্ডের অধিকারী। নন্দরা দুই ভাই-বোন। ছোট বোনটির বিয়ের পর থেকেই আমেরিকা প্রবাসী। ঢাকার অভিযাত এলাকায় নিজস্ব বাড়িতে বাস করেন। নন্দ ছাত্র জীবনেই নেশায় আশক্ত। ঢাবি’তে নন্দ আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। অনার্স শেষ নাকরেই পড়া লেখা বন্ধ। একই এলাকায় থাকা হলেও ওদের বাড়িতে যাতায়ত নেই গত ১৫/১৬ বছর। হঠাত ওর সাথে দেখা স্কয়ার হাসপাতালে। জীর্ণ শীর্ণ, কংকালসার ভগ্ন স্বাস্থ্য-দেখতে অনেকটা ভেসে থাকা মরা মাছ। অথচ এই নন্দ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের মধ্যে ঈর্ষনীয় স্মার্ট ও সুদর্শন ছিল। ওকে কথা দেই-একদিন ওদের বাড়ি যাবো।

ছাত্র জীবনে নন্দদের বাড়িতে আমাদের নিয়মিত আড্ডা হতো। আমার জানামতে ঐ সময়ে ধানমন্ডি এলাকায় একামাত্র নন্দদের বাড়িতেই বিলিয়ার্ড ও স্নুকার খেলার অত্যাধুনিক সুব্যাবস্থা ছিল। নন্দ’র আব্বা প্রয়াত, আম্মাও বার্ধক্য ও মানষিক অসুস্থ্যতায় সারাদিন নিজ রুমেই স্বেচ্ছা বন্ধী। নন্দ’র একাধিক বিয়ে টেকেনি। ৪/৫ জন কাজের লোক, নিকট আত্মীয় নিয়েই নন্দদের জীবন। পুরনো ভৃত্য মজিদ এখন পৌঢ়ত্বের শেষ সীমানায়। নন্দ কথা বলে জড়িয়ে জড়িয়ে-যা নতুন কোনো আগন্তুক না বুঝলেও মজিদ বোঝে।

নন্দ’র কাছে বসে থাকতে থাকতেই ওর চিকিতসক এলেন। এই চিকিতসক দেশের প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ-লেখালেখির কারনেও যিনি আমাদের অনেকেরই পরিচিত।একই এলাকায় বাসিন্দা হিসেবে আমারও পরিচিত। তাঁর কাছেই নন্দ’র বিভিষিকাময় জীবনের বর্তমান এবং ভবিষ্যত জেনে কস্ট পাওয়া ভিন্ন কিছুই করতে পারিনি। নন্দকে ধরে ধরে আমরা ওদের বাড়ির ছাদে যাই-যেখানে আমাদের কৈশোর আর যৌবনের অনেক সময় আড্ডায় মেতে থাকতাম। এখন আর সেই ছাঁদটা আগেরমত নেই। ছাঁদে অনেক গাছপালা-যা দেখে আমার ভালো লাগল। নানান জাতের গাছ দেখতে দেখতে কিছু গাছের প্রতি আমার দৃস্টি আটকে গেল। দেখতে অনেকটা বড় গাঁদা ফুল গাছের মতো, কিন্তু ওগুলো গাঁদা ফুল গাছ নয়-সুন্দর এই গাছ একটি মাদকদ্রব্যের গাছ। যার নাম গাঁজা। দৃশ্যগতভাবে গাঁজাগাছ ও গাঁদা ফুলগাছ সহজে আলাদা করা যায়না।

বন্ধু নন্দের কথা নাবলে মণোরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট থেকে গাঁজা গাছ ও গাঁজা সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছি-যা পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিঃ- গাঁজাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Cannabis indica/ Cannabis sativa,বোটানিক্যাল নাম CanabisSativa Linn গোত্র হলো Urticacea. প্রাচীন কাল থেকে গাঁজা সারা দুনিয়ায় একটি বহুল ব্যবহৃত মাদক। কম মুল্য এবং সহজলভ্যতার কারনে নিম্ন আয়ের নেশাখোরদের মাঝে অত্যন্ত আদরনীয়। গাজা গাছের নির্জাসই মুলত নেশার বস্তু হিসেবে কার্যকর, যার নাম ক্যানাবিনল। ক্যানাবিডিয়ল এবং ক্যানাবিনলিক এসিডও এর কার্যকর উপাদান। 

গাঁজাগাছের স্ত্রী-পুরুষ আছেদুটিতেই ফুল হয়। তবে পুরুষ-গাছের মাদক ক্ষমতা নেই। স্ত্রী-গাছের পুষ্পমঞ্জুরি শুকিয়ে গাঁজা তৈরি হয়। এই গাছের কাণ্ড থেকে যে আঠালো রস বের হয় তা শুকালে হয় চরস। এক চরস খোড়ের কাছে শুনেছিলাম-চরস দুর্গন্ধময় নোংরা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে খেতে হয়, তাতে চরসের নেশা ভাল জমে!।স্ত্রী গাঁজাগাছের পাতাকে বলে ভাং। এই পাতা দুধে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় ভাঙের শরবত, অন্য নাম সিদ্ধির শরবত। এই শরবত ভয়ংকর এক হেলুসিনেটিং ড্রাগ। আমাদের বন্ধু সিদ্দিকী অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য একবার ভাঙের শরবত খেয়ে ২৪ ঘণ্টা প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। তখন নাকি ওর মনে হচ্ছিল-"ওর দুটি হাত ক্রমাগত লম্বা হচ্ছে। জানালা দিয়ে সেই হাত বের হয়ে আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে-তারা ধরতে যাচ্ছে কিন্তু একটুর জন্য ধরতে পারছেনা"। 

গাঁজাগাছের ফুল, ফল, পাতা এবং গা থেকে বের হওয়া নির্যাস ক্যানাবিনয়েডস। ক্যানাবিনল, ক্যানাবিডিওল, ক্যানাবিডিন। নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ (Alkaloids)ও প্রচুর আছে-এসব জটিল যৌগের কারণেই মাদকতা।

গাঁজা ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার। গাঁজা গাছের পাতা এবং ডাল উপমহাদেশে গাঁজা নামে পরিচিত একই জিনিস পশ্চিমা দেশ গুলোতে মারিজুয়ানা বা মারিহুয়ানা নামে পরিচিত। গাছের পাতা বা ডালের আঠালো কষ দিয়ে তৈরী চরস নামের জিনিসটিই পশ্চিমা দেশের হাশিশ। দেশে ভাং, সিদ্ধি, পাট্টিসহ নানা নামে পরিচিত এই বিষাক্ত জিনিষটি।

নিয়মিত গাঁজা সেবনের কারনে দৃষ্টিভ্রম, বাচালতা, মাংশপেশীর অনিয়ন্ত্রিত সংকোচন, দিকভ্রান্ত হওয়া, মাথা ঘুরা, ক্ষুধা লাগা, গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়া,সময়জ্ঞান হারানো,প্রলাপ বকা, বিকারগ্রস্থ্য এমনকি মানুষ হত্যাকরার ইচ্ছাও হতে পারে। অনেক সময় হাত পা’র অবশ, ঝি ঝি ধরা, কথা জড়িয়ে যাওয়া থেকে শ্বাস কষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। নিয়মিত গাঁজা সেবনে Ganja-psychosis হয়। এতে চোখে রক্তজমে চোখ লাল হয়ে যায়, ক্ষুধামন্দা, নির্জিবতা, শরীরের মাংস-পেশী শুকিয়ে যাওয়া, অত্যাধিক দুর্বলতা, হাত-পা কাঁপতে থাকা, পুরুষত্বহীনতা থেকে শুরু করে পুরোপুরি মানসিক রোগী হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।

এতদিন জানতাম গাঁজা সহজলভ্যএবং সস্তা হওয়ায় সমাজের অশিক্ষিত, সিমিত আয়ের জনগোষ্ঠির মধ্যেই বেশী প্রচলিত। কিন্তু এখন এর প্রচলন সমাজের উঁচুস্তরেও বিষেশভাবে একশ্রেনীর উচ্চবিত্তবানদের সন্তানদের মধ্যেও এর ব্যাপক প্রচলন- যার প্রত্যক্ষ প্রমান বন্ধু নন্দ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন