মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

কেউ নেই স্বদেশী উদ্বাস্তুদের দেখারঃ


কেউ নেই স্বদেশী উদ্বাস্তুদের দেখারঃ
লিখেছেন বাবুয়া, দুপুর ১২: ১৭, ১৩ জুলাই, ২০১১


কেউ নেই স্বদেশী উদ্বাস্তুদের দেখারঃ

যুদ্ধ, জাতিগত দাঙ্গা, প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে মানুষ নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধ ও খরাপীড়িত আফ্রিকা, যুদ্ধবিধ্বস্ত বসনিয়া ও হারজোগোভিনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বহু বছর ধরে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত হিসাবে স্বীকৃত। তাদের জীবনযাত্রার সংকট বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো সেসব জায়গায় মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত বিষয়ে দেশী কিম্বা বিদেশী কোনো পরিসংখ্যান নেই

বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে বড় ছোট বহু নদী একটানা ভাঙ্গন কবলিত হয়ে পড়ে। দেশটা যেহেতু একটি বদ্বীপ কাজেই এর পলকা গড়নের মাটি নদী স্রোতে ভাঙবে গড়বে এটাই স্বাভাবিক। সহজলভ্য পানির উৎস ঘিরে জনপদ গড়ে উঠার নিয়মটাও প্রাকৃতিক। সেই নিয়মে দেশের ঘনবসতির জনপদ নদীর পাড় ঘেঁষেই গড়ে ওঠে। কাজেই নদী ভাঙনের সাথে সাথে প্রতিবছর দেশের বিশাল জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ভাঙন কবলিত পরিবারগুলো হারাচ্ছে বাসস্থান, জীবিকার উপকরণ ও উৎস, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য। ভাঙন কবলিত পরিবারগুলোর দুঃখ-দুর্দশার চিত্র প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হলে প্রশাসন চটজলদি দুর্গত মানুষের মধ্যে কিছু রিলিফ বিলিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে আর সেই সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙনরোধের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর থেকে নদী ভাঙন রোধের নামে কত টাকা পানিতে ফেলেছে আর এর বিনিময়ে ভুক্তভোগী মানুষ কতটুকু উপকৃত হয়েছে তার বাস্তব চিত্র দেখলে নাগরিক সমাজ রীতিমত আঁতকে উঠবে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও সমাধান আলোচনা প্রসঙ্গে বাস্তুহারা শব্দটি বারবার আমাদের দেশে ব্যবহার হচ্ছে। বাস্তুহারা বলতে সম্পূর্ণ ভূমিহীন বুঝেই ইস্যুটি নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবতে আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভবে ব্যার্থ হয়েছি। বাস্তু হারানোর উৎস খুঁজে বাস্তুহারাদের শ্রেণী বিভাজন করলেই নদী ভাঙন কবলিত মানুষগুলোকে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। নদীভাঙন কবলিত ও আইলা বিদ্ধস্ত মানুষ কখনো সাধারণ বাস্তুহারার তালিকায় আসে না। UNHCRএর দেয়া অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা অনুযায়ীঃ যে সব মানুষ জনগোষ্ঠী যুদ্ধ, সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন অথবা প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে স্বাভাবিক বসবাসে জায়গা অথবা বাড়ি থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয় কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয় না তারাই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ মানুষ ভাঙনকবলিত এবং আইলা বিদ্ধস্ত অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ভাসমান হয়ে পড়ছে। তাদেরকে একপাশে ঠেলে না দিয়ে বিষয়টিকে আলাদা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা প্রয়োজন।

নদী ভাঙন এবং আইলা এমন একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় যা মানুষকে কোন প্রকার বিকল্প অবলম্বন বেছে নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই জীবনধারণের বর্তমান সকল অবলম্বন কেড়ে নেয়। সাধারণ ভূমিহীন কিংবা বাস্তুহারা একটি পরিবার পরিচিত সমাজের মধ্যেই এক ধরনের জীবনধারণে অভ্যস্ত থাকে। সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা এবং আনুষঙ্গিক নিশ্চয়তার তাৎক্ষণিক অভাবজনিত সংকট সৃষ্টি হয় না। কিন্তু আইলা ও ভাঙনকবলিত মানুষ মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে যায়। পরিচিত সমাজ ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে অপরিচয়ের সূত্র ধরে প্রথম আসে নিরাপত্তাহীনতা। বিশেষতঃ নারীর জন্য বিষয়টি ভয়াবহ। কিছুদিন পুর্বে একটি টিভি চ্যানেলে ভাঙনকবলিত পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন তরুনী, মহিলা নীচুস্বরে বলছিল ‘পুরুষে জ্বালাতন করে’। অর্থাৎ নদী ভাঙন কবলিত ভাসমান মহিলারা যৌন হয়রানির সহজ শিকারে পরিণত হয়।

গত দুই বছর পুর্বে দেশের দক্ষিনাঞ্চলে সর্বনাশা আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ্য মানুষদের জীবন যাত্রা সম্প্রতি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেই মহা দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থদের পুণর্বাসনের বিন্দুমাত্র ব্যাবস্থা আজও নেয়া হয়নি। অথচ তখন দেশী বিদেশী কত সাহায্যের ঢাক-ঢোলের কান ফাটানো চিতকার, বিকট আওয়াজে হেলিকপ্টার, সুটেড-বুটেড, ধুতি পরিহিত দেশী বিদেশী নেতাদের বাণী শুনেছি। অথচ আজ পর্যন্ত একটাও ভাংগা বেড়ীবাধ মেরামত করা হয়নি। ফলে ভুক্তভোগীরা পাচ্ছেনা সুপেয় পানীয়জল। গরু-ছাগল-কুকুর নিয়ে ভাংগা বেড়ীবাঁধের উঁচু ঢিবির উপড় শতছিন্ন পলিথিন ঘেড়া বস্তীর থেকেও নিম্নস্তরের ছাউনীতে বাসকরছে! এক কলশী মিঠা পানির জন্য ৩/৪ মেইল দূরে হাটু/কোমড় কাঁদা মাড়িয়ে পানি সংগ্রহ করছে। আইলার জলোচ্ছাস আর ভাঙনে সব স্কুল নদীগর্ভে বিলীন হয়েগেছে। স্কুলে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ ভাসমান হয়ে পড়েছে। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন পর্যায়েই এই শিশু-কিশোরদের শিক্ষা জীবন অব্যাহত রাখার কোন পরিকল্পনার নেই।নেই কর্ম সংস্থানের কোনো ব্যাবস্থা। অথচ বিষয়টি এমনভাবে অবহেলিত হওয়া উচিত ছিল না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন আইলাকবলিত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবেলায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। সহযোগিতা বলতে সবসময় নগদ অর্থ সাহায্য বুঝায় না এডভোকেসি ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন কিংবা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো সরকারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত সহায়ক আইন প্রণয়নে সাহায্য করতে পারে। সেই সাথে তাৎক্ষণিক সমস্যা মোকাবেলায় পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে নদী আইলা ভাঙন কবলিত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। বিষয়টা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তথা UNHCR এর কাছে তুলে ধরতে দেশের সকল মিডিয়া এবং সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন