মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(প্রথম র্পব)


নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(প্রথম র্পব)

লিখেছেন বাবুয়া, সন্ধ্যা ০৬: ২৬, ২৩ জুন, ২০১১

নাগরিক জীবনে যোগাযোগ(প্রথম র্পব)


রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা যানজটে রাহুগ্রস্ত। রাস্তায় বের হয়ে দশ গজ যেতে না যেতেই যানজটের কবলে পড়ে রিকশায় বসে ঝিমাই, গাড়ীতে বসে তেল পোড়াই, বাসে বসে গরমে ভাজা ভাজা হই, আর হাপিত্যেশ করতে থাকি কখন গন্তব্যে পৌঁছাবো বলে। প্রতিটি যানজটে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, যে পরিমাণ ডলার পোড়ান হয়, আর সীসা বাতাসে মেশে তার হিসেব কে রাখে? আর সময়? সাইন্স ল্যাবরেটরী থেকে পল্টন যেতে আমাদেরকে আড়াই ঘন্টা, গুলিস্তান যেতে এক ঘন্টা, আর গুলশান যেতে দুই ঘন্টা সময় হাতে রেখে রওয়ানা দিতে হয়। হায় রে সময়! আমাদের ঢাকায় এসে সময়রে চাকা যেন থেমে গেছে! এর কোন দামই নেই। এ অমূল্য সময় প্রতিদিন কেবল এ ঢাকা শহরের মানুষই কোটির অধিক কর্ম ঘন্টা নিবেদিত (নষ্ট?) করছে যানজট রাহুর উদ্দেশ্যে। কবে যে এ দুষ্ট রাহুর কবল থেকে ঢাকার মানুষ মুক্তি পাবে তা পরওয়ারেদেগার ছাড়া আর কারও পক্ষে যেন বলার কোন উপায় আছে বলে মনে হয় না।

এ দেশে সরকার আসে সরকার যায়। বিশেষজ্ঞরা যানজটের কারণ নিয়ে গবেষণা করেন, বক্তৃতা দেন, প্রবন্ধ লেখেন। রাজনীতিবিদেরা সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন উড়ন্ত পথ নির্মাণের, পাতাল রাস্তা খননের, আর ট্রাম বসানোর কথাও কেউ কেউ বলে আসছেন সে কবে থেকে! প্রজেক্ট বানানো, আর বিদেশের নিকট অর্থ সাহায্য চাওয়া আর পাওয়া আজও শেষ হল না, আর যানজটেরও কোন কূলকিনারা হল না। যানজট লেগেই আছে এবং এ যানজট এবার যেন ঢাকাবাসীদের জান নিতে উদ্যত হয়ে উঠেছে। তবুও এ যানজট নিরসনে কটি ভিআইপি রাস্তা চিহ্নিত করা ছাড়া আর কোন বাস্তব উদ্যোগ নিতে আজও দেখা গেল না। এ নিয়ে যেন কারও কোন মাথা ব্যথা নেই, সবাই যেন নির্বিকার, চলছি তো চলছিই আমরা। যানজটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার পুলিশ বেচারাকে শুধু ঘর্মাক্ত কলেবরে সিগন্যাল বাতিকে সাহায্য করতে রোজ দেখে থাকি আমরা।

ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় বিশ্বের যে কোন দেশের সঙ্গে তুলনীয়। প্রতিটি মাস আসে আর আপনাকে কাগজের, বিদ্যুতের, পানির, বুয়ার, চাকরের, গ্যাসের, ময়লার, সিটি কর্পোরেশনের বিলের চাপ সইতে হয় নিদারুণভাবে। আর নাগরিক জীবনের বাড়তি খরচ তো দিতেই হবে আপনাকে। তার ওপর রয়েছে আপনার নিজের জীবন ধারণের রূঢ় বাস্তবতা। সন্তানের পড়ার খরচ, যাতায়াত খরচ বা গাড়ি থাকলে তার ব্যয়। নাগরিক জীবন অত্যন্ত গতিশীল, ফাস্ট। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক যে-কোন পেশার এ নগরবাসীকে এ-সকল খাতের খরচের অর্থটা আগেভাগেই অর্জন করে রাখতে হয়, আর তা করতে গিয়ে তাকে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটতে হয় শহরের এ-প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত। এখন মানুষের নিকট টাইম ইজ মানি। টাকাই তার রক্ত সচল রাখে, জীবনকে গতিশীল করে। সরকারি কাজে বা ব্যবসায়ীক কোন সভায় গুলিস্তান থেকে গুলশান যাবেন। কত সময় হাতে নিয়ে তিনি রওয়ানা দেবেন? আট কর্ম ঘন্টার মধ্যে শুধু এ ভ্রমণের আসা-যাওয়ায় নিশ্চয়ই চার ঘন্টা ব্যয় করার মত অবস্থায় কেউই থাকে না। নাগরিক জীবনে দ্রুতগামী যানবাহন তাই অপরিহার্য। কিন্তু সে যানবাহনকারী যানটা তো আজ রাহুগ্রস্ত!

ঢাকার রাস্তা থেকে তিনটি জিনিস তুলে দিলেই যানজট তাৎক্ষণকিভাবে বার আনা কমে যাবে। আর এ তিনটি জিনিস হচ্ছে: রিকশা, হকার এবং অবৈধ পার্কিং। বক্ষমান আলোচনার মূল লক্ষ্য রিকশা সম্পর্কে কিছু অপ্রিয় কথা বলা। 

রিকশা ঢাকাবাসীর পরম বন্ধু, আধার রাতের সাথী। ঘর থেকে বের হয়েই আপনি রিকশায় চাপতে পারেন। এ সুবিধা এশিয়ার কটি দেশ ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও নেই। রিকশা আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে সাহায্য করে থাকে ডলারে তেল কেনা কমিয়ে। রিকশা পরিবেশ দূষণ রোধের পরম সহায়ক এবং কর্ম সংস্থাপনের এক বিশাল ক্ষেত্র।

পেশা হিসেবে রিকশা টানা একটি অমানবিক পেশা। আগের দিনে বড়লোকেরা মানুষের কাঁধে চড়ে, পালকিতে করে বায়ু সেবন করতেন আর স্থানান্তরে গমনাগমন করতেন। আমরা সভ্য হয়ে মানুষের এ কাঁধে চড়াকে এক সময়ে ঘৃণা করতে শিখি। আর এ কাঁধে চড়াকে আজ ভিন্নরূপে, ভিন্ন নামে, কর্ম সংস্থানের নামে, পরিবেশ রক্ষার নামে এবং আরও কত কি লেভেলের মাধ্যমে অতি যতেœ লালন করে চলেছি। কি অদ্ভুত বৈপরিত্য! গাধা আর মানব সন্তানের মধ্যে পার্থক্য রইল কৈ?

রিকশা ধীরগতিসম্পন্ন, গতিশীল যান্ত্রিক বাহনের গতিরোধক এবং ব্যয়বহুল বাহন। এর কোন নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড না থাকায় রাস্তার যে কোন জায়গায় যে কোন মুহূর্তে জটলা বাধিয়ে দিতে পারে। রিকশা ক্ষণভঙ্গুর এবং যে কোন বাহনের একটু ধাক্কাতেই ভেঙ্গে/ উল্টে গিয়ে চালক এবং চড়নদার উভয়েরই ক্ষতি করতে পারে। এ ধরনের রিকশা দুর্ঘটনায় কত নরনারী যে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তার কোন সংখ্যাতাত্তিক তথ্য আমাদের জানা নেই। রিকশা দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় প্রকাশ পায় না, টিভি বলে না। তাই এটি মানুষের অগোচরেই থেকে যায়। শহরের জনগুরুত্বপূর্ণ জনসমাগমের জায়গায়ই, বাজার এলাকায়, অফিস আদালতের আঙ্গিনায়, স্কুল কলেজের সামনে রিকশা চড়নদার পাওয়ার সম্ভাবনায় দারুণ ভীড় করে কোন যান্ত্রিক বাহনের প্রবেশকে অসম্ভব করে তোলে। কোন যান্ত্রিক বাহন উচ্চগতিতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ তার সামনে এসে রিকশা পড়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য। এ অবস্থায় চালক হঠাৎ গতিরোধ বা গতির দিক পরিবর্তন করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

রিকশা যাত্রীর, বিশেষত মহিলা যাত্রীরা, ছিনতাইকারীদের সহজ শিকার। শ্লথগতিসম্পন্ন রিকশা যাত্রী নিয়ে চলছে। পেছন থেকে মোটর সাইকেল কিংবা বেবীট্যাক্সিযোগে একজন ছিনতাইকারী এসে তার গতি থামিয়ে মহিলার হাতে ধরা ভ্যানিটি ব্যাগটি কিংবা তার গলার সোনার চেইনটা নিয়ে চলে গেল। এমনকি, কোন গলিতে রিকশাটি যানজটে দাঁড়িয়ে। একজন পায়ে হেঁটে এসে মহিলার গলার চেইন কিংবা তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। আপনার করার কিছু নেই। কোন সহযাত্রীও দৌঁড়ে গিয়ে এ ছিনতাইকারীকে ধরার সাহস দেখান না। কারণ ছিনতাইকারীর নিকট কোন ধরনের অস্ত্র, নিতান্ত একটা ছোরা থাকার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ধরতে গেলে সে আমূল বসিয়ে দিতে পারে। তাই কেউ হতভাগা মহিলার এ বিপদে এগিয়ে আসেন না। এভাবে যে রিকশা একদিন ছুচো ছিনতাইকারীর জন্ম দিল, সেই আর একদিন রাস্তায় রিভলবার উঁচিয়ে ডাকাতি করছে। রাজধানীর মত ব্যস্ত শহরে রিকশার মত ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন মধ্যযুগের ব্যবস্থা হতে পারে একবিংশ শতাব্দীর বাহন এটি নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন