সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

যোগ্যতা প্রত্যাশা বাস্তবতা ও প্রাপ্তি


পথে প্রান্তরে-৩ যোগ্যতা প্রত্যাশা প্রাপ্তি ও বাস্তবতা

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৩: ১২, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১১

যোগ্যতা প্রত্যাশা বাস্তবতা ও প্রাপ্তি

ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে কয়েকজন লোক নিয়োগের একটা বিজ্ঞাপন দেয়ায় ৩টি পদে ১২ জন লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপনে ২৭৬ জন চাকুরী প্রত্যাশী এপ্লাই করেন। একটা পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল কমার্স গ্রাজুয়েট।ঐ পদে একজন প্রার্থীর চাকরীর জন্য একজন সংসদ সদস্য সুপারিশ করেছেন। যেহেতু এমপি সাহেব আমার পরিচিত তাই ইন্টারভিউ গৃহিতা ইডি সাহেবকে প্রার্থী সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। ইডি(অবঃ ব্রীগেডিয়ার জেনারেল) সাহেব কৌশলে জেনে নিলেন প্রার্থী এমপি সাহেবের ভাগ্নী জামাই। ইডি সাহেব চাকুরী প্রার্থী জামাই শশুর বাড়ি থেকে কি কি যৌতুক পেয়েছেন-তাও জেনে নিতে বাদ রাখেননি! তার পরিধেয় স্যুট-টাই শশুর, হাতের ঘড়ি মামা শশুর থেকে পেয়েছেন। মোটর সাইকেল দেওয়ার কথা-কিন্তু শশুর তালবাহানা করছেন-ইত্যাদি! 
যাইহোক অনেক ছাড়দিয়ে প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়। সমস্যা হয়েছে চাকুরী দেবারপর। তিনি অন্য অফিসারদের সাথে ওয়ার্কস স্টেশনে বসতে চাননা। তিনি আলাদা একটি রুম চান।এমপি সাহেবের একটি ভিজিটিং কার্ড নিয়ে আমার সাথে দেখা করে বলেন-“"স্যার, --- মামা“(এমপি সাহেব) বলেছেন-আমাকে একটা আলাদা রুমের ব্যাবস্থা করে দিতে।"
আমি বলি-"ওয়ার্ক স্টেশনে বসে যারা কাজ করছেন তাঁরা সবাই শিক্ষায়, যোগ্যতায়, পদে তোমার থেকে অনেক বেশী এগিয়ে, তাঁদেরতো কারো সমস্যা হচ্ছেনা-তোমার সমস্যা হচ্ছে কেন?" 
এমপি'র ভাগ্নে জামাইর উত্তরঃ "স্যার,আমি --- কলেজের -- -- ছাত্র নেতা এবং জিএস ছিলাম। এখানে আমার বন্ধু বান্ধব এসে অন্যদের সাথে কাজ করতে দেখলে ওরা আমার চাকরিটা ছোট মনে করবে"”। 

হা হতোম্মী! কি জবাব দেবো আমি!!!

১৫ বছর আগে আমি নিজ চোখে দেখেছি-উত্তর কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় বসে জুতা সেলাই করে। প্রতিবেশীদেশে কলেজ ছাত্রটি খুব সকালে বাড়িরকাছে আবাসিক হোটেলে হোম মেড নাস্তা সরবরাহ করে,কলেজ শেষে রাতে রাস্তার পাশে ফল, ফলের জুস বানিয়ে বিক্রি করে। চীন-জাপানের মানুষের চিন্তার মধ্যে সামান্যতম ঠুনকো আভিজাত্য নেই, টাকার জন্য সৎপথে যে কোন কাজ তারা করতে পারে। একটি পড়ুয়া ছাত্র যদি ইলেক্ট্রিক,সেনিটেশনে দক্ষ হয়, ঘড়ি-মোবাইল-টিভি-ফ্রিজ মেরামতে দক্ষ হয়, সে সব কাজ করে আয় করতে পারে, সংসারের অভাব লাঘব করতে পারে, তাতে দোষ কী?

খরচের রাস্তা তো আধুনিক যুগে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালাও ট্যাকে মোবাইল গুঁজে রিকশা চালায়। তার বাড়িতেও ডিশ লাইন আছে। তারাও বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে-এর খরচ নেই? মোবাইলে তো রাক্ষসের খরচ। আয় বুঝে ব্যয় করার এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে দূরে থাকার, সঞ্চয় মনোবৃত্তি গড়ে তোলার, কুঅভ্যাস থেকে দূরে থাকার প্রবণতা জীবনের শুরুতেই তৈরি হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। এ জন্য আমাদের দারিদ্র্য ঘোচে না। আমরা পেশাকে ঘৃণা করি, অভাব ঢেকে রাখি, ভদ্র আবরণে চুরি করি, ঋণ করে ঘি খাই, দেনার দায়ে জর্জরিত হই, শ্বশুরের ঘাড়ে চড়ে আরামে খেতে চাই, যৌতুক নিয়ে মাদকাসক্ত হতে লজ্জাবোধ করি না। তবুও ঠুনকো ভদ্রলোকী ত্যাগ করে, কাজ করে সৎপথে জীবিকা উপার্জন করতে চাই না। এই মানসিকতা পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন।

আমাদের দেশের লোকজন এতই সাহেব, তারা জমিদার বাবুদেরকেও হার মানিয়েছে বাবুগিরিতে; কথায় কথায় রিকশায় চাপে। একটা হালকা বোঝা বাসায় নেয়ার জন্যও হন্যে হয়ে কুলি খোঁজে। আধপেটা খেয়েও কাজের লোক খোঁজে।

আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে,সরকার চাকরি দেবে; দয়া করে এই আশা নিয়ে সন্তানকে হাঁড়ির চাল, ক্ষেতের ধান-পাট, হালের গরু বিক্রি করে পড়াবেন না। শিক্ষা ও বেঁচে থাকা- জীবিকার হাতিয়ার, এটা মাথায় রেখে সন্তানকে প্রয়োজনমাফিক শিক্ষাদান করবেন। কোন অবস্থাতেই আপনি নিম্ন আয়ের মধ্যবিত্ত হয়ে আপনার সন্তানকে আয়েশি, অলস, অদক্ষ বাবু-ভদ্রলোক বানাবেন না। শেষে ঐ অদক্ষ সন্তান আপনার বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। 

আমার খুব "অপছন্দের" লোক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর 'সুন্দর হে সুন্দর' গল্প গ্রন্থের একটি গল্পে লিখেছিলেন- 'ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর টাকার জন্য কুলিগিরি করেননি, 'ভদ্রলোকের মুখে চপেটাঘাত করার জন্য কুলিগিরি করতেন"-কথাটা আমার ভালো লেগেছে। 
“চরমপত্র” খ্যাত এম, আর, আখতার মুকুল তার জীবন স্মৃতি চারনে লিখেছিলেন-"আমি বেকার জীবনে চুরি ব্যতীত এমন কোন কাজ নেই, যা করিনি"। 
পল্লী কবি জসীমউদ্দীন কলকাতায় যেয়ে হকারগিরি করেছেন, অর্থাৎ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করেছেন।

এত কথা বললাম, দৃষ্টান্তগুলো টানলাম এ কারণে যেন আমাদের দেশের উঠতি প্রজন্ম অনেকেই সরাসরি অফিসের বড় সাহেব হতে চান। বাস্তবতা উপলব্ধি করে তাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন হওয়া দরকার। ঠুনকো আভিজাত্যবোধ, সংকোচ, লজ্জা, সংস্কার, বাবুগিরি, অন্তঃসারশূন্য ভদ্রলোকী চিন্তা-চেতনায় প্রশ্রয় পেলে বাস্তব জীবনে সৎভাবে বাঁচার উপায় থাকবে না। বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করতে হলে লেফাফাদুরস্ত সংস্কার ঝেড়ে ফেলে যে কোন সৎ কাজে আগ্রহী থাকতে হবে, শ্রমের বিনিময়ে টাকা উপার্জন করতে হবে।

এক সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নে একটা শ্লোগান উঠেছিল-"সাধ্য অনুসারে শ্রম দাও, প্রয়োজন অনুসারে ভোগ কর।" পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাক বা না থাক, এই শ্লোগনটির মূল্য আছে। এখনো সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী লেখক-সাহিত্যিকরা শ্রমকে মূল্য দিয়ে থাকেন, পরনির্ভরতাকে ঘৃণা করেন। সমাজতন্ত্রিরা বলেন, "যার যার বিপ্লব তা তাকেই করতে হয়"। সমাজতন্ত্রের সাফাই গাইছি না।কিন্তু রাষ্ট্রীয় মনোপলিও কাম্য নয়। আমরা উদার গণতন্ত্র এবং ওয়েলফেয়ার স্টেটের স্বপ্ন দেখি। বিশ্বাস করি মিশ্র নীতিতে। যে সব নীতি রাষ্ট্রের জন্য, ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর, তা সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিতে গ্রহণ করা উচিত।

রাষ্ট্রের বা সরকারের একটি মৌলিক দায়িত্ব কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। রাশিয়া সরকার প্রথমদিকে সে দেশের নাগরিকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, কর্মের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো সৃষ্টি হয়নি।“ঘরে ঘরে চাকুরী দেয়া”র কথা স্রেফ চাপাবাজী। তাই বলেতো আমরা আমাদের সন্তানদের ভবঘুরে, অলস, অদক্ষ, হতাশাগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত করে তুলতে পারি না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে, সমস্ত ভদ্রলোকী আবরণ খুলে ফেলে, টাকার বিনিময়ে যে কোন সৎ কাজ করার মনোবৃত্তি থাকতে হবে।

অনেকের ধারণা, নেতাজী সুভাস বসু কেবলই ইংরেজ বিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু নেতাজীর 'তরুণের স্বপ্ন' বইটি পড়ে বুঝতে পারা যায় যে, তিনি পরাধীন ভারতের তরুণদের দেশপ্রেমিক হওয়ার উপায় হিসাবে কর্মজীবী হবার প্রেরণা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মাগান্ধী আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন তাদের লেখায়। মহাত্মাজীর 'আমার স্বপ্নের ভারত' এবং রবীন্দ্রনাথের 'পল্লী চিন্তা' বইয়ে রয়েছে সেই প্রেরণা।

কাজেই আমাদের শিক্ষত তরুন কর্মজীবি বন্ধুদের সহকর্কীদের সাথে কাজ করার মানষিকতা থাকতে হবে।কাজ করে নিজের যোগ্যতায় নিজের অবস্থান গড়েনিতে হএ। ছাত্র জীবন কিম্বা পারিবারিক জীবনে তাদের কার কি পজিশন ছিল-সেটা কোনো চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিবেজ্য নয়-সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন