সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

লন্ডনঃ স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভংগের উপখ্যান-২


লন্ডনঃ স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভংগের উপখ্যান-২

লিখেছেন বাবুয়া, বিকাল ০৫: ০১, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১

লন্ডনঃ স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভংগের উপখ্যান-২

বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত তরুণদের কাছে ইউরোপ, আমেরিকা যাওয়াটা সবসময়ই এক সোনার হরিণ। এই হরিণের পেছনে কম-বেশি ছোটেননি কিম্বা আশা করেননি এমন তরুণ পাওয়া মুশকিল। সবার কাছেই এ এক স্বপ্নের সুন্দর ঠিকানা। তরুণদের বদ্ধমূল ধারণা ইউরোপের লন্ডন অথবা আমেরিকার কোনো স্টেটস-এ একবার যেতে পারলে শুধু অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পূরণই নয় সামাজিক স্ট্যাটাসেরও কয়েকধাপ ঊর্ধগতি ঘটে থাকে। বরাবরই তাই ইউরোপ-আমেরিকাতে যাওয়ার জন্যে আমাদের মধ্যবিত্ত তরুণদের দৌড়ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। অভিভাবকমহলেও এ নিয়ে উৎসাহ আর উদ্দীপনার শেষ নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক তরুণ স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সরাসরি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া,ইউরোপীয়ান ইউনিয়নভূক্ত কোনো দেশে কিম্বা ইংল্যান্ডের কোনো শহরে লেখাপড়া করতে যাচ্ছে। এখন দেশের এমন কোনো ইউনিয়ন পাওয়া যাবে না যেখান থেকে দুই-একজন বিদেশে লেখাপড়ার জন্য পাড়ি জমায়নি। গত কয়েকবছরে স্পেশাল স্টুডেন্ট ভিসার বদৌলতে প্রায় তিনলক্ষ তরুণ শিক্ষার্থী লন্ডন, উত্তর লন্ডন, বার্মিংহাম, লিডস, ব্রিস্টল, ম্যানচেস্টার শহরে গেছে বলে প্রকাশ। এসব শহরের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে গেলেও বেশিরভাগ তরুণ যে তাদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারেনি এটাই সত্য। অনেকে আবার স্টুডেন্ট ভিসা নিলেও আগে থেকেই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে যান লেখাপড়া নয় চাকরি। বলা যায়, তুলনামূলক যারা মেধাবী এবং দেশে যাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা রয়েছে তারাই কেবল সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষা নিতে সচেষ্ট থাকেন। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যে হাজার হাজার তরুণ লেখাপড়া করার নামে স্টুডেন্ট ভিসা নিলেও তাদের লেখাপড়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মূল লক্ষ্য চাকরি-বাকরি করে ইংল্যান্ড আসার খরচ উঠানো এবং সেই সাথে রোজগার করা। বলা যায়, এই ঝোঁক বা ইচ্ছেটা বাংলাদেশের কম মেধাবী তরুণদের জন্যে মহা এক সর্বনাশ ডেকে এনেছে। অনেক তরুণ এই ভেবেও লন্ডন পাড়ি জমিয়েছেন যে কোনো মতো স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যেতে পারলেই হলো। পরে কিছু না কিছু তো একটা হবে। অনেকেই ধার-দেনা করে বা জমি বন্ধক রেখে স্টুডেন্ট ভিসার জোরে সত্যিই লন্ডনে গিয়ে উঠলেও এখন হা-পিত্যেশ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। 

বিভিন্ন রেস্তোরায়, মসজিদে অনেকজন ছাত্রের সাথে কথা বলেছি। সকল শিক্ষার্থীদেরই একই সমস্যা-আর্থীক অনটন! তাদের থাকার যায়গা নেই, কাজ নেই-হাতে টাকা নেই। এমন দুজন শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছি-যারা একটা স্যান্ডউইস দুজনে ভাগ করে খেয়ে ২৪ ঘন্টা পার করে দিয়েছে-কিন্তু জানেনা কাল কি ভাবে চলবে! বলা যায়-বেশীর ভাগ ছাত্ররাই প্রতারিত হয়েছে-বিভিন্ন কন্সাল্টেন্সী ফার্ম কর্তিক। সেই প্রতারণার সাথে রাস্ট্রীয় সংশ্লিস্টতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারন, এখানে অনেক ছাত্রদেরকেই ভর্তি করা হয়েছে-“ভাষা শিক্ষা কোর্স”, “সেক্রেটারিয়েল কোর্স” কিম্বা সাধারন মানের ট্রেড কোর্সে! কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা ১০০ ভাগ বিশ্বাস করে, কিম্বা “কোনো কন্সাল্টেন্সী ফি দেয়া লাগবেনা”-তেমন লোভে চাহিদামতো সকল ডকুমেন্টস কন্সাল্টেন্ট ফার্মগুলতে দিয়েই নিজেরা ণির্ভার থেকেছে। শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েই খুশীতে ডুগডুগি বাজিয়ে লন্ডন চলে গিয়েছিল। গত দুই বছর পূর্বে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার সময় বৃটিশ সরকার সেদেশে অর্থের বিনিময় উপমহাদেশ এনং এশিয়ার অনুন্যত দেশগুলো থেকে দশ লক্ষ ছাত্রদের এক/দুই বছরের টিউশন ফি এডভান্স নিয়ে যেকোনো প্রকার “আর্থীক স্বচ্ছলতা সনদ”এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকেও প্রায় তিন লক্ষ ছাত্র ভর্তি করিয়েছিল। তখন বাংলাদেশে বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী “ছাত্র ভিসা” ব্যবস্থা সহজতর করে মূলত বৃটিশ সরকারের অণুগত ভৃত্বের দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনিয়া স্বার্থে, কিন্তু ক্ষতি করে গিয়েছেন-বাংলাদেশের লক্ষলক্ষ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। অন্যদিকে একই কুকর্মের জন্য আনোয়ার চৌধুরী আমাদের দেশীয় এক শ্রেনীর বেউকুব মানুষের কাছে বাহবা কুড়িয়েছিলেন। ঐ সব ভিসার পূর্ব শর্তইছিল-উক্ত প্রগ্রামে ভিসা পাওয়া কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষাকালীন সময় কোনো কাজ করার সুযোগ পাবেনা, যে বিষয়ে পড়ার জন্য অনুমোদন পেয়েছে সেই বিষয় পরিবর্তন করতে পারবেনা এবং কোনো অবস্থাতেই শিক্ষা শেষে বৃটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদনই করতে পারবেনা। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দেশীয় অসাধু কন্সাল্টেন্সী ফার্মগুলো উক্ত দুইটি গুরুত্বপুর্ণ পয়েন্ট শিক্ষার্থীদের জানায়নি, কিম্বা কোনো কোনো শিক্ষার্থী বিষয়টা জেনেও মনে করেছিল-একবার লন্ডন যেতে পারলেই সব পাওয়া সম্ভব হবে। 

সব থেকে বিস্ময়কর ব্যপার-বৃটেনে ভর্তি হওয়া ৯০ ভাগ স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় বৃটিশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচ্চ শিক্ষা ক্যাটাগরীর এফিলিয়েটেড নয়। ঐ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের দেশীয় সোডা/কোডা, অতীশ, শান্তা,গ্রীন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের হুবহু মিল-যা মূলত একধরনের কোচিং সেন্টার! ঐসব প্রতিষ্ঠানের না আছে কোনো ক্যাম্পাস, নাআছে কোনো শিক্ষক! যার মালিকানা মূলত উপমহাদেশ, হংকং এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশের প্রতারক চক্র। ছাত্র ভর্তি করাতে পারলেই সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই দেশীয় এজেন্টরা মোটা অংকের কমিশন পেয়ে যেতো। আমি দুটো তথাকথিত “বিশ্ববিদ্যালয়” দেখেছি-যার একটা মূলত “অনুবাদ কেন্দ্র” আর একটা “ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র”! অথচ ওদের ওয়েবসাইটের বাগড়ম্বরতা দেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাতো বটেই আমাদের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীও ভিমড়ী খাবেন! এমন অনেক শিক্ষার্থীদের দেখা পেয়েছি-যাদের একাডেমিক রেজাল্ট নিয়ে ঢাকার নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজ কিম্বা দনিয়া ডিগ্রী কলেজেও ভর্তি হতে পারতোনা! অথচ তারা লন্ডন এসেছে উচ্চ শিক্ষার্থে!

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট আর ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে বুঝেছি বাংলাদেশের ঢাকাসহ বড় বড় নগরীতে গজিয়ে ওঠা স্টুডেন্টস কনসালটেন্ট ফার্ম, এজেন্টরাই লন্ডনের শিক্ষার্থী পাঠাতে মূল ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। বিভিন্ন মন ভোলানো শ্লোগান দিয়ে এরা শিক্ষার্থীদের কাছে টেনে নিম্নমানের কলেজ, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দিচ্ছে। এসব কনসালটেন্ট ফার্ম এবং এজেন্টরা স্টুডেন্টদের কাছে থেকে ভর্তি এবং ভিসা প্রসেসিং বাবদ নগদ অর্থ না নিলেও তারা অন্য পন্থায় টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেকে ঐসব কলেজের বেনামী মালিক হয়ে পুরো টিউশনি ফি-ই হজম করে ফেলছে। তবে সে যাই হোক, লন্ডনে তরুণ শিক্ষার্থীদের জীবন-যাপন যে কতোটা বিপর্যস্ত তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আমাদের সংশিস্নষ্ট সকলের উচিত এ বিষয়গুলো একটু ভেবে দেখা।

আবার ফিরে আসি সেই পুরনো কথায়। লন্ডনে যারা পুরনো বা যারা সেটেল্ড তাদের যাপিতজীবন অন্যরকম। তারা অবশ্যই গতিময়, সহনশীল এবং পরোপকারীও বটে। নিজ দেশের তরুণদের বিপদে তারা অনেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তেমনই বেশ ক’জনকে দেখেছি নিজ চোখে। আমার সিলেটি এক বন্ধুর ছোট ভাই-রুমন, বৈবাহিক সূত্রে বর্তমানে বৃটিশ নাগরিক। শুধু মাত্র কঠোর পরিশ্রমের ফলে ১০ বছরেই এখন প্রতিষ্ঠিত। লিমোজিন চালানোই মূল পেশা সেই সংগে বাড়ি/ফ্ল্যাট কেনা বেচার ব্রোকারী করে। যার আশ্রয়ে এখন ৬ জন দূর্ভাগা ছাত্র! 

তেমনই আরো ক'একজন এর মধ্যে স্বপন কুমার সাহা। স্বউদ্যোগে লন্ডনের সুইনডোন সিটিতে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করে চমৎকার একটা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ২০০৩ সালে সে অশোকা নামে রেস্টুরেন্ট চালু করে। স্বপনের কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং দেশপ্রেমবোধ এতোটাই প্রখর -যে কাউকে তা মুগ্ধ করবে।অনেক ঝুকি নিয়েও স্বপন কুমার এখন অন্তত ২৫ জন দূর্ভাগা ছাত্রের অন্য সংস্থান করছেন। ডাঃ ফজল মাহামুদ তেমন আর একজন ব্যবসায়ী। যিনি তার “নিউকম(ইউকে)লিঃ” নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংগালী,বৃটিশ-ইন্ডিয়ান অনেক লোকের চাকুরীর সংস্থান করেছেন। পাঠক,আমার বন্ধু ডাঃ ফজল মাহমুদ ও স্বপন কুমার দুজনের সম্পর্কেও অনেক ছাত্রদের অভিযোগ-তারাও দেশ থেকে ছাত্র আমদানী করেন এবং এখানে এসে সেই ছাত্রদেরমধ্যে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এবিষয়ে লন্ডনে ডাঃ মাহমুদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু ডাঃ মাহমুদের সাথে এই প্রসংগে আমি কোনো কথা বলিনি। আবার বুবুর ছেলেবেলার সই ইভানা বুজী যিনি ৩৮ বছর ইস্ট লন্ডনে বসবাস করছেন,শিক্ষকতা পেশা থেকে অবশর নিয়ে তিনিও অনেক বাঙালি স্টুডেন্টকে থাকতে দিয়েছেন নিতান্তই মায়ার কারণে। 

রুমন, ডাঃ মাহামুদ, ইভানা বুজী এবং স্বপনের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ আমার মাঝে আন্দোলিত হলেও তরুণ শিক্ষার্থীদের দীর্ঘশ্বাস আমি ভুলে যাইনি। সত্যিই লন্ডন আমাদের কাছে এক স্বপ্নের শহর। কিন্তু যাবার আগে অবশ্যই আমাদের অনেক কিছু ভাবার,অনেক বেশী করে জানার ও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। তানাহলে স্বপ্ন ভংগ অনিবার্য্য!

ধন্যবাদ সবাইকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন